-১৬৬৩ খ্রিস্টাব্দ, মার্চের এক পড়ন্ত বিকেল
স্প্যানিশ মাইনে'র পশ্চিম উপকূল ঘেঁষে পানামার উদ্দেশ্যে এগিয়ে চলছে একটি জাহাজ। অনুকূল বাতাসে সবচেয়ে উঁচু মাস্তুলটির উপরে পতপত করে উড়ছে বুগ্যান্ডিয়ান ক্রসযুক্ত পতাকা আর সগর্বে জানান দিচ্ছে এই অঞ্চলে স্প্যানিশ সাম্রাজ্যের আধিপত্য। শুধুমাত্র স্পেন ব্যাতিত দুনিয়ার আর কারও অধিকার নেই এই সাগরে জাহাজ ভাসানোর। আসার সময় এতে পেরু হতে বোঝাই করা হয়েছে ২লক্ষ রৌপ্য মুদ্রা অর্থাৎ সাম্রাজ্যের বার্ষিক আয়ের প্রায় এক-চতুর্থাংশ বহন করে নিয়ে চলেছে এই জাহাজ।
'বুগ্যান্ডিয়ান ক্রস' স্প্যানিশ সাম্রাজ্যের প্রতীক
হঠাৎ পর্যবেক্ষকের সতর্ক সংকেত শোনা গেল, দূরে একটি জাহাজ দেখা যাচ্ছে। একনলা দূরবীক্ষণটি চোখে দিলেন ক্যাপ্টেন, দেখলেন দুই মাস্তুলের মাঝারি সাইজের একটি জাহাজ, গন্তব্য তাদের জাহাজের দিকেই। পালের পিছনে থাকায় পতাকাটি ঠিকমত দেখা যাচ্ছেনা। ক্যাপ্টেন ভাবলেন- 'হয়তো রেশন, চিনি পরিবহণকারী বানিজ্য জাহাজ হবে'। অন্যদিকে মনোযোগ সরিয়ে নিলেন।
কিছুক্ষণ পর,
এতক্ষণ কোন করে আসছিল জাহাজটি এবং বেশ কাছাকাছি এসে পড়েছে ইতিমধ্যে। হঠাৎ করেই দিক পাল্টে সমান্তরাল লাইনে এসে পড়ল এবং তাতেই এতক্ষণ ধরে পিছনে কিছুটা নিচুতে ঝুলতে থাকা পতাকাটা চোখের সামনে এসে গেল ক্যাপ্টেনের। বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেলেন, যেন নরকের দেবতা জাহাজে করে সাক্ষাৎ দিতে এসেছে তাকে; আর তারই নিদর্শন হিসেবে মাস্তুলে উড়িয়েছে 'জলি রজার'। মরার খুলিটি যেন অট্টহাসি দিয়ে উপহাস করছে তাকে।
জলি রজার
ঘটনার আকস্মিকতায় কর্তব্যটুকুও ভুলে গেলেন স্প্যানিশ ক্যাপ্টেন, যতক্ষণে তার আদেশ পেয়ে জাহাজ হতে প্রথম গুলিটা ছোঁড়া হোল; ততক্ষণে অর্ধেক নাবিক লুটিয়ে পড়েছে ডেকে, কামানের গোলার আঘাতে গলুই ভেঙ্গে পড়েছে। অসহায় আত্মসমর্পণ করলেন বাকি ক্রুদের নিয়ে, তা সত্ত্বেও উন্মত্ত দস্যুদের হাতে কচুকাটা হয়ে গেল বেশীরভাগ নাবিক। একসময় জলদস্যুদের নেতা নেমে এল জাহাজে, রামের নেশায় আসক্ত টকটকে লাল চোখের সামনে হয়তো মৃত্যুদেবতাও ভয় পেয়ে পিছু হটবে।
নীরবে স্পেন রাজার সম্পত্তি তুলে দিলেন দস্যুদের হাতে, বিনিময়ে বেঁচে থাকা অল্পকিছু সাথী সহ একটি ছোট নৌকায় তুলে ভাসিয়ে দেওয়া হোল ক্যাপ্টেনকে। আর অধিকসংখ্যক কামানে সজ্জিত স্প্যানিশ জাহাজটিতে উড়িয়ে দেওয়া হোল মরার খুলির পতাকা।
এটা শুরুর দিকেরই একটি ঘটনার কাল্পনিক দৃশ্যায়ন। দুনিয়ার সব সাগরের বুকেই নানা যুগে নানান জাতের জলদস্যুর বিচরণ ছিল এবং এখনো আছে, কিন্তু স্প্যানিশ মাইন আর ক্যারাবিয়ান সাগরের বুকে যেই উন্মত্ততা, নৃশংসতা আর চাতুর্যের নিদর্শন তারা দিয়েছিল; পরবর্তীতে তা শুধু রুপকথার কাহিনীর মতই মানুষের মনকে রঞ্জিত করেছে শত শত বছর ধরে। কখনো এর পিছনে ছিল শত্রু রাজ্যের ইন্ধন, কখনো লোভ আবার কখনো শুধুই অ্যাডভেঞ্চারের নেশায় সাগরের বুকে দাপিয়েছে তারা। পরিণামে কখনো হয়েছে জাতীয় বীর, কখনো কুখ্যাত এবং সবশেষে পেয়েছে অমরত্ব।
স্বল্প পরিসরে এমনি কয়েকজন অমর জলদস্যুর রোমাঞ্চকর কাহিনী তুলে ধরার প্রয়াস নিলাম।
স্যার হেনরি মরগ্যান(ব্লাডি মরগ্যান)
ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের অনেক বিখ্যাত সেনাপতির জন্ম দেওয়া মরগ্যান পরিবারের সন্তান 'হেনরি' ভাগ্যের সন্ধানে জাহাজে করে পাড়ি জমাল পশ্চিমে। আটলান্টিক পাড়ি দিয়ে ১৬৫৮ সালের কোন এক দিনে এসে পৌঁছায় জ্যামাইকা। শুধু এই অংশটুকুতেই ব্রিটিশ রাজার আধিপত্য, আর পোপের আদেশবলে সমগ্র পশ্চিমের বিশাল দুটি মহাদেশের প্রায় একক মালিক স্পেন(ব্রাজিলে পর্তুগাল)। স্পেনের সাথে শান্তিচুক্তি বজায় রাখায় কোন যুদ্ধেও যাওয়া সম্ভব হচ্ছিলনা এই এলাকার দখল নিয়ে। কিন্তু ব্রিটিশের বুদ্ধি বলে কথা! তাই তারা আশ্রয় নিল এক কূট চালের। দেশের অপরাধী আর ছন্নছাড়া মানুষ গুলোকে এনে জড়ো করতে লাগলো বিভিন্ন দ্বীপে আর তাদের দিয়ে করা হোল সাগরপথে হামলা চালিয়ে স্প্যানিশ নৌবানিজ্য আর আধিপত্য ক্ষুন্ন করার পাঁয়তারা।
রাজার পক্ষ হতে জাহাজ আর মাঝি মাল্লা দিয়ে সাগরের বুকে তাদের নামানো হোল স্প্যানিশ জাহাজের সাথে যুদ্ধ করার জন্য। এদের বলা হত 'প্রাইভ্যাটিয়ার'।
এই প্রাইভ্যাটিয়ারদের বেশীরভাগ ছিল আবার 'ব্যাকানিয়ার'। এই নামকরণের কারণটি বেশ মজার। দ্বীপবাসী দস্যুদের ডাকা হত এই নামে, কারণ তারা শুয়োর শিকার করে মাংস শুঁকাত 'ব্যাকান' নামক মাচার উপরে।
তো হেনরি মরগ্যান গিয়েও এই ব্যাকানিয়ারদের দলে যোগ দিল 'হিস্প্যানিওলা'(ডমিনিখ রিপাবলিক) দ্বীপে, কিন্তু সেখানে স্পেনের সেনাদের তাড়া খেয়ে চলে আসে জ্যামাইকায়। জ্যামাইকায় গিয়ে কর্তৃপক্ষের সুনজরে পড়ে প্রাইভ্যাটিয়ার হিসেবে একটি জাহাজের ক্যাপ্টেন হয়ে যায়, আর শুরু হয় তার গৌরবময় জলদস্যু অধ্যায়। আসলে রাজার ইচ্ছা ছাড়াও গভর্নরের ইন্ধনও একটা বিশাল ভূমিকা ছিল এই দস্যুপনার পিছনে কারণ রাজার ভাগের একটা বড় অংশ চলে যেত গভর্নরের পকেটে।
জন্মগত নেতৃত্বগুন আর সাহসের জন্য ক্যারাবিয়ান সাগরের ত্রাসে পরিণত হয় মরগ্যান। তার দস্যুদলের হাতে পড়ে একের পর এক স্প্যানিশ জাহাজের গন্তব্য হয় সাগরের তলদেশে। রাতারাতি প্রাইভ্যাটিয়ার দলের অ্যাডমিরাল পদে পদোন্নতি পেয়ে যায়, আর তার অধীনে যোগ হয় ১৫টি জাহাজ আর ৫০০মাল্লার এক বিশাল বহর। এরপরই শুরু হয় তার অমর হয়ে যাওয়া দুঃসাহসিক অভিযানগুলো।
১৬৬৮সালে অভিযান চালায় তৃতীয় বৃহত্তম স্প্যানিশ বন্দর নগরী 'পোর্তে বেলো' তে।
অসম্ভব সুরক্ষিত পোর্তে বেলো' তে আক্রমণের কথা কল্পনাতেও কেউ ভাবতনা। মরগ্যান অন্য দস্যুদের ডেকে বলল-
'We are sailing with the tide, I don't care what is there'
একে অন্যের মুখ চাওয়া চাওয়ি করে স্রোতের সাথে সবাই পিছু নিল তার। মূলশহরের কয়েক মাইল দূরে অবতরণ করল তার বাহিনী। রাতের আঁধারে জঙ্গলের মধ্য দিয়ে অগ্রসর হয়ে নগর দুর্গের বাহিরের পাঁচিলে মই বেয়ে উঠে গেল মরগ্যান বাহিনী। সবাই ছিল দস্যু, পূর্বের দাগী আসামী আর স্প্যানিশদের প্রতি সহজাত ঘৃণা তো ছিলই। অপ্রস্তুত অবস্থায় স্প্যানিশ বাহিনীর প্রতিটি সৈন্য নির্বিচারে মারা পড়ল তাদের হাতে।
এরপর শুরু হোল ভিতরের নগর প্রাচীরে আক্রমণ, কিন্তু বাহিরে হামলার খবর পেয়ে এই প্রাচীরের প্রহরীরা আগেই প্রস্তুত হয়ে ছিল। পরিণামে মরগ্যানের দস্যু বাহিনী প্রবল প্রতিরোধের মুখোমুখি হল। কামান আর বন্দুকের গুলির মুখে একের পর এক মরতে থাকল দস্যুরা। কিন্তু মরগ্যান তার অধীনস্থ দস্যুদের কাছে বিশাল আনুগত্য লাভ করেছিল; তার সামনে থেকে দেওয়া নেতৃত্বে কামান, গুলি উপেক্ষা করে একসময় নগর প্রাচীরের উপরে উঠতে সক্ষম হয় মরগ্যান ও তার বাহিনী। অল্পসময়ের মাঝেই জলদস্যুদের তলোয়ারে কাটা পড়ে সব স্প্যানিশ সৈন্য, মরগ্যান বাহিনী প্রবেশ করে পোর্তে বেলো শহরে।
মরগ্যানের মূল উদ্দেশ্য ছিল ধন সম্পদ লুট করা, কারণ মূল সেনা বাহিনীর সাহায্য ছাড়া শুধুমাত্র দস্যু দলের পক্ষে এই শহর দখলে রাখা সম্ভব নয়। হত্যা, ধর্ষণ, অত্যাচারের বন্যা বইয়ে দেয় দস্যুরা; শহরের প্রতিটি মুদ্রা তিলে তিলে বের করে আনে মরগ্যান। নিজের মাল্লাদের মাঝে উদার হস্তে বিলিয়ে দেয় আর জ্যামাইকার গভর্নরের কাছেও পৌঁছে দেয় রাজার জন্য বরাদ্দ অংশ। ফলশ্রুতিতে ইংরেজদের কাছে রাতারাতি বীর বনে যায় জলদস্যু মরগ্যান।
এরপর মরগ্যান লক্ষ্য করে আরও বড় কিছু, দ্বিতীয় বৃহত্তম স্প্যানিশ শহর প্রশান্ত মহাসাগরের তীরে পানামা অভিযানে। স্প্যানিশ মাইনের পশ্চিমের চিলি, পেরুর খনি হতে উত্তোলন করা সমস্ত রুপা এই বন্দরেই এসে খালাস করা হত। ৩৬টি জাহাজ আর ২০০০ ব্যাকানিয়ারকে নিয়ে শুরু করে পানামা অভিযান। দুর্গম জঙ্গল, সাপের অত্যাচার উপেক্ষা করে আটলান্টিকের তীর হতে এসে পৌঁছায় প্রশান্তের তীরে। অল্পকিছু স্প্যানিশ সেনা আর স্বেচ্ছাসেবক নগরবাসী বাঁধা দিতে নগরের বাহিরে বুহ্য তৈরি করে কিন্তু দুর্ধর্ষ জলদস্যুদের প্রবল আক্রমণে খড় কুটার মত ভেসে যায় সেই প্রতিরোধ।
বাক্যানিয়ারদের বিরুদ্ধে পানামাবাসীর প্রতিরোধ
আগের মতই নির্বিচারে গনহত্যা করা হয় কিন্তু এইবার জলদস্যুরা ভিতরে প্রবেশের আগেই বেশীরভাগ সম্পদ জাহাজে করে নিরাপদ আশ্রয়ে পাঠিয়ে দিতে সক্ষম হয় স্প্যানিশরা।
মরগ্যানের সামনে পরাজিত বন্দী
আশানুরূপ উপার্জনে ব্যর্থ হয়ে দস্যুদল মনক্ষুন্ন হয় কিন্তু মরগ্যানের বিশাল বিজয়ের কাহিনী ঠিকই ব্রিটিশ রাজদরবারে পৌঁছে যায়।
এদিকে শান্তিচুক্তিতে থাকা স্প্যানিশরা মরগ্যানের বিরুদ্ধে অভিযোগ জানালে ১৬৭০সালে তাকে গ্রেপ্তার করে ইংল্যান্ডে পাঠানো হয়, কিন্তু সেখানে তাকে কোনরূপ শাস্তির বদলে ‘নাইট’ উপাধিতে সম্মানিত করা হয় এবং একই সাথে জ্যামাইকার লেঃ গভর্নর পদে নিয়োগ দেওয়া হয়!! প্রকৃতপক্ষে মরগ্যানকে পুরস্কৃত করার মাধ্যমেই ইংরেজরা স্প্যানিশ মাইন অঞ্চলে স্প্যানিশ নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা শুরু করে আর প্রশাসনিক পদে নিয়োগ পেয়ে স্যার হেনরি মরগ্যান জলদস্যুগিরি ছাড়ান দেয়।
সামান্য দস্যুগিরি আর লুটপাটেই মরগ্যানের কার্যক্রম সীমাবদ্ধ থাকলেও, প্রকৃতপক্ষে আজকের আটলান্টিকের পশ্চিমের মানচিত্র নির্ধারণে স্যার হেনরি মরগ্যানের পরোক্ষ ভূমিকা বিশাল। দুইটি মহাসাগরের পানি তার তলোয়ারের ঝরানো রক্তে লাল হয়েছিল, তাই ব্লাডি মরগ্যান, কিং অব ব্যাকানিয়ার অথবা স্যার মরগ্যান যে নামেই হোক অমরত্ব তার প্রাপ্তি হয়ে গেছে।
চলবে......পরের পর্বে আরও কিছু অতি পরচিত জলদস্যুর কাহিনী তুলে ধরব, আশা রাখি
অট. জেনারেল হবার কারণে পোস্টটি প্রথম পাতায় যাবেনা তাই কিঞ্চিত রিপুস্টিত হইতে পারে; আগেই সবার কাছে ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি।
সর্বশেষ এডিট : ০৯ ই এপ্রিল, ২০১২ সন্ধ্যা ৭:৩০