মেয়েটির নাম হৃদি আর ছেলেটির নাম হৃদয় । কি অবাক রকমের মিল , একই ব্যাচে সুমন স্যারের কোচিং এ পড়ত তারা । হৃদি প্রথম যেদিন স্যারের বাসায় এসেছিল সেদিনই নামটা শুনেই চমকে উঠেছিল হৃদয় । একটা মেয়ে নামের সাথে তার নামের এরকম মিল ! মেয়েটির দিকে তাকাতেও লজ্জা পাচ্ছিল সে । এরকম নাম রাখার জন্য মনে মনে নানা বাড়ির সবার চৌদ্দ গোষ্ঠী উদ্ধার করতে লাগল । আর অন্যান্য সহপাঠীরা তারদিকে এমন ভাবে মুচকি মুচকি হাসছিল যে নতুন লজ্জা লজ্জা বর-বধুকে বন্ধুরা নানাভাবে অপদস্থ করেও এভাবে হাসে না ।
বন্ধু- বান্ধবীর অনেকেই সদ্যকৈশোর এ প্রেম-ভালবাসাবাসি নিয়ে ব্যাস্ত। প্রেম-ভালবাসা মানে সময় নষ্ট, মোটামুটি এরকম জীবন দর্শন ই লালন করে হৃদয় । ভারী কাঁচের মোটা চশমা দিয়ে বিভিন্ন মোটামোটা বই পড়ে । উপন্যাসের যুগলগুলোর প্রেম-প্রেম বেহায়াপনা পড়তে ভালই লাগে কিন্তু নিজেকে ফুলটাইম নায়ক কল্পনা করলেও নায়িকার জন্য পার্টটাইম একেকবার একেকজনকে কল্পনা করে বই পড়া শেষ করতে হয় তার । আজ এ নতুন আসা মেয়েটাকে মনে ধরে যায় , মনে হয় যেন তার পাজরের হাড়েই গড়া দুষ্টু দুষ্টু মেয়েটা । মেয়েটাও তারমত লুকিয়ে লুকিয়ে তাকাচ্ছে তার দিকে । তবে ফালতু ভালবাসাবাসি করে সময় নষ্ট করার লোক নয় সে , তাই আগে যেয়ে কথা বলার তার কোন ইচ্ছাই নেই ।
মাঝে মাঝে দেখা হয় , চোখাচোখি হয় কিন্তু কথা হয় না । হৃদির পুলিশ অফিসার বাবা তাদের পাশাপাশিই বাসা ভাড়া নিয়েছেন । মা প্রতিদিন এসে দেমাগী মেয়েটার এতো এতো প্রশংসা করে যা মেয়েটার প্রতি মেজাজ আরো আরো খারাপ করে দেয় । হৃদি একটু চেষ্টা করলেও হৃদয়ের তাচ্ছিল্যের কারনে ভালবাসা তো দূরে থাক একটা ভাল বন্ধুত্বও গড়ে উঠেনা । জলের মধ্যে আকাশ আর চাঁদ-তারা যেমন কাছাকাছি মনে হয় ঠিক তেমনই কাছাকাছি থাকলেও তারা ঠিকই কিন্তু যোজন যোজন দূরেই পড়ে থাকে । বার্ষিক পরীক্ষায় ছেলে মেয়েদের সম্মিলিত ফলাফলে হৃদয় প্রথম আর হৃদি দ্বিতীয় হয়ে তাদের মাঝে প্রতিযোগীতা আরো বাড়তে থাকে ।
১৯৯৮ সালের জানুয়ারি মাস । রোমান্টিক ছবি হিসেবে টাইটানিক নিয়ে ব্যপক হই চই চলছে । একদিন বন্ধুরা সবাই মিলে একসাথে দেখেও ফেলে ছবিটা । ছবির নায়িকা রোজ অনেকটা হৃদি-হৃদি চেহারা । রোজের স্থলে বাস্তব জীবনের কাউকে দাড় করাতে গেলে সে বদমাশ মেয়েটার কথাই মনে পড়ে । অসহ্য , পড়া বাদ দিয়ে খালি তার কথাই মনে আসে । দিন যায় জগতের স্বাভাবিক নিয়মে বৈরিতা কেটে তাদের মাঝে একটু একটু করে বন্ধুত্বও হয় । কয়েকদিন ধরে প্রবল বর্ষনে মাঠ-ঘাঠ প্লাবিত হয়ে আছে । সেদিন সকালে নির্মল আকাশ থেকে মায়া মায়া রোদের ছোঁয়া পেয়ে সবাই হাফ ছেড়ে স্কুলে যায় , টিফিনের আগেই গুরু গুরু গর্জন আর ঘন কালো মেঘে ছেয়ে আসে আকাশ । কিছুক্ষনের মধ্যেই সো সো বাতাস আর নিস্তব্দ প্রকৃতি, বড় ধরনের ঝড় হওয়ার পূর্বাভাস । স্কুল ছুটি দেওয়া হয় ।
একেই বলে নিয়তি । হৃদি ছাতা আনেনি তাই মন খারাপ করে স্কুলের বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে । বৃষ্টি পড়া শুরু করেছে , ক্ষনে ক্ষনে আরো বাড়ছে । বাদলা হাওয়ার এ বাদল দিনে স্কুল ছুটি দিয়েছে তাই হৃদয়ের মেজাজ খুব ফুরফুরে আর খুশি-খুশি । হৃদিকে স্কুলের বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ,
- কি রে বাড়িত যাবিনা ?
- না , ছাতা আনিনাই । বৃষ্টি কমলে যাব ।
- বৃষ্টি তো কমবে বলে মনে হয় না , উলটো বড় ধরনের ঝড় আসতে পারে । তুই আমার সাথে চল ।
বিধাতার এ কোন খেলা ? এরকম একটা দুর্যোগ দিয়ে দুজন দুছাতার তলের মানুষকে এক করে পাশাপাশি এক ছাতার নিচে নিয়ে এসেছে !
-এই ভিজে যাচ্ছিস , ভিজে গেলে জ্বর করবে তো । আরেকটু কাছে আয় ।
বৃষ্টি মনেহয় তাদের দুজনকে আর একটু কাছে নিয়ে আসার জন্য আরো জোর বেগে পড়তে শুরু করল । কাছে আসায় দুজনের শরীরের স্পর্শ এ শীতল আবহাওয়ায় তাদের শরীরের তাপ আদান-প্রদান করছিল । এর সাথে চুপটি করে কখন যে মনের উষ্ণতাও লেনা-দেনা হয়ে গেল তা বোধহয় কেউ জানতেই পারেনি ।
ভয়াবহ বন্যা দেখা দিল সেবার । স্কুল বন্ধ , সারাদিন বাসায় বন্দি সবাই । কোথাও যাওয়ার তেমন একটা সুযোগ নাই । নিতান্ত প্রয়োজন ছাড়া কেউ বাহির হয় না । ঘুরে ফিরে তাই হৃদির সাথেই আড্ডা । মেয়েটা যে এত মিশুক , এত সুন্দর আগে কেন যে বুঝতে পারেনি এজন্য বড় আফসুস হৃদয়ের । কিভাবে যে ভালো লেগে যায় হলুদ সুন্দর মেয়েটাকে ! চোখে চোখে কথা হয় কিন্তু মুখ ফুটে বলা হয় না । একদিন হৃদয় অংকের নোট খাতা হাওলাত দেওয়ার সময় খাতার ভিতর রক্তগোলাপ আর নীল কার্ড কিনে লিখে দিল, “আমি তোমাকে ভালবাসি হৃদি , প্লিজ ফিরিয়ে দিও না । জবাবের অপেক্ষায় থাকলাম । ” কয়েকদিন পর সে খাতা ফেরত দিল । খাতার প্রতিটা পৃষ্ঠা তন্ন তন্ন করে খুজেও হৃদির কোন উত্তর পেল না , পেলনা তার দেওয়া নীল কার্ড আর রক্ত গোলাপ ও । হৃদির মনোভাব বুঝতে পেরে হতাশ হয়ে ঘুমাতে গেল সে ।
এভাবে বানের জলের সাথে ভালোবাসাও ভেসে গেল । কয়দিন পর হৃদির বাবা বদলী হয়ে অন্য শহরে চলে গেলে তাদের মাঝে আর কোন যোগাযোগ ই থাকল না । হৃদয় মান করেই আর কোন রকম যোগাযোগ রাখেনি । কারো জন্য কারো জীবন প্রবাহ থেমে থাকে না , আপন গতিতেই এগিয়ে যায় । প্রথম কয়েকদিন মনমরা থেকে , “কেন দূরে থাক...” টাইপের গান শুনত আর কেঁদে কেটে বালিশ ভিজাত । তারপর আবার প্রাত্যহিক কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ল হৃদয় ।
প্রতিদিন ভোরবেলা ঘুম থেকে উঠার মত একঘেয়ে জীবন নিয়ে দুটি ধারা তাদের অতীতকে ভুলে নিজ নিজ পথে ভালোই বয়ে যাচ্ছিল । একদিন হঠৎ করেই কমলাপুর স্টেশনে এ তাদের আবার দেখা হয়ে গেল । আরো সুন্দর আর পরিনত হয়েছে হৃদি । ওর সাথে ছোট্ট একটা বাবু ।
- কেমন আছো হৃদয় ?
- ভালো । আপনি হৃদি না ? এটা আপনার বেবি, অনেকটা আপনার মতই হয়েছে !
- মানে ! আপনি বলছ কেন ? আমিতো বিয়েই করিনি , ও আমার বড় আপুর মেয়ে সিনথিয়া । আপু টিকেট কাটতে গেছে ।
-আচ্ছা তোমরা ভালো থেকো , আসি ।
- আসবে মানে ? আমি তোমাকে কত খুঁজেছি । ভার্সিটিতে ভর্তি হবার পর তোমাদের বাসাতে গেছি । তোমরা অনেক আগেই সে বাসা ছেড়ে অন্য ডিস্ট্রিকে চলে গেছ বলে আর খুঁজে বের করতে পারিনি । তুমি কেন যোগাযোগ রাখনি ? আমি আমার মনের কথা বলতে পারিনি বলে এতদিন কত অশান্তিতে থেকেছি , কত কষ্ট পেয়েছি , কত কেঁদেছি ।
- বাদ দাও তো । তুমি অনেক সুন্দর আর স্মার্ট হয়ে গেছ । শুধু চেয়ে থাকতে ইচ্ছে করছে ।
হৃদি হাসল । হাসলে টোল পড়ে হৃদিকে আরো ভালো লাগে । এর পর থেকে তাদের মাঝে প্রতিদিন ফোনে কথা হয় আর প্রায়ই দেখা হয় । হৃদির ভালোবাসা দেখে চোখে পানি এসে যায় হৃদয়ের । সেই ফুল আর নীল খাম এত বছর ধরে সযত্নে আগলে রেখেছে সে , ফুল শুকিয়ে গেলেও ভালোবাসা শুকোয় নি । হৃদয় কিন্তু এর মাঝে এক হালির মত প্রেম করেছে । কিছু কিছু কথা গোপন থাকলে জগতটা অনেক সুন্দর থাকে । হৃদয়ের এ গোপন অধ্যয়টাও গোপন থাকুক হৃদির কাছে । সুখে থাকুক তারা ।