অনেক বাঁধা বিঘ্ন, ঝড় ঝঞ্জা, চোখের জল ঝরিয়ে, রক্তের বন্যা বইয়ে বাংলাদেশে এসেছে নতুন স্বাধীনতা। বিগত প্রায় এক মাসকালেরও বেশি সময় ধরে, দুঃসহ সময়কাল পেরিয়ে আমরা কিছুটা সস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছি। যদিও এই স্বাধীনতার আনন্দ উপলদ্ধ হতে না হতেই শুরু হয়েছে আবার উটকো সন্ত্রাস, ডাকাতি। কিছু মানুষ যে যার স্বার্থসিদ্ধি করতে বা হীন প্রতিশোধ নিতে লিপ্ত হয়েছে দিকে দিকে হানাহানি কাটাকাটিতে। আবু সায়ীদের মৃত্যু, মুগ্ধের আত্মত্যাগ ছাড়াও যে সকল বীর সেনানী জীবন দিয়ে এই আন্দোলনকে সফল করেছেন আমরা তাদেরকে নিশ্চয় ভুলবোনা। সুন্দর একটি দূর্নীতিমুক্ত বাংলাদেশ গড়ে তুলতে পারলেই তাদের কাছে আমাদের ঋণ শোধ হবে না বটে তবে তাদের আত্মা অন্তত কিছুটা শান্তি পাবে।
আমাদের স্কুলে একাডেমিক ইয়ার শুরু হয় জুলাই থেকে। কিন্তু দেশের এই পরিস্তিতিতে এখনও স্কুল বন্ধই রয়েছে। আমাদের স্কুলের বাচ্চারা এবং টিচারেরা যে যার আবাসিক এলাকার সুন্দর নগরায়নে অংশ নিয়েছে অনেকেই। আমি অবাক হয়ে যাই এটা দেখে ফ্যান এসি ছাড়া যে সব বাচ্চারা চলতেই পারে না তারাই খটখটে রোদ্দুরে দাঁড়িয়ে ট্রাফিক সামলাচ্ছে, রাস্তা ঝাড়ু দিচ্ছে এবং দেওয়ালচিত্র আঁকছে। মুখ শুকিয়ে এতটুকু হয়ে গেছে কিন্তু তবুও যেন ক্লান্তি নেই কারো। নতুন বাংলাদেশের এই কারিগরদেরকে দেখলে হৃদয় জুড়িয়ে যায়।
অথচ কিছুদিন আগে এই হঠাৎ মৃত্যুগুলো আমাকে মানষিক বিষন্ন করে তুলেছিলো এতটাই যে আমি বসে বসে ভাবতাম এই জীবন এত অসহায় কেনো? মাথা থেকে সরাতেই পারতাম না আবু সায়ীদের পড়ে যাওয়া দৃশ্য। মুগ্ধের পানি লাগবে পানি, গাড়ি থেকে ফেলে দেওয়া জলজ্যান্ত ছেলেটাকে। নিজেকে জোর করে বুঝাতাম কি করার আছে? আবার একই সাথে এই কথাটাও ভাবতাম আমাদের কি কিছুই করার নেই? এই দুঃখভোলা প্রায় নির্ঘুম দিনগুলোতে নিজের সাথে নিজের যুদ্ধে আমি নিজেকে ব্যাস্ত রেখেছিলাম আমার কিছু দুঃখভোলা টেকনিকে। তাই অনেকদিনের ইচ্ছাটাকে পূর্নতা দিতে নিজেকে নিয়োজিত রেখেছিলাম মিনিয়েচার ওয়ার্ল্ডে। এই মিনিয়েচারের নাম "এই তো জীবন"..... এইখানে আমার হবি বা শখগুলোকেই আমি ধরে রাখতে চেয়েছিলাম একটি কাঁচের বাক্সে। মোট কথা আমার আশেপাশের আমার জগতটাকেই।
ছেলেবেলার রুপকথার গল্পের থাম্বেলিনা কিংবা লিলিপুট আমাদের শিশুমনে কতখানি দোলা লাগিয়েছিলো তা আমাদের বয়সী যারা ছেলেবেলায় সেই গল্পগুলি পড়েছে তারাই বুঝবে। এখনকার বাচ্চাদের আছে অন্যরকম মনভোলানো সব উপকরণ। জানিনা তারাও থাম্বেলিনা বা গালিভার্স ট্রাভেলের সেই লিলিপুটদের কথা ভেবে কল্পনার রাজ্যে ভেসে বেড়ায় কিনা। আমি তো আমাদের বাগানের পাতার ভাজে ভাজে খুঁজে বেড়াতাম থাম্বেলিনাকে যে কিনা ছিলো গল্পের বই এর পাতায় লেখা হাতের কড়ে আঙ্গুলের চেয়েও ছোট্ট এক রুপকথার মেয়ে। আর লিলিপুট? গালিভার'স ট্রাভেল পড়ে আমার চলে যেতে ইচ্ছে করতো ঐ সব ছোট্ট ছোট্ট মানুষগুলোর দেশে।
থাম্বেলিনা কিংবা লিলিপুটের দেখা পাইনি বটে আমার ছেলেবেলায় কিন্তু জুতোর বাক্সে হাতে কাপড় পেঁচিয়ে ছোট্ট ছোট্ট মানুষ আর ঔষধের বাক্সের খাট পালঙ্ক ফ্রিজ টিভি বানিয়ে বানিয়ে সেই সাধ কিছুটা মিটেছিলো আর কি। আর বড় হয়ে মানে বুড়িকালে এসে ইন্টারনেটের কল্যানে জানলাম এসবকেই নাকি মিনিয়েচার বলে। সুবিশাল সাগরকে ছোট্ট এক কাঁচের বাক্সে এনে সামুদ্রিক জলজ, মাছ, শামুক ঝিনুকে আমরা সাজাই একুয়ারিয়াম, ঠিক তেমনই বিশাল বাগানকে হাতের মুঠোয় এনে আমরা সাজাই টেরারিয়াম। মানে বিশাল জিনিসগুলোকে হাতের মুঠোয় এনে শিল্পীর হাতের ছোঁয়ায় এক রত্তি এক মুঠো শিল্প বানিয়ে তোলাকেই মিনিয়েচারের নানা দিক বলে।
তো আগেই বলেছি এবারের মিনিয়েচার শিল্পের পিছে প্রথম ভাবনাটাই ছিলো "এই তো জীবন"। এই নশ্বর জীবন যা এক নিমিষে যেকোনো মূহুর্তে এক ফুৎকারে নিভে যায়। প্রিয়জন কিছুদিন কাঁদে মনে রাখে আর তারপর সব স্বাভাবিক হয়ে যায়। এটাই জীবন। আর সাথে পড়ে থাকে কিছু বলা না বলা অর্থ অনর্থের কর্মকান্ডগুলো। এই যে আমি হাসি কাঁদি, রাঁধি, গান গাই, ছবি আঁকি গিটার বাজাই সে সবের আসলেই কি কোনো অর্থ আছে এই জীবনে? হয়ত আছে হয়ত নেই। যতক্ষন শ্বাস ততক্ষনই আশ। বর্তমানকালে গিটারটা নিয়ে খুব সময় কাটাই। এই জিনিসকে খুব সহজেই আয়ত্ব করা আমার জন্য অতটা সহজ নহে। সে যাই হোক প্রথমে গিটারটাকেই মিনিয়েচার বানালাম পেপার দিয়ে দিয়ে। ঠিক আমার গিটারটার রং দিয়েই বানাতে চেষ্টা করলাম। সাথে বানালাম আমার সেই আদ্দিকালের হারমোনিয়ামটাও। শুধু মাত্র একটা পারফিউমের বাক্স কেটে কেটে আর রং দিয়ে এই গিটার আর হারমোনিয়াম বানিয়েছি আমি। আরও বানিয়েছি আমার কফিমাগ, কবিতার বই আর বুকসেল্ফ। সোফা, টেবিলল্যাম্প মানে আমার আশে পাশে যা আছে সবই এত্ত টুকুন করে বানিয়ে নিলাম কাগজ কেটে কেটে।
আমার সেই প্রিয় গিটার আর হারমোনিয়াম।
আমি এই মাগে করেই রোজ লেমন টি বা গ্রীন টি খাই আর সাথে টিটেবলে থাকে এমন কোনো কবিতা বা গল্পের বই।
সোফা মিনিয়েচার। প্রাকটিস করে নিলাম। এরপরে সত্যিকারের সোফাসেটটা আমি নিজেই বানাবো।
যাইহোক এরপর আমি বারবিগুলোকে নিয়ে বসে গেলাম আবারও সেই ছোট্টবেলার মত নতুন এক পুতুল খেলার জগতে। এই জগতে নিজেও ঢুকে গেলাম। কেমন করে? সেই কথাটাই বলছি- আমার নিজের শাড়ির এক প্রান্ত কেটে বানালাম তার জন্যও এক টুকরো শাড়ি। শাড়িটাকে বেছে নিলাম ঠিক যেমনটা আমার পছন্দ সব সময়, ঝলমলে ঝিলিমিলি শাড়িটাই।
বসিয়ে দিলাম তাকে এক আরামদায়ক সোফায়, যেখানে আমার প্রিয় লাল লাল ভেলভেট কুশনগুলোও সাজানো থাকে। তার পাশে কালো হার্ডপেপার কেটে কেটে বানালাম সাইড টেবিল আর ডেস্ক ক্যালেন্ডারের পাতা কেটে বই আর মাগ। সোফার ফেব্রিকটাও কিন্তু আমাদের ফ্যামিলী লিভিং এর সোফার হুবুহু সেই ফেব্রিকটাই ছিলো। এরপর দেওয়ালে ঝুলিয়ে দিলাম সত্যিকারের ফটো কেটে কেটে ফটোফ্রেমগুলো। বুকসেল্ফ আর বইগুলো বানালাম ক্যালেন্ডারের পাতায়। বই আমার চিরকাল অনেক পছন্দের এক উপকরন। আমি ছোটবেলা থেকেই অনেক বই পড়তাম। মানে সবরকম বই পড়তাম আর বসে বসে ভাবতাম আমি কোনোদিন যদি একটুখানিও লেখক হতে পারতাম। সেই ইচ্ছা একটুখানি হলেও আমার অবশ্য পূরণ হয়েছে।
সে যাইহোক টেবিলল্যাম্প আমার আরেক প্রিয় ঘর সাজাবার উপকরন। আমার বাসা নানা রকমের ল্যাম্প দিয়ে সুসজ্জিত। তাই আমি লেস আর কাপড়ে আর কাগজে বানালাম টেবিল ল্যাম্পটাও।এরপর এন্টাসিড ট্যাবলেটের শক্ত সেলোফেন পেপার আর সাদা কাগজে বানালাম ছোট্ট মিষ্টি টেবিলক্লকটাও।
এসব বানাবার পর আমার শখের আরও কিছু প্রিয় উপকরণ বানাতে বসলাম। আমার কমলা রঙ গিটার আর কালো হারমোনিয়ামটা। সবই পেপার দিয়ে বানিয়ে সাজিয়ে দিলাম আমার চারপাশে।
এই কমলা রঙ গিটার আর কালো রঙ হারমোনিয়ামটা আমি কিন্তু ঠিক আমার সত্যিকারেরটার মতন করে পেপার দিয়ে বানিয়েছি।
এই মিনিয়েচার ডল হাউজটা আমার এই এতখানি জীবনের আমার শখ, আনন্দ আর ভালোলাগার একটা অংশের ছবি।
যা আমি ধরে রাখলাম এই ছোট্ট কাঁচের বাক্সে।
এই যে আমার কোলাজ কোলাজ ছোট্ট পুতুলঘর নানা রঙ্গে নানা ঢঙ্গে....
শুধু একটি মিনিয়েচার আর্ট পিস বানিয়েই শান্তি হলো না আমার। আর তা ছাড়াও আরও কারণ ছিলো, আমার বার্বি ডলের কালেকশন তো আর একটি নহে কাজেই বার্বি জেমিনি, বার্বি প্রিন্সেস আর বার্বি পার্পেল ফেইরী এই তিন কন্যাকে নিয়ে বানিয়ে ফেললাম থ্রী ব্লগ সিস্টারস মিনিয়েচার লিভিং রুম। একজন বৈদেশে বসবাসকারী তাই বডিকন ড্রেস আর দুজন দেশী শাড়িতেই।
তবে এর মাঝে কোনোটা কি আমি? আর আমি হলে সেটা কোনজনা গেস করোতো দেখি? আর বাকী দুজন কে কে ?
এবার বার্বি ডল ছেড়ে আমার জাপানিজ গেইসা ডলগুলোকে সুন্দর করে সাজিয়ে দিলাম তাদের মিউজিক চর্চার গ্লাসরুমটাতে...
আর সাথে আরও কিছু মিউজিকাল মিনিয়েচার ইন্সট্রুমেন্টও গ্লসি পেপারে বানিয়ে বানিয়ে সাজিয়ে দিলাম আনন্দ মনে।
আমার এই দুঃখভোলা দিনগুলোতে নিজের মত করে একটু ভালো থাকার চেষ্টা, ভুলে থাকার চেষ্টা শেয়ার করে রাখলাম আমি আমার এই প্রিয় ব্লগের পাতায়। নিজের সাথে নিজের এই ভালো থাকার চেষ্টাকে বন্দী করে রাখলাম আমি এই কাঁচের বাক্সে। আমার জানালার কাঁচে আমি মিছিল দেখেছি, আমার বারান্দার কাঁচে আমি রিক্সা করে লাশ বয়ে নিয়ে যেতে দেখেছি, যার মাথা দিয়ে গড়িয়ে পড়ছিলো তাজা রক্ত। আগুন দেখেছি, গুলি দেখেছি। চেয়ে চেয়ে দেখেছি কাঁচের বাক্সে বন্দী জীবন থেকে নির্বাক দৃষ্টিতে। হাতের মুঠোয় জগত যেমন..... কাঁচের বাক্সে বন্দী জীবন..... মনে মনে আওড়ে গেছি অনর্থক অকারণে.......
যে যেখানে আছো সবাই ভালো থেকো এই শুভকামনা রইলো সবার জন্য.......
সর্বশেষ এডিট : ১০ ই আগস্ট, ২০২৪ বিকাল ৪:৫৩