ছেলেবেলা কিংবা শৈশব সবারই সোনালী সময় । তখন ভাবতাম ধুর বড় হই না ক্যান ? বড় হইলে একা একা ঘুরতে পারব , বড় মানে স্বাধীন হওয়া , বড় হওয়া মানে মন যা চায় তাই করা ইত্যাদি ইত্যাদি । এককথায় সে সময় আমার চিন্তা ভাবনা একেবারে শিশুদের মতই ছিল । আজ সে সময়ের কিছু চিন্তা-ভাবনা , বিশ্বাস আর ভুল ধারনা নিয়ে লিখছি । কারো সাথে মিলে গেলে কপিরাইট আইনে মামলা করা হবে ।
আমার কয়দিন পরে পরেই জামা ছোট হয়ে যেত । নতুন জামা কিনতে হত । মনে মনে খুব কষ্ট পাইতাম । ক্যান ক্যান ক্যান আমার জামা এত তাড়াতাড়ি ছোট হয়ে যায় ? আমি কি জামারে কম আদর-যত্ন (ময়লা) করি

আমার মনে হত বড় হলে আমি একদিন ঠিক পাখির মত হাত মেলে আকাশে ঊড়তে পারব । তাই শোকেস , ওয়ার্ড্রোব এটা সেটার উপর থেকে ঝাপ দিয়ে ট্রেনিং নিতাম । ফলস্বরূপ হয় ব্যাথা পেয়ে কাঁদতাম নয় কোনকিছু ভাঙ্গার দায়ে আম্মুর বকুনি খেতাম


চাঁদ ক্যামনে সবার মামা হয় দিস্তা দিস্তা কাগজ খরচ করে বছর বছর ধরে গবেষনা করেও বাহির কর্তে পারিনাই । এখনো নিরলস গবেষনা করে যাইতেছি , দেখি কোন সমাধানে আসা যায় কিনা ।
ছোটবেলায় জানতাম যে চাঁদের দেশে জুজুবুড়ি নামক এক বুড়ি থাকে । সে সবসময় বসে বসে সুতা কাটে । তারে নিয়া আমার খুব চিন্তা হইত । বুড়ি থাকে কই খায় কই , সবচেয়ে বড় কথা সুতাগুলো যায় কই

মানুষ যখন হাঁটে তার সাথে সাথে চাঁদও কিন্তু হাঁটে , মানুষ দৌড়ালে চাঁদও দৌড়ায় । শ্লার চাঁদের সাথে পাল্লা দিয়ে কত যে দৌড়িয়েছি । ক্লান্ত হয়ে যেতাম মাগার চাঁদ ক্লান্ত হইত না । আফসুস বড় আফসুস ।
ছোটবেলাতে দাঁত ফেলার আগে যে ভয় কাজ করত দাঁত ফেলে দেওয়ার পর ব্যপক ব্যাস্ততা লেগে যেত আমাদের কচি-কাচার মহলে । সবাই মিলে ইঁদুরের গর্ত খোঁজ কর । গর্তে দাঁত দিলে তবেই না তার বিনিময়ে নতুন চকচকে দাঁত উঠবে । আর গর্তে দাঁত না দিতে পারলে এবড়ো থেবড়ো মোটা দাঁত উঠবে । অনেক খোঁজাখুঁজি করে কোন গর্ত না পাওয়া গেলে , ইঁদুরকে খুব অনুনয়-বিনুনয় করে দাঁত নিয়ে যেতে বলে দাঁত ছুড়ে ফেলা হত ।
বড়দের কাছে শুনেছি কোন ফলের বিচি খেয়ে ফেললে পেটের ভিতর গাছ হবে আর এ গাছ মুখ দিয়ে ডালপালাসহ বের হয়ে আসবে । আরো ভয়াবহ শুনেছি যে নিজেই গাছ হয়ে যাব । কুল (বড়ই) , জাম , কলা খাবার সময় ভুল করে বিচি খেয়ে কত যে ভয়ে ভয়ে থেকেছি ! না জানি সকালে ঘুম থেকে উঠে বিরাট বটগাছ টাইপের কিছু একটা হয়ে গেছি

আম্মু আমাদের জোড়া কলা (ফল) , ডিম খেতে দিত না । জোড়া কিছু খেলে নাকি জোড়া বাচ্চা হবে । এ নিয়ে আমি তত চিন্তিত ছিলাম না , কারন লোডটা আমার উপর দিয়া যাবে না । আমার কাছে একটা যা জোড়াও তা হালিও একই । সব বউয়ের উপর দিয়া যাবে


বই খোলা রেখে কোথাও চলে গেলে চুপিচুপি শয়তান এসে বই পড়ে ফেলে । অনেক চেষ্টার পরও সে পড়া মনে থাকে না । আগে বুঝিনাই , পড়ালেখা না পারলে এটাও একটা অযুহাত হইতে পারত , “শয়তান পড়ে ফেলছে তাই পড়া মনে নাই” ।
কথা বলার সময় কিংবা খাবার খাওয়ার সময় জিহ্বাতে কামড় লাগলে বুঝতে হবে কেউ মনে করছে । চলাচলের সময় উষ্ঠা খেলে কিংবা খাওয়ার সময় নাকে মুখে ভাত উঠলে বুঝতে হবে যে কেউ আমার কথা বলছে । আহারে আমার কতা কি কেউ মনে করে না


পরীক্ষার আগে ডিম খেলে নাকি পরীক্ষাতে ইয়া বড় বড় রসগোল্লা মতান্তরে ডিম পাব বলা হত । এটা খানিকটা বিশ্বাস করতাম । এখন আর করিনা ।
কোন কথা বলার পরে সাথে সাথে যদি টিকটিকি টিক টিক করে ডেকে উঠে ,তারমানে বুঝতে হবে কথাটা সত্য বলেছি । আহা ! এভাবে কত সত্য গোপন করা কথা টাইমিংয়ে মিলে গিয়ে সত্য হয়ে গেছে তার ইয়ত্তা নেই । থ্যাংকু টিকটিকি

ডান হাত চুলকালে নাকি হাতে অনেক টাকা আসবে আর ডান পা চুলকালে স্কুল বন্ধ কোথাও বেড়াতে যাব । কিন্তু বাম হাত আর বাম পা চুলকালে অসুখ-বিসুখ হবে , তারজন্য ইস্কুল ছুটি ।
স্বপ্নে সাপ দেখলে শত্রু বাড়ে , সাপের দৌড়ানী খেলে আসন্ন বিপদ আর সাপ মেরে ফেললে শত্রু খতম । স্বপ্নে অনেকবার সাপের দৌড়ানী খেয়েছি । এবার আমি তক্কে তক্কে আছি । স্বপ্নে সাপ দেখলেই উলটা দৌড়ানী দিমু । দশদিন চোরের হইলেও একদিন কিন্তু গৃহস্থেরই হয়

কুকুর কামড়ালে পেটে বেবি কুকুর হবে । নাভিতে ইনজেকশন দিয়া সেটাকে মরতে হয় । তাই ছোট বেলা থেকেই কুকুর ভয় পেতাম । তবে এখন দেশে উল্টোটা হচ্ছে বলে কুকুর সমাজ বড়ই চিন্তিত ।
সকালে স্কুলে যাওয়ার পর টিচারদের স্কুলে দেখতাম । সকালের শিফট ক্লাস করে চলে আসার পরও দেখতাম , কখনো স্কুলে থেকে খেলাধুলা করার সময়ও টিচারদের স্কুলে পড়াতে দেখতাম । আমার ধারনা হয়েছিল যে স্কুলই টিচারদের ঘর-বাড়ি । একবার আব্বুর সাথে বাজারে যাওয়ার পর আমাদের এক স্কুল শিক্ষককে বাজারে দেখে আমি অবাক । আরে স্যার বাজারে আসল ক্যম্নে

মনে করতাম বাংলাকে জাস্ট ইংলিশ হরফ দিয়ে পালটিয়ে দিলেই ইংরেজি ভাষা হয়ে যাবে । সব ভাষার হাসি-কান্নার একই রকম নাকি ভিন্ন রকম এ নিয়ে আমি ব্যপক চিন্তিত ছিলাম

সিনেমাতে ঘটে যাওয়া কাহিনী সত্যি মনে করতাম । এবং যেকোন বিচ্ছেদে খুব কষ্ট পেতাম । খুশিতে খুশি হতাম । গানের সময় কে বাজনা বাজাত সেটা ছিল ব্যপক বিস্ময় । নিজের ভাঙ্গা গলায় মাঝে মাঝে গান গাইতাম কিন্তু কোনদিক হতে কোন বাদ্য বাজত না । দুঃখ পাইতাম নিজেরে সান্ত্বনা দিতাম , বড় হও সুন্দরভাবে গাইতে পার, তারপরেই না বাদ্য বাজবে

খবর দেখার সময় চুপচাপ থাকতাম । ব্যাটা যেভাবে তাকায়া থেকে খবর পড়ত মনে করতাম আমারেও চোখেচোখে রাখতাছে । চোখ গরম করে আছে , দুষ্টামি করলে ধমক দিবে

মাঝে মাঝে মনে করতাম টেলিভিশনের দেখা সবকিছু নিশ্চই টিভির ভেতর থাকে । কারেন্টের মাধ্যমে তারা আসে আবার কারেন্টের মাধ্যমে যায় । কারেন্ট নিয়া খুব ইন্টারেস্টেড ছিলাম । তবে দুই একবার ছেছা খাইয়া (শক খেয়ে ) সেদিকে আর পা মাড়াই নি

রূপকথার রাজকুমার-রাজকুমারীর গল্প সত্য বলেই মনে করতাম । কার্টুনরাও আমাদের মতই মানুষ মনে করতাম । ভাবতাম রুপকথার দেশে তাদের বাস ।
বড় বড় পুকুরের পানির তলায় সোনার পাতিল আছে , সে পাতিলগুলো সাপ আর দৈত্যরা পাহাড়া দিয়ে রাখে । দৈত্যদের প্রানভোমরা সেখানে থাকে । পুকুরের আশেপাশে একলা পাইলেই শিকল মেরে টাইন্যা পানির নিচে নিয়া যায়গা । তাই বড় পুকুরের আসেপাশে একলা যেতাম না ।
রাত্রিবেলা বাঁশি বাজালে নাকি সাপ আসে । তাই আমরা বাঁশি বাজাতাম না । কিন্তু পহেলা বৈশাখের মেলা থেকে কিনে আনা বাঁশির জন্য কোন মানা কাজ করত না । ছবিতে নাগ নাগিনীর রুমান্স দেইখ্যা আমিও কয়েকদিন ভাবছিলাম আমার একটা নাগিন দরকার :!> ।
অনেকে নাকি ব্যাঙের মুখের মানিক পেয়েছে , আমরা ব্যাঙ শিকারে বের হতাম । কিন্তু কোন ব্যঙ্গের মুখেই মানিক পাই নি । সাপের পা দেখলে সাত রাজার ধন পাওয়া যায় এমন একটা কথাও প্রচলিত ছিল । রিস্কি বলে আমরা সাপ ধরতে যেতাম না । তবে বীন বাজিয়ে সাপ আনার ইচ্ছা বহুদিনের । সাপের ঠ্যাং দেক্তে মঞ্চায় ।
আমরা মনে করতাম আনারস আর দুধ একসাথে খেলে মানুষ মারা যায় । কিন্তু বোকাসোকা দেখে কয়েকজনের উপর পরীক্ষা করে আমরা সিদ্ধান্তে এসেছিলাম যে এ ধারনা ভুল


সবচেয়ে বড় যেটা ছিল , আমি বিশ্বাস করতাম যে ছোটবেলায় যা ভাবছি যা দেখছি বড় হলেও তার একটুকুও পরিবর্তন হবে না । সব বিশ্বাস আগের মতই থেকে যাবে ।
কত স্বপ্নময় মজার আর অদ্ভুত ছিল ছোট্ট বেলার জীবনটা । ওফ আবার যদি ছোট্টটি হতে পারতাম !