Giant Clashes গ্রীস vs পারস্য (১)
Giant Clashes গ্রীস vs পারস্য (২)
৪৯০বিসি’তে শক্তিশালী পার্সিয়ান বাহিনী পরাভূত হোল ম্যারাথনের যুদ্ধে আর এথেন্স’কে মাটির সাথে মিশিয়ে দেবার বাসনা অপূর্ণ রেখেই ৪৮৬বিসি’তে মৃত্যুবরণ করতে হয় রাজা দারিয়ুসকে। মারা যাবার পূর্বে পুত্র ‘জারক্সিস’কে উত্তরাধিকার মনোনীত করে যান এবং জারক্সিসকে পিতার কাছে শপথ করতে হয়, 'এথেন্সকে মাটির সাথে মিশিয়ে দিয়ে পারস্যের প্রতিশোধ পূরণ করবে'।
ক্ষমতায় আরোহণের পরবর্তী ৫টি বছর জারক্সিস শুধুমাত্র সাম্রাজ্যের নানান কোণ হতে অর্থ এবং সৈন্যই সংগ্রহ করে যান। আর এইভাবে গড়ে উঠে হয় ইতিহাসের বিশালতম সৈন্য বাহিনী; যার উদ্দেশ্য এথেন্সকে ধুলোয় মিশিয়ে দেওয়া। গ্রীস অভিযান শুরু করার পূর্বে এই সৈন্যবাহিনীকে সমবেত করা হোল ‘লিডিয়া’ তথা বর্তমান তুরস্কে। এই বিশাল বাহিনী দেখে এক গ্রীক গুপ্তচর এথেন্সে খবর পাঠাল ‘সারা পৃথিবীর সকল মানুষকে নিয়ে আসা হয়েছে, এথেন্সের সাথে যুদ্ধ করার জন্য’। ঐসময় সমগ্র গ্রীসের জনসংখ্যা ছিল ৫-৬লক্ষ আর জারক্সিসের বাহিনীতে ছিল কমপক্ষে ৫লক্ষ, কারো কারো মতে আবার এর সংখ্যা ২০লক্ষ ছিল বলে জানা যায়। পিতার মত আর কারও উপর দায়িত্ব না দিয়ে কিং জারক্সিস নিজেই নেতৃত্ব নেন পারস্য বাহিনীর।
কিন্তু এতো বিশাল বাহিনী কিভাবে এশিয়া হতে ইউরোপে পার হবে তা একটা বিশাল সমস্যা হয়ে দাঁড়াল। হয় ২বছর মার্চ করে সম্পূর্ণ কৃষ্ণ সাগর ঘুরে যেতে হবে, নাহয় ‘হেলেনস্পুন্ট’ নামক স্থানে মধ্যবর্তী ১মাইল সাগর পাড়ি দিতে হবে।
হেলেনস্পুন্ট যা বর্তমানে দার্দানালিস নামে পরিচিত
জারক্সিস হুকুম দিলেন সাগরের বুকে সেতু নির্মাণ করতে!! মিসরীয় কারিগরদের নিয়ে আসা হোল আর জড়ো করা হোল বাতিল হয়ে যাওয়া অসংখ্য পুরানো জাহাজ। সাগরের বুকে এগুলোকে আড়াআড়ি ফেলে একটির সাথে আরেকটি জোড়া লাগিয়ে তৈরি করা হোল সেতু। স্রোতে যেন ভেসে যেতে না পারে, সে উদ্দেশ্যে তলদেশে পাথরের সাথে বেঁধে দিয়ে শক্ত করে নোঙ্গর করানো হল আর উপরে চলাচলের জন্য সাড় করে পুরু তক্তা বিছিয়ে দিল কারিগরেরা। এই সেতু দিয়েই পার হয়ে এল লক্ষ লক্ষ পার্সিয়ান সেনা আর ঘোড়া।
পার্সিয়ানদের তৈরি পন্টুন সেতু
এদিকে, এথেন্সকে ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষার জন্য এথেনীয় জনপ্রতিনিধিরা ‘গ্রীস’ রক্ষার দাবী নিয়ে অন্যান্য রাজ্য-শহরগুলোর কাছে সাহায্যের আবেদন জানায়। কিন্তু গ্রীস যে একটি একক জাতি এই ধারণাই তখন কারও মাথায় ছিলনা। নিরাশ হয়ে এথেন্স হাত বাড়ায় চিরশত্রু স্পার্টানদের রাজা লিওনাইদাসের কাছে। লিওনাইদাস বোকা ছিলেন না, তিনি জানতেন পার্সিয়ান আক্রমণ মানে স্পার্টারও দাসত্বের বন্ধনে যাওয়া।
এথেনীয়ানদের মৌখিক সম্মতি দিয়ে ঈশ্বরের আদেশ লাভের আশায় লিওনাইদাস সাক্ষাৎ করল পবিত্র ‘ডেলফি’ মন্দিরের ওরাকলের সাথে।
ডেলফি'র মন্দির
ওরাকলের কাছ থেকে ঐশ্বরিক বাণী আসল, ‘এথেন্স পরাভূত হবে পার্সিয়ানদের কাছে, কিন্তু স্পার্টা রক্ষা পাবে যদি মহান হেরাক্লিসের উত্তরসূরি স্পার্টান রাজা আত্মত্যাগ করে’।
লিওনাইদাস স্পষ্টতই ভাবলেন, এই বাণী তাঁকে উদ্দেশ্য করেই বলা হয়েছে এবং তার আত্মত্যাগেই রক্ষা পাবে স্পার্টা। কিন্তু স্পার্টা’র রাজ্যসভা তার এই দাবীকে উপেক্ষা করল, আর লিওনাইদেসের হাতেও তাদের বুঝানোর মত এতো সময় ছিলনা। নিজের ব্যক্তিগত বাহিনীর মাত্র ৩০০ জনকে নিয়ে যুদ্ধযাত্রা করলেন, যুদ্ধের নেশায় উন্মুখ বাকি ৯০০০হাজার স্পার্টান সৈন্য হতাশাভরে তাদের বিদায় দিল।
আশেপাশের ছোট ছোট রাজ্যগুলো হতে আরও ৭০০০হাজার সেনা যোগ দিল তার অধীনে। কিন্তু এতো অল্প সংখ্যক সৈন্য নিয়ে কিভাবে বিশাল পার্সিয়ান বাহিনীর মোকাবেলা করা হবে? লিওনাইদাস জানতেন এর উত্তর। শুধু একটি স্থানেই আটকে দেওয়া সম্ভব পার্সিয়ানদের; আর তা হচ্ছে ‘হট গেট’ বা থার্মোপলি। আরও একটি রক্ষণবুহ্য গড়ে তোলা হয় ‘ইস্থমাস অব কারিন্থে’, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে গ্রীসের ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে লিওনাইদাসের বাহিনীর উপরেই।
থার্মোপলি
সেই ২৫০০বছর পূর্ব হতে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পর্যন্ত অসংখ্য ভয়ঙ্কর যুদ্ধের রণক্ষেত্র হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে এই থার্মোপলি। কৌশলগত অবস্থান নিয়ে মাত্র অল্পসংখ্যক সৈন্য দিয়ে বড় একটি সেনাদলকে আটকে দেবার জন্য বিখ্যাত এই প্রাকৃতিক রণভূমি।
থার্মোপলি
গ্রীসের উত্তর আর দক্ষিনের মাঝে একমাত্র সংযোগকারী রাস্তাটি এই থার্মোপলিতে এসে এক দুর্গম রূপ নিয়েছে, যার সবচেয়ে প্রশস্ত স্থানটিও ছিল মাত্র ২০০গজ চওড়া। একদিকে লাইমস্টোনের অত্যন্ত খাড়া দেওয়াল বিশিষ্ট ৫০০০ ফুট উঁচু পাহাড় ‘মাউন্ট কলিওড্রামুস’ আর অপর দিকে একেবারে খাড়া তীর প্রায় ৩০০ফুট নিচে নেমে গেছে অ্যাজিয়ান সাগরে। আর এর উত্তর দিকের প্রবেশমুখটি এমনভাবে বাঁক খেয়েছে যে অল্পকিছু সৈন্যই শুধু ঢুকতে পারে ভিতরে, পিছন হতে সম্মিলিত বল প্রয়োগ বা তীব্র গতি নিয়ে অশ্বারোহী বাহিনীর আক্রমণ পুরোই অসম্ভব। কিং লিওনাইদাস জানত প্রায় ৫০গুন বড় পার্সিয়ান বাহিনীকে রুখতে হলে থার্মোপলি ছাড়া বিকল্প নেই, তাই সেখানেই সমবেত হলেন ৭০০০সৈন্য নিয়ে।
এদিকে স্কাউট দ্বারা গ্রীক বাহিনীর অবস্থানের কথা জারক্সিসের কানে পৌঁছায়। প্রস্তুতি নেয়াই ছিল, সাগরের তীর ঘেঁষে সেনাবাহিনীর সাথে চলতে থাকা ১০০০ জাহাজকে হুকুম দিলেন, আরও সামনে এগিয়ে সুবিধাজনক স্থানে অবতরণ করে পিছন হতে স্পার্টানদের আক্রমণ করার।
আর্টেমেসিয়াম প্রণালী
কিন্তু গ্রীকরাও জানত এই সম্ভাবনার কথা, পার্সিয়ান নৌবহরকে ঠেকিয়ে দেওয়ার জন্য আর্টেমেসিয়াম প্রণালীতে ২০০যুদ্ধ জাহাজ নিয়ে অবস্থান নেয় সেনাপতি 'থেমিস্টোক্লিস'। থার্মোপলির যুদ্ধ বললে সবার চোখেই লিওনাইদাসের ছবি ভেসে উঠলেও, যুদ্ধের প্রকৃত ‘মাস্টার মাইন্ড’ ছিলেন এই থেমিস্টোক্লিস। থার্মোপলিসহ কোথায়, কিভাবে পার্সিয়ানদের মোকাবেলা করা হবে, তার সবই পরিকল্পণা করেন তিনি এবং নিজে দায়িত্ব নেন এথেনীয় নৌ-বাহিনীর।
১ম দিনের নৌযুদ্ধ
মাত্র ২০০ গ্রীক জাহাজের বিপরীতে ১০০০জাহাজ সত্ত্বেও পার্সিয়ান নৌ সেনাপতি কোনরূপ ক্ষতির স্বীকার হতে চাচ্ছিলেন না। তিনি জানতেন এই ক্ষুদ্র বহর নিয়ে গ্রীক’রা কিছুতেই তাদের উপর আগ বাড়িয়ে আক্রমণে আসবেনা। তাই গ্রীকদের না ঘাঁটিয়ে ২০০ জাহাজ’কে অন্যপথে পাঠিয়ে দিলেন, যেন তারা ‘ইউবোয়িয়া’ দ্বীপ ঘুরে লিওনাইদাসের বাহিনীর পিছনে অবতরণ করে।
কিন্তু তারা প্রাচীন গ্রীসের চার্চিল বলে খ্যাত থেমিস্টোক্লিস’কে চিনতে ভুল করেছিল। সারাদিন নিষ্ক্রিয় বসে রইলেন থেমিস্টোক্লিস কিন্তু সন্ধ্যা নামার আগমুহূর্তে হুকুম দিলেন আক্রমণের। তিনি জানতেন দীর্ঘক্ষণ নৌযুদ্ধে এই বিশাল পার্সিয়ান বহর’কে পরাস্ত করা যাবেনা; বরঞ্চ নিজেরাই ধ্বংস হয়ে যাবেন; তাই বেছে নিলেন দিনের আলোর শেষ সময়টুকু। রাতে নৌযুদ্ধ করা কিছুতেই সম্ভব নয়, তাই আঁধার নেমে আসার আগেই যতটুকু সম্ভব ক্ষতি করতে চাইলেন পার্সিয়ান বাহিনীর।
গ্রীক-পারস্য নৌযুদ্ধ
হঠাৎ আক্রমণে বিহ্বল হয়ে পড়ল পার্সিয়ানরা। তখনকার এই নৌযুদ্ধে কোন গোলা-বারুদ বা হাতাহাতি লড়াইয়ের কোন বিষয় ছিলনা, শুধু ধাক্কা দিয়ে কে কাকে ডুবিয়ে দিতে পারে সেই প্রতিযোগিতা। পূর্ণ গতিতে ছুটে আসা গ্রীক ‘ট্রাইরিম’ সজোরে আঘাত হানল থেমে থাকা বা মাত্র চলতে শুরু করা পার্সিয়ান জাহাজগুলোতে। অল্পসময়ের সেই যুদ্ধে ডুবে গেল অসংখ্য পার্সিয়ান জাহাজ, ৩০টিরও বেশী বন্দী হোল গ্রীকদের হাতে। যদিও শত শত পার্সিয়ান জাহাজ তখনও অক্ষত, তবুও এই প্রাথমিক বিজয় গ্রীকদের মাঝে দারুন উদ্দীপনার জন্ম দিল। লিওনাইদাসের বাহিনীর কাছেও পৌঁছে গেল এই খবর, ফলে পিছন হতে হামলার আর কোন ভয় রইলনা তাদের। এদিকে যেই ২০০জাহাজ ঘুরপথে পিছন থেকে হামলা চালাতে আসছিল, প্রবল ঝড়ে পড়ে সবকটিই ডুবে গেল; গ্রীকদের মাঝে এই ধারণা হোল, দেবতা তাদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে।
থার্মোপলি ১ম দিন
যুদ্ধ শুরুর পূর্বে, জারক্সিসের দূত আত্মসমর্পণ করার প্রস্তাব নিয়ে হাজির হোল স্পার্টানদের শিবিরে। কিন্তু যুদ্ধের ময়দানে মৃত্যুকে যারা গৌরবের মনে করে সেই স্পার্টানরা তাচ্ছিল্যভরে প্রত্যাখ্যান করল সেই প্রস্তাব। এই কথোপকথনের বর্ণনা পাওয়া যায় হেরোডিটাসের লেখায়,
পার্সিয়ান দূত বলল- You will die. Our arrows will block the sun.
জবাবে স্পার্টান সেনা ডিয়েনিকেস বলল- Good, then we will fight in the shade.
ইতিহাসে অমর হয়ে যাওয়া যুদ্ধের ময়দানের সবচেয়ে পুরাতন উক্তি সম্ভবত এটিই।
অবশেষে শুরু হোল যুদ্ধ। থার্মোপলির সরু রণক্ষেত্রে স্পার্টানরা তাদের ঐতিহ্যবাহী ‘ফ্যালাংস’(২য় পর্বে দেখুন) বিন্যাস তৈরি করে একের পর এক আক্রমণ ফিরিয়ে দিতে থাকল আর স্তুপের পর স্তুপ তৈরি হতে লাগল মৃত পার্সিয়ান সৈন্যদের। দিনশেষে থার্মোপলিতে ১০০০০ হাজার সৈন্যের মৃতদেহ আর সমুদ্রে নৌবাহিনীর পরাজয়ের বেদনা নিয়ে তাঁবুতে ফিরে গেল জারক্সিস। মুষলধারে বৃষ্টিতে ভিজে আর বিদ্যুৎ চমকের আলোয় পড়ে থাকা মৃতদেহগুলো দেখতে দেখতে পার্সিয়ান সৈন্যরা ক্লান্ত নিদ্রাবিহীন রাত্রি পার করল। এইখানে উল্লেখ্য, জারক্সিস হুকুম দিয়েছিলেন প্রতিটি মৃতদেহের সৎকার করা হবে, কারণ মৃতদেহের অসম্মান হতে দেখলে সৈন্যরা নিজেদেরও ভবিষ্যতে এরকম হবে ভেবে আরও হতাশ হয়ে পড়ার সম্ভাবনা ছিল।
দ্বিতীয় দিন
পরদিন সকালে আবারো বেজে উঠল যুদ্ধের দামামা। লিওনাইদাস তার বাহিনী নিয়ে আগের অবস্থানেই স্থির রইলেন আর থেমিস্টোক্লিস যুদ্ধজাহাজে বসে তৈরি হল সমরের জন্য। আগেরদিন জারক্সিস এতো বিশাল ক্ষতি দেখে বুঝলেন এভাবে হবেনা, প্রস্তুত হতে বললেন ইমমরটালদের। অভিজ্ঞ ইমমরটাল’রা নিঃশব্দে এগিয়ে মুখোমুখি হোল স্পার্টানদের, আর স্পার্টানদের বৈশিষ্ট্য ছিল রক্তহিম করা চিৎকার আর শত্রুপক্ষের প্রতি ব্যাঙ্গ-বিদ্রুপ। একসময় নীরবতা ভেঙ্গে ইমমরটালরা ঝাঁপিয়ে পড়ল স্পার্টানদের উপর, কিন্তু ভিন্ন কিছুই ঘটল না। আগের দিনের মতই সমানে মারা পড়তে লাগল স্পার্টানদের ‘ডোরি’ বর্শার আঘাতে। সামনে মৃতদেহ স্তুপ হয়ে গেলে আক্রমণ করার পথ বন্ধ হয়ে যায়, চলল মৃতদেহ সরানোর কাজ এবং পুনরায় আক্রমণ; কিন্তু ফলাফল ঐ একই ঘটল। পরিশেষে সারাদিন চলা যুদ্ধে আরও ১০০০০পার্সিয়ান সেনা মৃত্যুর মুখে ঢলে পড়ল।
বিশাল পার্সিয়ান বাহিনীর বিরুদ্ধে স্পার্টানদের প্রতিরোধ
এদিকে সাগরের বুকে আবারো একে অন্যকে ধ্বংসের খেলায় মেতে উঠল গ্রীক এবং পার্সিয়ান যুদ্ধজাহাজগুলো। কিন্তু পাঁচগুন বড় বহর নিয়েও বিপুল ক্ষতির স্বীকার করে দিনশেষ করল পার্সিয়ান বাহিনী।
যুদ্ধের শুরুতেই পরপর দুইদিন এমন ভয়াবহ ক্ষতির স্বীকার হয়ে একদম মুষড়ে পড়লেন কিং জারক্সিস। নৌযুদ্ধেও বিশাল ব্যর্থতার ফলে কোন পথই খুঁজে পেলেন না এই অবস্থা থেকে উত্তরণের। এমন সময় তাঁকে উদ্ধার করতে এগিয়ে এল এক বিশ্বাসঘাতক গ্রীক গুপ্তচর 'এফিয়াল্টিস'। ইতিহাসের প্রথম এই দেশদ্রোহী আজও অমর হয়ে আছে, গ্রীকরা তার নামের অর্থ করেছে ‘রাতের দুঃস্বপ্ন’।
এফিয়াল্টিস সন্ধান দিল এক গুপ্ত পথের, যা মাউন্ট কলিওড্রামুস ঘুরে স্পার্টান বাহিনীর পিছন দিয়ে বেড়িয়ে এসেছে। শুনে আর দেরী করলেন না জারক্সিস, ১০০০০ হাজার সেনাকে রাতের আঁধারেই পাঠিয়ে দিলেন ঐ গিরিপথ ধরে। এদিকে লিওনাইদাসও ওয়াকিবহাল ছিলেন এই পথটি সম্পর্কে, তাই যুদ্ধের পূর্বেই ১০০০ ‘ফোশিয়ান’ যোদ্ধাকে রেখে দিয়েছিলেন সেখানে। কিন্তু পার্সিয়ান বাহিনী অগ্রসর হতে দেখেই তারা সেই স্থান ছেড়ে দিল, কারণ তারা ভেবেছিল পার্সিয়ানরা হয়তো তাদের গ্রাম ‘ফোশিয়া’তে আক্রমণ করতে যাচ্ছে।
গিরিপথ দিয়ে পার্সিয়ান বাহিনীর যাত্রাপথ, কাছেই ফোশিয়া গ্রাম
মাঝরাতে লিওনাইদাসে কাছে পার্সিয়ানদের গিরিপথ অতিক্রম করার খবর পৌঁছে গেল, শুনে হুকুম দিলেন অল্প অল্প করে সবাই যেন স্থান ত্যাগ করে। কারণ একসাথে বড় অংশ পিছু হটলে সামনে থেকে এসে আক্রমণ করবে শত্রুরা। এইভাবে সারা রাতে সমস্ত গ্রীক বাহিনীগুলো একে একে সরে গেল, শুধু রয়ে গেল লিওনাইদাস, সাথে ৩০০স্পার্টান এবং হাজার খানেক 'থেসবিয়ান' সেনা। পালিয়ে যাওয়ার চেয়ে তারা স্পার্টনদের সাথেই মৃত্যুবরণ করা শ্রেয় মনে করল। এরপরই রচিত হোল, ‘দ্যা লাস্ট স্ট্যান্ড’ খ্যাত ইতিহাস বিখ্যাত সেই মুহূর্ত।
ওরাকলের বাণী শুনেই লিওনাইদাস আত্মত্যাগের জন্য প্রস্তুত হয়ে ছিলেন, তাঁর প্রাণের বিনিময়ে স্পার্টা স্বাধীন থাকবে, এটাই ছিল তাঁর চাওয়া। আর সৈন্যদের জন্য রাজার পাশে যুদ্ধ করে মৃত্যুবরণ করা ছিল পরম সৌভাগ্যের ব্যাপার। সকালবেলায় এক পার্সিয়ান গুপ্তচর স্পার্টানদের শিবিরে উঁকি দিয়ে অবাক হয়ে গেল, তারা হাসাহাসি করছে, কেউ গোসল সেরে নিচ্ছে আবার কেউ গায়ে সুগন্ধি মাখছে। আসলে সে বুঝতে পারেনি সুন্দর, পবিত্রভাবে দেবতার কাছে হাজির হওয়ার জন্য স্পার্টানরা মৃত্যুর প্রস্তুতি নিচ্ছিল।
অবশেষে জীবনের শেষযুদ্ধে স্পার্টানরা মুখোমুখি হোল পার্সিয়ানদের। দুইদিক হতে প্রচণ্ড আক্রমণ চালাল পার্সিয়ানরা, স্পার্টানদের ফ্যালাংস ভেঙ্গে গেল; কিন্তু তারা হার মানলনা। বীরের মত যুদ্ধ করতে লাগল, হেরোডিটাসের ভাষ্য অনুযায়ী, "স্পার্টানদের হাতের সব গুলো বর্শা ভেঙ্গে পড়ল; এরপর তারা খাপ থেকে তলোয়ার বের করে আনল। সিংহের মত শত্রুদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়লেন লিওনাইদাস, শত্রুরা চারপাশ হতে ঘিরে ধরল তাঁকে। হঠাৎ একসময় তীর এসে বিদ্ধ হোল তাঁর গলায় এবং বুকে, নিথর কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে প্রাণহীন দেহটা একসময় লুটিয়ে পড়ল। পার্সিয়ানরা চেষ্টা করল তাঁর মৃতদেহ সরিয়ে নিতে কিন্তু প্রাণ থাকতে স্পার্টানরা রাজার দেহ নিতে দিবেনা; এভাবে ৪বার লিওনাইদাসের দেহ পার্সিয়ানরা কেড়ে নিল কিন্তু আবার উদ্ধার করে ফিরিয়ে আনল স্পার্টানরা। অল্পকিছু বেঁচে থাকা স্পার্টান সেনা লিওনাইদাসের মৃতদেহের চারপাশে ঘিরে দাঁড়াল, কিন্তু ঢাল হারিয়ে খোলা আকাশের নিচে সহজ লক্ষে পরিণত হোল তারা। আবারো সূর্যকে ঢেকে দিয়ে ধেয়ে আসল পার্সিয়ান তীর, প্রিয় রাজার পাশে শুয়ে মৃত্যুকে বরণ করে নিল সব স্পার্টান সৈন্য"।
চারিদিকে শত্রু পরিবেষ্টিত স্পার্টানরা
সবকিছু শান্ত হয়ে গেলে পায়ে হেঁটে যুদ্ধের ময়দানে প্রবেশ করল জারক্সিস, ঘৃণাভরে এগিয়ে গেলেন লিওনাইদাসের মৃতদেহের সামনে; তাঁর কারণেই মাত্র দুইদিনে ২০০০০ সৈন্য হারিয়েছেন। জারক্সিসের নির্দেশ অনুযায়ী লিওনাইদাসের মাথাটি কেটে বসিয়ে দেওয়া হোল তাঁর দন্ডের মাথায়।
এদিকে স্থলযুদ্ধে গ্রীক বাহিনীর পতনের খবর পেয়ে থেমিস্টোক্লিস নৌবহর নিয়ে চলে এলেন এথেন্সে। এথেন্স ধ্বংসের পথে কিং জারক্সিসের পথে আর কোন বাঁধা থাকল না। একে একে পথিমধ্যে সব গ্রীক-রাজ্য পারস্যের আধিপত্য স্বীকার করে নিল। ভয়াবহ বিপদ দেখে এথেনীয়ানরা আবার ‘ডেলফি’ মন্দিরে ওরাকলের শরণাপন্ন হোল। এবার ঐশ্বরিক বাণী আসল ‘সবাই কাঠের দেওয়ালের পিছে আশ্রয় নাও’। কিন্তু কেউ এর মর্মউদ্ধার করতে পারলনা, ভাবল নগর দেওয়ালে প্রতিরোধ গড়ার কথা বলেছে। শুধুমাত্র থেমিস্টোক্লিস বুঝতে আসল অর্থ, কাঠের দেওয়াল বলতে জাহাজকেই বুঝানো হয়েছে।
জাহাজে করে সমস্ত এথেন্সবাসীকে স্থানান্তর করা হোল বিভিন্ন গ্রীক দ্বীপে। অবশেষে পিতার কাছে দেওয়া কথা অনুযায়ী জারক্সিস এসে উপস্থিত হলেন এথেন্সে, সমগ্র এথেন্সকে আগুনে পুড়িয়ে মাটির সাথে মিশিয়ে দেওয়া হোল; কিন্তু শুধুমাত্র মন্দিরের অল্পকিছু পুরোহিত ছাড়া আর কেউ ছিলনা নগরে। ফলে প্রাণহানি হোল খুবই নগন্য।
জ্বলছে এথেন্স
এদিকে এথেন্স পুড়ানোর ১মাস পরে থেমিস্টোক্লিসের নেতৃত্বে গ্রীক নৌবাহিনী সমবেত হোল ‘সালামিস প্রণালীতে’, খবর পেয়ে পার্সিয়ানরা আক্রমণ চালাল। কিন্তু গুপ্তচরের দেওয়া ভুল তথ্য অনুযায়ী সরাসরি গিয়ে ফাঁদের মধ্যে গিয়ে পড়ল। সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস হয়ে গেল বিশাল পার্সিয়ান নৌবাহিনী। মাত্র একমাস আগের বিজয়টা যেন মুহূর্তেই হাতছাড়া হয়ে গেল জারক্সিসের। সেনাবাহিনীর একটা বড় অংশের হাতে গ্রীসের শাসনভার দিয়ে ফিরে এলেন নিজ দেশে।
দ্যা ব্যাটেল অব সালামিস
কিন্তু নিজভূমিতে পারস্যের শাসন মানতে একেবারেই রাজি হল না গ্রীকরা, বিভিন্ন জায়গায় শুরু হোল প্রতিরোধ যুদ্ধ। একে একে প্লাটিয়া, সেস্টোস আর মিকালি’র যুদ্ধে শোচনীয়ভাবে পরাজিত হোল পার্সিয়ান বাহিনী। শুরু হোল পার্সিয়ান বাহিনীর পলায়ন, গ্রীকরা তাদের ধাওয়া করে নিয়ে আবার সেই ‘হেলেনস্পুন্টে’র সেতুর দিয়ে ফেরত পাঠিয়ে দিল এশিয়ায়; ফলে পৃথিবীর বুকে আবারো পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হোল গণতন্ত্রের নিরাপত্তা ।
এরও প্রায় ১৩০বছর পরে গ্রীকদের মাঝে জন্ম নেয় সর্বকালের শ্রেষ্ঠ দ্বিবিজয়ী বীর ‘অ্যালেকজান্ডার দ্যা গ্রেট’, যিনি এশিয়া হতেও পারস্যদের পরাজিত করে একসময় আমাদের ভারতবর্ষে এসে পৌঁছান। পরের কোন এক লেখায় হয়তো তাঁর সেই মহান বিজয়ের ইতিহাসগুলো তুলে ধরব।
ততদিন ভালো থাকবেন, আর আমার লেখা কেমন হোল জানাবেন।
সর্বশেষ এডিট : ০১ লা মে, ২০১২ বিকাল ৩:১২