শব্দের পোস্টমর্টেম-২১৫ (কলম)
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
Tweet
বাংলা ভাষায় সাধারণত ছয় প্রকার কলমের সন্ধান পাওয়া যায়। বাংলায় বানান একই হলেও এদের উৎস ভিন্ন। আরবি ‘কলম’ বা সংস্কৃত ‘কলম’ থেকে তৈরি কলম বলতে লেখনী বুঝায়।
যে সব গাছের বীজ হয় না বা যে সব গাছের বীজ থেকে উদ্ভূত গাছে উৎকৃষ্ট ফল পাওয়া যায় না এবং ফল পেতে অনেক দেরি হয়, সে- সব গাছের কলমাকৃতির (লেখনী কলমের মতো) শাখার কিছু অংশের ছাল ছাড়িয়ে সেখানে সারযুক্ত কাদামাটি বেঁধে অথবা আরো নানা পদ্ধতিতে যে চারা উৎপাদন করে গাছের অঙ্গজ বংশ বিস্তার ঘটানো হয় তাকে ‘কলম’ বলে। এ কলম আরবি ‘কলম’ বা হিন্দি ‘কলম’ থেকে এসেছে।
আবার অভিধান, সংবাদপত্র ইত্যাদির প্রতি পৃষ্ঠায় ছাপানো লেখার স্তম্ভাকৃতির ভাগকেও বলা হয় ‘কলম’। এটাকে কথ্য ভাষায় বলা হয় ‘কলাম’। এই ‘কলম’ বা ‘কলাম’ এসেছে ইংরেজি column থেকে।
তবে আদেশ, হুকুম, নির্দেশ, লিখিত বিধান বুঝাতে আমরা যে ‘কলম’ ব্যবহার করি, তার উৎসও আরবি। বাংলা বাগধারায় ব্যবহৃত কলমরদ করা মানে আদেশ বা সিদ্ধান্ত বাতিল করা।
আবার কলমা ধান বা শালি ধান অর্থে যে ‘কলম’ ব্যবহার করি তা এসেছে সংস্কৃত থেকে (কল্ + অম)। অন্যদিকে পলবিশিষ্ট লম্বা কাচখণ্ড বা স্ফটিক বোঝাতেও ‘কলম’ শব্দটি ব্যবহৃত হয়। এই ‘কলম’ এর উৎস ইংরেজি column (এক হাজার চারশ চলিশটা করে কাঁচের কলম চব্বিশ রঙের রামধনুকের মতো আভা দিচ্ছে - অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর)।
সংস্কৃত কলম্ব থেকেও কলম শব্দটি এসেছে। এই 'কলম' শব্দের অর্থ শরগাছ বা খাগ, শাকের ডাঁটা। এককালে শরগাছ বা খাগের মুখ সরু করে কেটে তা দিয়ে লেখা হত। এ কারণে কলম শব্দটি খুব বেশি নতুন নয়। সংস্কৃত মেদিনীকোষ, হেমকোষ, বিশ্ব, ত্রিকাণ্ড, জটাবধ ও শব্দকল্পদ্রুমে কলম শব্দের অর্থ ‘লেখনি’ হিসেবে পাওয়া যায়। তবে অমরকোষে কলম শব্দটি নেই। অমরকোষ সাতশ শতকে রচিত। এ কারণে মনে করা হয়, ‘লেখনি’ অর্থে কলম শব্দটি সংস্কৃত নয়, আরবি ‘কলম’ থেকে এসেছে। তবে নালী শাক বা ঘাসের ডাঁটা যে লেখনি, তার অনুরূপ শব্দ লাতিন, গ্রিক, আরবি ইত্যাদি ভাষায় পাওয়া যায়। অথচ প্রাচীন সংস্কৃত সাহিত্যে লেখনিবাচক 'কলম' শব্দের প্রয়োগ নেই। পরবর্তী যুগের সংস্কৃত সাহিত্যেও লেখনি অর্থে কলম শব্দটি বিরল। অথচ হিন্দি, তেলেগু, উড়িয়া ও বাংলা ভাষায় লেখনি অর্থে কলম শব্দের প্রয়োগ অনেক বেশি পরিমাণে দেখা যায়।
সংস্কৃতে কলমের প্রতিশব্দ হচ্ছে বর্ণতুলি, বর্ণমাতা, বর্ণতুলিকা, অক্ষর তুলিকা। কিন্তু মুসলমানরা ভারতবর্ষ শাসন করার কালে আদালতে ফারসি দফতরে ও ফারসি লেখাপড়ায় কলমদান, কাগজ, কলম, দোয়াত-কলম (দবাত্-কলম), কলমবন্ধ, কলমতরাশ ইত্যাদি শব্দের বহুল প্রচলনের কারণে কলমের সংস্কৃত প্রতিশব্দগুলোর জায়গায় কলম শব্দের প্রচলন হয়ে যায়। অর্থাৎ সংস্কৃতেও কলম শব্দটি গৃহীত হয়।
অভিধানকার যোগেশচন্দ্র রায় বিদ্যানিধির মতে, ‘অন্তত মেদেনীকোষের সময় হইতে কলম সংস্কৃত শব্দ।’
আবার প্রাচীন কালে বঙ্গদেশে ভালো ধানকে ‘কলম’ বলা হত। পরবর্তীকালে এ ‘কলম’ ধানই কলমা ধান নামে পরিচিতি পায়। কালিদাসের এক শ্লোকে এ ‘কলম’ বা ‘কলমা’ ধানের বর্ণনা রয়েছে। শোকটি হচ্ছে :
‘আপাদপদ্মপ্রণতাঃ কলমা ইব তে রঘুম।
ফলৈঃ সংবর্দ্ধায়ামার্সু উৎখাত প্রতিরোপিতা:'
অর্থাৎ ‘তারা (বঙ্গোরা) কলমা ধানের মত পা পর্যন্ত নুইয়ে পড়ে রঘুর প্রভুত্ব স্বীকার করল। নানা ফল দিয়ে তার পুজা করল। তারা আবার স্বস্থানে প্রতিষ্ঠিত হল’। কালিদাস তাঁর শোকের মাধ্যমে এ কলমা ধান চাষের রীতির কথাও লিখেছেন ‘উৎখাত প্রতিরোপিতা’ অর্থাৎ এক ক্ষেতে বীজ পুতে চারা গজানোর পর অন্য ক্ষেতে তা রোপন করা। ধানগাছ রোপণের এটা এদেশীয় প্রাচীন রীতি। এখনো কিছু ধান দুধকলমা, জটা কলমা নামে পরিচিত।
৬টি মন্তব্য ৬টি উত্তর
আলোচিত ব্লগ
বেফাঁস মন্তব্য করায় সমালোচনার মুখে সমন্বয়ক হাসিবুল ইসলাম !
"মেট্রোরেলে আগুন না দিলে, পুলিশ না মারলে বিপ্লব সফল হতো না "- সাম্প্রতিক সময়ে ডিবিসি নিউজে দেয়া সাক্ষাৎকারে এমন মন্তব্য করে সমালোচনার শিকার বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনের সমন্বয়ক হাসিবুল... ...বাকিটুকু পড়ুন
আমিত্ব বিসর্জন
আমি- আমি- আমি
আমিত্ব বিসর্জন দিতে চাই।
আমি বলতে তুমি; তুমি বলতে আমি।
তবুও, "আমরা" অথবা "আমাদের"
সমঅধিকার- ভালোবাসার জন্ম দেয়।
"সারভাইভাল অব দ্য ফিটেস্ট"
যেখানে লাখ লাখ শুক্রাণুকে পরাজিত করে
আমরা জীবনের দৌড়ে জন্ম... ...বাকিটুকু পড়ুন
স্বৈরাচারী আওয়ামীলীগ হঠাৎ মেহজাবীনের পিছে লাগছে কেন ?
স্বৈরচারী আওয়ামীলীগ এইবার অভিনেত্রী মেহজাবীনের পিছনে লাগছে। ৫ ই আগস্ট মেহজাবীন তার ফেসবুক স্ট্যাটাসে লিখেছিলেন ‘স্বাধীন’। সেই স্ট্যাটাসের স্ক্রিনশট যুক্ত করে অভিনেত্রীকে উদ্দেশ্য করে আওয়ামী লীগ তার অফিসিয়াল ফেইসবুকে... ...বাকিটুকু পড়ুন
বিড়াল নিয়ে হাদিস কি বলে?
সব কিছু নিয়ে হাদিস আছে।
অবশ্যই হাদিস গুলো বানোয়াট। হ্যা বানোয়াট। এক মুখ থেকে আরেক মুখে কথা গেলেই কিছুটা বদলে যায়। নবীজি মৃত্যুর ২/৩ শ বছর পর হাদিস লিখা শুরু... ...বাকিটুকু পড়ুন
শাহ সাহেবের ডায়রি ।। বকেয়া না মেটালে ৭ নভেম্বরের পর বাংলাদেশকে আর বিদ্যুৎ দেবে না আদানি গোষ্ঠী
বকেয়া বৃদ্ধি পেয়ে হয়েছে কোটি কোটি টাকা। ৭ নভেম্বরের মধ্যে তা না মেটালে বাংলাদেশকে আর বিদ্যুৎ দেবে না গৌতম আদানির গোষ্ঠী। ‘দ্য টাইম্স অফ ইন্ডিয়া’-র একটি প্রতিবেদনে এমনটাই... ...বাকিটুকু পড়ুন