কবি কাজী নজরুল ইসলামকে নিয়ে কিছু লেখার আগে যে সত্য কথাটি বলে নেওয়া প্রয়োজন, তা হলো- ব্যক্তিগতভাবে আমি যে ধরনের কবিতা পড়ে আনন্দ পাই বা ঋদ্ধ হই, নজরুল সে ধারার মধ্যে পড়েন না। তাই বলে যে এই কবির প্রতিভাকে খাটো করে দেখতে হবে বা প্রয়োজনীয়তাকে অস্বীকার করতে হবে, তা কিন্তু নয়। কেননা বাঙালির কাছে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও কাজী নজরুল ইসলাম যে বিশাল ব্যাপ্তি নিয়ে বর্তমান আছেন, তা ম্লান হতে আরও অনেকদিন লাগবে বলেই মনে হয়। বাঙালি মধ্যবিত্ত, আরও স্পষ্ট করে বললে মধ্যবিত্ত মুসলমানের কাছে কাজী নজরুলের যে আসন, তা অনেক দৃঢ় ও বস্তৃত। এর কারণ অবশ্য অনেকটাই সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গির ফল। সাম্প্রদায়িকতার বিচারেই একদা তাঁকে `জাতীয় কবি' হিসেবে স্বীকৃত দেওয়া হয় এবং এখনো তা বর্তমান।
তখনকার পাকিস্তানি কর্তৃত্বশীল ব্যক্তিরা একজন `জাতীয় কবি'র প্রয়োজন অনুভব করছিলেন। ফলশ্রুতিতে তারা ইকবালকে `জাতীয় কবি' করতে চেয়েছিলেন, কিন্তু তা সফল হয়নি। কারণ পূর্ব পাকিস্তানের মানুষরা ইকবালকে জাতীয় কবি বলে গ্রহণ করছিল না। কেননা তাদের মাতৃভাষা বাংলা এবং ভাষার প্রতি আছে সীমাহীন অহংকার। ফলে বাংলাভাষী মুসলমানদের খাঁটি মুসলমান ও খাঁটি পাকিস্তানি বানানোর জন্য খোঁজ পড়ল একজন মুসলমান বাঙালি কবির। তখন পাওয়া গেল কাজী নজরুল ইসলামকে। নজরুল মুসলমান, এবং তাঁর লেখায় ইসলাম ও মুসলমানকে নিয়ে অনেক গান ও কবিতা আছে; কিন্তু সে সঙ্গে তিনি পৌত্তলিক হিন্দুদের দেবদেবী নিয়েও প্রচুর কবিতা ও গান লিখেছেন, আরবি-ফারসি শব্দের পাশাপাশি যে তাঁর লেখায় ব্যবহার করেছেন প্রচুর সংস্কৃত শব্দ, দ্বিজাতিতত্ত্বকে স্বীকার করার বদলে হিন্দু ও মুসলমানকে যে তিনি একই বৃন্তের দুটি কুসুম রূপে দেখেছেন- এসব বিষয় তো খুবই বিব্রতকর। এরকম বিব্রতকর অবস্থা থেকে উদ্ধার পাওয়ার জন্য পাকিস্তানবাদের রক্ষাকারীরা নজরুলের লেখা থেকে হিন্দুয়ানি উপাদান বাদ দিয়ে, সংস্কৃত শব্দ ছাঁটাই করে তাকে মুসলমানিকরণের যে প্রচেষ্টা নিয়েছিল তা হাস্যকর ঠেকে। এরপর পাকিস্তান ভেঙে বাংলাদেশ হলেও কিন্তু নজরুলকে ছাড়া হয়নি। তিনি হয়ে ওঠেন বাংলাদেশী জাতীয় কবি। অথচ নজরুল নিছকই বাংলা ও বাঙালির কবি হয়ে থাকতে চাননি। দ্ব্যর্থহীন ভাষায় নজরুল ঘোষণা করেছিলেন, `আমি এই দেশে, এই সমাজে জন্মেছি বলেই শুধু এই দেশেরই, এই সমাজেরই নই। আমি সকল দেশের, সকল মানুষের। সুন্দরের ধ্যান, তার স্তবগানই আমার উপাসনা, আমার ধর্ম। যে কুলে, যে সমাজে, যে ধর্মে, যে দেশেই আমি জন্মগ্রহণ করি, সে আমার দৈব। আমি তাকে ছাড়িয়ে উঠতে পেরেছি বলেই কবি।'
জাতীয় কবি, মুসলমানের কবি বা হিন্দুর কবি, বিদ্রোহী কবি, নবজাগরণের কবি, সর্বহারার কবি, সাম্যবাদের কবি- এমন বহু উপাধিতে নজরুলকে বৃত্তবন্দি করার যে প্রবণতা তা যেমন হাস্যকর, তেমনি ভীতিপ্রদ। কেননা নজরুলকে রাষ্ট্রীয়ভাবেই হোক আর ব্যক্তি কিংবা সমষ্টিগতভাবেই হোক বৃত্তবন্দিকরণের পেছনে যে অভিপ্রায় লুকিয়ে থাকে, তাতে কায়েমী কোনো স্বার্থসিদ্ধির যোগ থেকে যায়। একজন প্রকৃত কবি এই বৃত্তবন্দির হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য বোধ করি মনে-প্রাণে আমৃত্যু চেষ্টা করে যান।
২.
নজরুল যে অসাধারণ সৃজন-প্রতিভার অধিকারী ছিলেন তা অনস্বীকার্য। তিনি তাৎণিক যে কোনো বিষয়ে কলম ধরতে পারতেন। বলা যায়, নজরুলের কবিতার জগতটি হলো তাৎণিক অনুভূত, অস্থিরতার জগৎ, কোলাহলের জগৎ। কবিতার যে নৈঃশব্দ্যের জগৎ নির্মাণে আধুনিক কবিরা কাজ করেন, নজরুল সেই পথে বেশিদূর যাননি। নজরুলের কাব্যজগতটি বেশিরভাগই দৃশ্যমান, অপ্রকাশের ভার বেশি বইতে যেন তিনি নারাজ। তাই তিনি কবিতায় প্রায়শ রাগী-বিপ্লবী বাক্যবর্ষণ করেছেন; আবার অন্তর বেদনায় ব্যথাতুর কিছু মিহি মসৃণ বাক্যও রচনা করেছেন। নজরুলের রচনার কিছু সমস্যা বুদ্ধদেব বসু চিহ্নিত করেছেন এভাবে- `অদম্য স্বতঃস্ফূর্ততা নজরুলের রচনার প্রধান গুণ- এবং প্রধান দোষ। যা কিছু তিনি লিখেছেন, লিখেছেন দ্রুতবেগে; ভাবতে, বুঝতে, সংশোধন করতে থামেননি, কোথায় থামতে হবে দিশে পাননি। ...এ ক্ষমতা চমকপ্রদ, কিন্তু নির্ভরযোগ্য নয়।' (কালের পুতুল)।
নজরুলের কবিতার চেয়ে তাঁর গানগুলোর আবেদন ও শক্তিমত্তা অনেক বেশিই বলে সবাই স্বীকার করেন। নজরুল প্রতিভার এক বিশিষ্ট প্রকাশ তাঁর গানেই। গানগুলোতে নজরুল যেন অনেক বেশি সংবেদনশীল, পরিমিতিবোধ সম্পন্ন। এ বিষয়ে বুদ্ধদেব বসুর অভিমত- `নজরুলের সমস্ত গানের মধ্যে যেগুলো ভালো সেগুলো সযত্নে বাছাই করে নিয়ে একটি বই বের করলে সেটাই হবে নজরুল প্রতিভার শ্রেষ্ঠ পরিচয়, সেখানে আমরা যাঁর দেখা পাবো তিনি সত্যিকার কবি, তাঁর মন সংবেদনশীল আবেগপূর্ণ, উদ্দীপনাপূর্ণ। `বিদ্রোহী কবি', `সাম্যবাদী কবি', কিংবা `সর্বহারার কবি' হিসেবে মহাকাল তাকে মনে রাখবে কিনা জানি না, কিন্তু কালের কণ্ঠে গানের মালা তিনি পরিয়েছেন, সে-মালা ছোট কিন্তু অক্ষয়।' (কালের পুতুল)।
কাজী নজরুল ইসলামের অধিকাংশ কবিতা সময়ের প্রয়োজনে রচিত। শাশ্বতকালের পথে কতদূর তা যেতে পারবে? ব্যক্তি মানুষের যে নীরব মনোজগৎ, যেখানে ব্যক্তিমন একা হতে চায়, সেইখানে নজরুলের কবিতা ঠিক কতটুকু পৌঁছতে পারে? জীবনানন্দ দাশ কিংবা তার পরবর্তী কবিদের সঙ্গে মহাকালের প্রেক্ষিতে নজরুলের কবিতা কতদূর টিকে থাকতে পারবে? আবার গণজাগরণ, গণআন্দোলন-গণসংগ্রাম বা ব্যক্তিজীবনের উদ্দাম-উদ্দীপনাময় পরিস্থিতির প্রয়োজনে নজরুলের কবিতার যে অগ্রণী ভূমিকার কথা আমরা শুনে শুনে এতদূর এসেছি, আর কতদিন তা আবেদন রাখতে পারবে? -এসব প্রশ্নও ভাবনার বিষয়।
সর্বশেষ এডিট : ২৫ শে মে, ২০০৮ বিকাল ৫:৩১