বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০১৩ (আজ)
বিকাল ৪.০০ টায়
ইভেন্ট লিঙ্কঃ আমি শহীদ নই, মৃত লাশ, আমি মানুষ নই, শ্রমিক
মাথায় লাল কাপড়ের ফিতা বাঁধা একদল তরুণ আর ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা কংক্রিটের খণ্ডের ওপর অতি সাবধানে পা ফেলে ফেলে ওঠা-নামা করছেন ধ্বংসস্তূপ বেয়ে। ফাঁকফোকর দিয়ে কেউ হাত, কেউ মাথা বা শরীরের অর্ধেকটা গলিয়ে দিয়েছেন। চেষ্টা করছেন দেখার। ভেতর থেকে ভেসে আসছে আর্তনাদ। আসছে করুণ আকুতি, ‘ভাই, আমারে বাইর করেন।’
...... ‘সকাল সাড়ে আটটার দিকে নাশতা খায়া আমরা দুইজনেই বাইর হইছি। পৌনে নয়টার মধ্যেই খবর আইসে রানা প্লাজা ভাইঙ্গা পড়ছে। আমার অফিস ঠিক রানা প্লাজার উল্টা দিকে। আঙ্গুরাকে বলছিলাম, ফাটল সিরিয়াস হইলে যাইও না। কইসিল ফাটল সিরিয়াস হইলে আইসা পড়ব’—পোশাকশ্রমিক আঙ্গুরা বানুর স্বামী আবদুল হান্নানের আর্তনাদ।
...... বছর খানেক আগে বিয়ে হয়েছে আহমদ মোল্লার কুলসুম বেগমের সঙ্গে। কুলসুম কাজ করেন মেশিন অপারেটর হিসেবে, পাঁচ তলায়। ‘সকালে দুই জন এক লগে কামে আইছি। আমি ছয় তলায় কাপড় কাটতেছি। পায়ের তলায় মনে হইলো মাইঝা (মেঝে) কাঁইপ্যা উঠল। হ্যার লগে লগেই ধপাস কইরা পইড়া গেল'... দুর্ঘটনার ঘণ্টা খানেকের মধ্যেই জানালার ফাঁক দিয়ে আহমদ বেরিয়ে এসেছেন। বেলা তখন প্রায় দুইটা। স্ত্রী কুলসুমের কোনো খোঁজ নেই। আহমদের বুক ভেসে যাচ্ছে চোখের পানিতে।
...... এগুলো কিছু অসহায় গরীব মানুষের গল্প। সোনার চামচ মুখে নিয়ে এরা জন্মায়নি। ভাগ্যের চাকা বদলের তাড়নায় এরা কাজ করতো সাভারের রানা প্লাজার গার্মেন্টসে। ইট সিমেন্টের বেষ্টনীর মাঝে আবেগ বাস্তবতার নিত্যনৈমিত্তিক খেলায় দিন পরিবর্তনের স্বপ্নের বীজ বুনতো তারা। কিন্তু ভাগ্যের কি নির্মম পরিহাস, সব সাধ-আহ্লাদ-স্বপ্ন আজ চাপা পড়ে গিয়েছে সেই ইট-সিমেন্টের ধ্বংসস্তুপের নিচে।
আমরা জেনেছি পাঁচটি পোশাক কারখানার মালিকেরা পরশুই ভবনে ফাটলের কথা জানিয়েছিলেন বিজিএমইএকে। বিজিএমইএ এ পরিপ্রেক্ষিতে কর্মকর্তাদের একটি দল পাঠিয়ে ভবন পরীক্ষা করায়। তারা বলেন, বুয়েটের বিশেষজ্ঞ প্রকৌশলীদের দিয়ে ভবন পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর কারখানা চালু করা যাবে। কিন্তু তাতে কাজ হয়নি। কারখানার মালিকেরা ভবন-মালিকের পরামর্শ অনুসারে কারখানা চালু রাখেন।
কে এই ভবন মালিক ? সোহেল রানা। আগের দিন সে শ্রমিকদের বলেছিল, ফাটল-টাটল কিছু না। প্লাস্টার খসছে, বিল্ডিংয়ের কিছু হবে না। সাংবাদিকদের বলেছিল, শ্রমিকেরা শুধু শুধু আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে কারখানা থেকে বের হয়ে যান। ভবন ধসে পড়ার মতো অবস্থা সৃষ্টি হয়নি।
কি তার রাজনৈতিক পরিচয়, সেটা আমজনতার কাছে মুখ্য বিষয় না। বিজিএমইর পরামর্শকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে এই সোহেল রানাই প্ররোচিত করেছিল গার্মেন্টস মালিকদের গার্মেন্টস খোলা রাখতে। কোন অবস্থাতেই এটা দুর্ঘটনা হতে পারেনা, এটি ঠাণ্ডা মাথার হত্যাযজ্ঞ এবং সোহেল রানা এর মূল হোতা। আমরা এই নরাধমের শাস্তি চাই, সর্বোচ্চ শাস্তি।
আমরা ভুলি নাই তাজরীন গার্মেন্টস, ভুলি নাই সেই ১১৪ টি লাশ, আমরা সকল গার্মেন্ট ফ্যাক্টরির নিরাপত্তার নিশ্চয়তা চাই। দায়মুক্তির সেই প্রহসন আর দেখতে চাইনা। বিদেশি মুদ্রার সূতিকাগার এই রাষ্ট্রযন্ত্রকে বাঁচাতে হবে যে কোন মূল্যে, সর্বাগ্রে।
আর পোড়া মাংসের গন্ধ বোটকা গন্ধ পেতে চাইনা আমরা; মেহেদী রাঙ্গা হাত, নূপুর পড়া পা, যে কপাল থেকে টিপটা খুলে পড়ে গিয়েছে সে ফাটা কপালের জীবন্ত লাশ দেখতে চাইনা। আর না।