কৃষক শমসের আলি। কুষ্টিয়া জেলার ভেড়ামারা থানার খেমিড়দিয়া গ্রামে বাড়ি। ৫০বিঘার মত তার আবাদি জমি। বছরে যা ধান পান তা নিজের পরিবারের চাহিদা মিটিয়ে বাজারে বিক্রি করেন। এভাবেই যায় প্রতিবছর। এবার শমসের আলির মন খারাপ। ধান উৎপাদন করতে যে টাকা খরচ হয়েছে, ধান বিক্রি করে আসল টাকাও উঠবে না তার, লোকসান হবে। বাজারে সার, কীটনাশক, চাষ, সেচ, শ্রম ইত্যাদির হিসেব মিলিয়ে দেখা যায় বর্তমানে বোরো ফলনে কৃষক তার উৎপাদিত পণ্যে বাজারের নির্ধারিত মূল্যে লোকসানের মুখোমুখি হচ্ছে। এবার শমসের আলি ঠিক করেছেন, জমিতে তিনি তামাকের চাষ করবেন। শমসের আলি একা নন, তার মত আরও অনেকেই আছেন যারা জমিতে তামাক চাষ শুরু করে দিয়েছেন। কুষ্টিয়ার কৃষি বিভাগসূত্রে জানা যায়, ২০০৫ সালে নাগাদ প্রতিবছর ২০ হাজার হেক্টরের উপরে তামাক চাষ হয়েছে তার প্রধান কারণ উৎপাদিত খাদ্যশস্যের ন্যায্যমূল্য না পাওয়া। ২০০৭-০৮ সালে তামাক চাষ হ্রাস পেয়ে দাঁড়ায় ১৪ হাজার হেক্টরে। ২০০৯ সালে আবার বেড়ে গিয়ে ২৫ হাজার হেক্টরে দাঁড়ায়। ধান চাষের চেয়ে তামাক চাষে বিভিন্ন সুযোগের কথা জানালেন কুষ্টিয়ার কৃষকেরা। তামাক চাষের জন্য তামাকজাত দ্রব্য উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান থেকে বিনা শর্তে ঋণ পায়, বাজারে সার সংকট থাকলেও তারা প্রয়োজনীয় সারের যোগান পায়, মাঠে পোকার আক্রমণ হলে তার জন্য তারা যথাযথ ব্যবস্থা নেয়, তামাক বিক্রির নিশ্চয়তাসহ অধিক মূল্য পায় তামাকজাত দ্রব্য উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে। ধান উৎপাদনে এমন কোন নিশ্চয়তা কৃষকরা পাচ্ছে না বরং উৎপাদন খরচের চেয়ে আরও কমদামে তাদের বিক্রি করতে হচ্ছে। গত আমন মৌসুমে প্রতিমণ ধান উৎপাদন খরচ ৫০০-৫৫০ টাকা হলেও তা বর্তমানে বিক্রি করতে হচ্ছে ৫০০ টাকারও কমে।
দেশে মোট ধানী জমির শতকরা ৪১ ভাগ জমিতে বোরোধান চাষ হয়। ধান উৎপাদন হয় ৫৬ ভাগ। চলতি বছর ৪৬ লাখ ৭৫ হাজার হেক্টর জমিতে বোরোধান চাষ করা হচ্ছে। উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ১ কোটি ৯৩ লাখ ৩৮ হাজার ৭শ ৫০ মেট্টিকটন। গত বছর উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১ কোটি ৭০ লাখ মেট্টিকটন। বৈদ্যুতিক সমস্যার কারণে সেচ সংকটে দেশের কোথাও কোথাও উৎপাদ হ্রাস পেলেও কাক্সিক্ষত লক্ষ্য ছোঁয়া যাবে বলে আশা করা হচ্ছে।
বগুড়া জেলার শেরপুর থানার দারুগ্রাম থেকে খন্দকার মোঃ আব্দুর রউফ হেলাল ধান উৎপাদনের একটি বাস্তবচিত্র আমাদের কাছে তুলে ধরেন। তিনি একজন বর্গা চাষি। তার হিসেব মতে, ১বিঘা (৩৩ শতক) জমির ইরি ধান আবাদের হিসেব- কন্দা কাটা, গোবর সার কেনা, বীজ কেনা, বীজতলা তৈরি এবং বীজ উৎপাদন, হাল চাষ পাওয়ার টিলার দ্বারা, সার প্রয়োগ, কীটনাশক ব্যবহার, সেচের দাম, মেশিনে ধান মাড়াই, ইরি আবাদের জন্য জমি লীজ, ধান বিক্রির জন্য ভ্যান ভাড়া দিয়ে মোট লাগে ৮৮৬০টাকা। প্রতি বিঘায় গড়ে ধান উৎপাদন হয় ১৭ মণ। বর্তমান বাজার ঠিক থাকলে নতুন ধানের সর্বোচ্চ বাজার হবে ৩৫০ টাকা অর্থাৎ, ১৭ x৩৫০=৫৯৫০ টাকা। খরচ = (৮৮৬০-৫৯৫০) =২৯১০ লোকসান।
এ চিত্র শুধু বগুড়ার আব্দুল রউফে হেলালের নয়, সমগ্র বাংলাদেশের চিত্র। শুধু ধান নয়, গম উৎপাদন করেও কৃষক পড়েছে লোকসানের মুখে। নড়াইলের কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের সূত্রে জানা যায়, চলতি বছরে জেলায় তিন হাজার ২১৯ হেক্টর জমিতে গম চাষ হয়েছে। ফলন হয়েছে আশাতীত। তারপরও কৃষকের গুনতে হচ্ছে লোকসান। কালনা গ্রামের কৃষক আব্দুল রশিদের কাছে গমের দাম পাচ্ছে কেমন জানতে চাইলে তিনি জানান, মজুরি, জ্বালানি তেল, সেচ, সার কীটনাশক বাবদ উৎপাদিত প্রতিমণ গমে খরচ পড়েছে ৬২০ থেকে ৬৩০ টাকা। কিন্তু বিক্রি করতে হচ্ছে ৫৪০ টাকা থেকে ৫৫০ টাকা। তিনি আগামী মৌসুমে আর গমের চাষ করবেন না।
কৃষক যে ফসল উৎপাদনে লাভ পাবে সে ফসলই চাষ করবে। ধানের দাম কম হলে কৃষক ধান উৎপাদনের পরিবর্তে অন্য ফসলের দিকে ঝুঁকবে। কৃষকরা এখন আর আগের মত পাটের আবাদ করছে না। কারণ একটাই, উৎপাদিত পণ্যে ন্যায্যমূল্য তারা পাচ্ছে না। পাটের মত যদি ন্যায্যমূল্যের অভাবে দেশের কৃষকরা অন্য ফসলের দিকে ঝোঁকে তাহলে আমাদের খাদ্য সংকট আরও বেড়ে যাবে। এ ক্ষেত্রে সরকারকে কৃষকদের পাশে দাঁড়াতে হবে। পাশাপাশি কমাতে হবে কৃষি, পোল্ট্রি, মৎস্য, পশুসম্পদ, ইত্যাদির উপকরণের দাম। উচ্চফলনশীল জাতের ধান চাষ বাধ্যতামূলক করতে হবে এবং সেই সাথে দেশীয় জাতসমূহ গবেষণা প্রতিষ্ঠান কর্তৃক সংরক্ষিত জার্মপ্লাজম হিসেবে সংরক্ষণ করতে হবে। এক্ষেত্রে ধান বীজের নিশ্চয়তা প্রদানের জন্য সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে বীজ উৎপাদন বাড়াতে হবে এবং সেই সাথে বীজ উৎপাদন ও গবেষণায় বিভিন্ন কোম্পানিকে এগিয়ে আসতে হবে। বিভিন্ন এলাকার কৃষি পরিবেশ বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী মানসম্মত ও উন্নত বীজ কৃষকের সামনে নিয়ে আসতে পারে সেজন্য প্রয়োজনে ঋণ সুবিধাসহ ভর্তূকির ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। সার বিপণন ও সার ব্যবস্থাপনা উন্মুক্ত করতে হবে। সারের ক্ষেত্রে কিছু নীতিগত পরিবর্তন বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ যেমন- পোল্ট্রি বর্জ্য, শহরের বর্জ্যসহ অন্যান্য বর্জ্য যা আমরা যত্রতত্র না ফেলে পরিবেশ দূষণ না করে জৈবসার তৈরি করে দেশের মোট রাসায়নিক সারের ব্যবহার শতকরা ৩০ থেকে ৪০ ভাগ হ্রাস করতে পারি।
কৃষি জমির ওপর অপরিকল্পিত নগরায়ন ও শিল্পায়ন রোধে সরকার কৃষিজ জমির শ্রেণীবিন্যাস করে গ্রিন জোন বা কৃষি জোন ঘোষণা করলে পরিবেশ দূষণ যেমনি রোধ হবে তেমনি কৃষি জমির সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত হবে।
সেচ ও নিষ্কাশন ব্যবস্থাপনার দিকেও আমাদের নজর দিতে হবে। সেচ ব্যবস্থা উন্নয়নসহ মৌসুমে বিদ্যুৎ ও ডিজেলের সহজলভ্যতা নিশ্চিত করে বিভিন্ন অঞ্চলের পাম্প পরিচালনার ক্ষেত্রে উপজেলা কৃষি কর্মকর্তাদের যথাযথ দায়িত্ব পালন করতে হবে। কৃষিপণ্য বিপণন ও সংরক্ষণের জন্য যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করাসহ দেশের শতকরা ১০০ ভাগ ভূমির যথার্থ ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে।
গত ১৩ এপ্রিল ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশনে 'বাংলাদেশের ফসলের উৎপাদন পরবর্তী অপচয় কমিয়ে খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করার প্রকৌশলগত উপায়' শীর্ষক সেমিনারে মূল প্রবন্ধে বলা হয়- বাংলাদেশে কৃষিপণ্য উৎপাদনের পর তা সংগ্রহ, মাড়াই, সংরক্ষণ ও বাজারজাত করতে প্রতিবছর প্রায় ২৯ হাজার ৬৬৮ কোটি টাকার ফসল অপচয় হয়। শুধু ধানেই অপচয়ের পরিমাণ ২৬ লাখ আট হাজাপর মেট্ট্রিক টন। প্রতি কেজি ধানের মূল্য ১২ টাকা হিসেবে অপচয়ের পরিমাণ প্রায় তিন হাজার ২১৬ কোটি টাকা। ধান, গম, ভুট্টা, ডাল, সরিষা, আলু ও শাকসবজি সহ প্রতিটি কৃষিপণ্য সংগ্রহ, মাড়াই, সংরক্ষণ ও বাজারজাত করতে আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার না করাই এর প্রধান কারণ।
কৃষিপণ্যের ন্যায্যমূল্য, আধুনিক কৃষি উপকরণ সহজে প্রাপ্তি, মৌসুমী ফসলভিত্তিক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা, সার, কীটনাশকের সঠিক ব্যবহার এবং সহজপ্রাপ্যতা, সর্বোপরি কৃষকের দিকে দেশ ও জাতির দৃষ্টিই দিতে পারে আমাদের খাদ্যে স্বয়ংসম্পূণর্তা।
সর্বশেষ এডিট : ২৬ শে এপ্রিল, ২০০৯ সন্ধ্যা ৬:৩৪