প্রতিমা মণ্ডলের বাড়ি বাঁকুড়া জেলা সহর থেকে ৩০ কিমি দূরের একটা প্রত্যন্ত গ্রামে। ছোট টিলা আর শাল বন ঘেরা গ্রামে বিদ্যুৎ পৌঁছেছে বছর ঘোরেনি। পাকা রাস্তা থেকে ১২ কিমি কাচা রাস্তা দিয়ে আসতে হয় তাদের গ্রামে। কখনও শাল বন কখনও টিলা আর রুক্ষ শুষ্ক মাঠের মধ্যে দিয়ে ধুলো ওড়া কাচা রাস্তা দিয়ে আসতে আসতে চোখে পড়ে ইতিউতি দু একটি মানুষের যাতায়াত আর কয়েকটি গ্রাম। টা থেকেই অনুমান করে নেওয়া যায় এলাকার মানুষের জীবনযাত্রা। এই রকম প্রত্যন্ত গ্রামের অত্যন্ত সাধারণ গৃহবধূ প্রতিমা মণ্ডল কিন্তু আজ গ্রামের মানুষের কাছে বিশেষ হয়ে উঠেছেন। ইদানীং গ্রামের মানুষের আলোচনায় মাঝে মাঝেই উঠে আসে প্রতিমার কথা। প্রতিমা মণ্ডল বিশেষ হয়ে উঠেছে কারণ তিনি গ্রামের আর সব মহিলার মত ঘরকন্নার কাজ করেন সঙ্গে তিনি শুরু করেছেন স্বাধীন ব্যবসা।
প্রতিমা মণ্ডলের স্বামী এলাকায় কৃষি শ্রমিকের কাজ করতেন। সারা বছর কাজ মেলে না। বছরের একটা বড় সময় থাকতে হত কলকাতায়। ঠিকা শ্রমিকের কাজে যা রোজগার হয় তাতে সংসার চলে যেত, তবু স্ত্রী সন্তানের থেকে দূরে থাকতে থাকতে ভবিষ্যৎ চিন্তাটায় ধোঁয়াশা লাগছিল। এইসময় হাল ধরলেন প্রতিমা দেবী শুরু করলেন শালপাতা দিয়ে থালা বা বাসন বানানোর কাজ। গত বছরের যোগাযোগ হয় রামকৃষ্ণ মিশনের সঙ্গে সেখান থেকে নেন প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ। ব্যবসা শুরুর জন্য প্রয়োজনীয় সাহায্যও পান। আর পিছন ফিরে তাকাতে হয়নি তাকে। স্বামীকে যেতে হয়না কলকাতায়, স্ত্রীর কাজে সহযোগিতা করেও সময় পেলে অন্য কাজ করেন। শুধু কি তাই, শাল পাতা সংগ্রহ থেকে পাতা সেলাই, যন্ত্রের সাহায্যে ‘প্রেশার’ দেওয়া ইত্যাদি নানারকম কাজে তিনি গ্রামের আরও দুজন মহিলাকে নিযুক্ত করতে পেরেছেন। তাদেরও বিকল্প রোজগারের রাস্তা দেখিয়েছেন। এখন প্রতিমা দেবী ছেলে মেয়ের উচ্চশিক্ষার স্বপ্ন দেখেন। তার চোখে সহজেই স্বাবলম্বী মানুষের দৃঢ়তা ধরা পড়ে।
আজ গ্রামে গ্রামে এমনি প্রতিমা মণ্ডলদের সাধারণ থেকে বিশেষ হয়ে ওঠার জন্য প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে Welt Hunger hilfe, রামকৃষ্ণ মিশন ও DRCSC নামের সংস্থা-ত্রয়। তাদের প্রচেষ্টায় বেকার যুবকেরা বিকল্প জীবিকার পথ বেছে নিচ্ছে, পরিবারকে ভরসা যোগাচ্ছে। সমাজের পিছিয়ে থাকা শ্রেণী কিম্বা শারীরিক প্রতিবন্ধীরাও রীতিমত প্রশিক্ষণের মাধ্যমে শুরু করেছে তাদের ব্যবসা থেকে চাষ বাস, সমাজের মূল স্রোতে তারাও চলে আসছে প্রবল বেগে।
এই লেখার শুরুতে প্রতিমা মণ্ডলের কথা বলার কারণ তার ঘটনা আশাব্যঞ্জক বলে। বাস্তব চিত্রটা তো অন্য কথাই বলে। International labour Organization এর হিসাব অনুযায়ী ২০১৮ সালের মধ্যে ভারতে ১ কোটি ৮০ লক্ষ মানুষ জীবিকাহীন থাকবে। চিন্তার কথা সন্দেহ নেই। উল্লেখ করার মত আরও কয়েকটি তথ্য হল গ্রামীণ ভারতবর্ষের ৭০% পরিবার কৃষিকার্যের উপর নির্ভরশীল, দেশের শ্রম-সংখ্যা বা শ্রমদলের (Workforce) ৩১% কৃষিতে যুক্ত, অথচ দেশের GDP’র ১৬% কৃষির এবং দেশের মোট রপ্তানির ১০% কৃষিজাত। এর সঙ্গে মনে রাখতে হবে দেশের বর্তমান বেকারত্ব, কৃষিকাজে আগ্রহ হারানো, কৃষিতে পদ্ধতিগত পরিবর্তন না আনা সঙ্গে পরিবেশ দূষণ। পরিণামস্বরূপ যে জিনিসটা প্রথমেই চোখে পড়ে তা হল Migration. গ্রামীণ মানুষের শহরে চলে আসা, শহরে অদক্ষ শ্রমিকের কাজ করা, ক্রমে শহরের আকৃতির পরিবর্তন হচ্ছে, বাড়ছে অস্বাস্থ্যকর বস্তির সংখ্যা। তবুও মানুষ থাকতে বাধ্য হচ্ছে দিনের শেষে কিছু নিশ্চিত আয়ের আশায়। অন্যদিকে গ্রামীণ পরিবারগুলি স্থিতি হারাচ্ছে, তৈরি হচ্ছে নতুন নতুন সমস্যা। সরকারী নীতির কথাও উল্লেখযোগ্য, যেখানে ১০০ দিনের কাজ নিশ্চিত করা হচ্ছে, তবু সমস্যা থেকেই যাচ্ছে। ১০০ দিনের কাজ মূলত মাটি কাটার কাজ যা দক্ষ শ্রমিক তৈরি করে না। ফলত, এবছরের ১০০ দিনের কাজ করা মানুষগুলোকে পরের বছরের ১০০ দিনের কাজের উপর নির্ভরশীল করে তোলে।
অথচ গ্রামের দিকে যদি আমরা দৃষ্টি ফেরায় তাহলে দেখতে পাব প্রাকৃতিক সম্পদের অভাব সেখানে নেই। প্রকৃতি যে তার দানে সামঞ্জস্য রেখেছেন সে কথা বলায় যায়। আর সেই সম্পদের সঠিক ব্যবহারেই যে সমস্যার সমাধান হতে পারে তা নিশ্চিত করে দেখাচ্ছে Welt Hunger hilfe – এর Green College Project এর মাধ্যমে রামকৃষ্ণ মিশন ও DRCSC. তারা বাঁকুড়া বীরভূম, পুরুলিয়া, মেদিনীপুরের প্রত্যন্ত এলাকায় গিয়ে মানুষকে শেখাচ্ছেন এলাকার মধ্যেই অবহেলায় পড়ে থাকা সম্পদের ব্যবহার করে কিভাবে রোজগারের পথ প্রশস্ত করা যায়। কিভাবে দক্ষতা বাড়িয়ে ভবিষ্যতকে সুনিশ্চিত করা যায়। শিক্ষা শুধু চাকুরী পাওয়ার জন্য নয় বরং সেই আধুনিক শিক্ষাকে সনাতন কাজে লাগিয়ে তাকে লাভজনক করার কৌশল তারা শেখাচ্ছেন গ্রামের উঠতি যুবক যুবতীদের। শুধু শিক্ষিত উঠতি যুবক যুবতী নয়, আদিবাসী পুরুষ ও মহিলা থেকে সাধারণ গৃহবধূ বা চাষ বাস করা মাঝ বয়স্ক মানুষ সবাইকেই ভরসা যোগাচ্ছেন তারা। গ্রামে গ্রামে ঘুরে মানুষকে বোঝানো তাদেরকে আগ্রহী করা, প্রয়োজনীয় আবাসিক প্রশিক্ষণ থেকে শুরু করে জীবিকার শুরুর থেকেই আর্থিক বা অন্যান্য সহযোগিতা তারা করছেন। গ্রামীণ সম্পদ ব্যবহার করে স্বনির্ভরতার স্বাদ পাচ্ছেন বহু মানুষ।
Green College –এর এই প্রকল্পের মূলে ছিল যে কয়েকটি জিনিস তা হল গ্রামীণ সম্পদ ব্যবহারে গ্রামের মানুষকে দক্ষ করে তোলা যাতে তারা গ্রামে থেকেই সুনিশ্চিত ভবিষ্যৎ গড়ে তুলতে পারে। সেই সঙ্গে পরিবেশ দূষণের বিষয়টিকে অত্যন্ত গুরুত্ব দেওয়া। গ্রামীণ সম্পদের উপর নির্ভরশীল জীবিকা পরিবেশ বান্ধব হবে সেটাই বাঞ্ছনীয় এবং তাহলেই তা আমাদের ভবিষ্যতকে প্রকৃত অর্থে সুরক্ষিত করবে সেকথা মাথায় রাখা হয়েছে।
এখনও পর্যন্ত যে সমস্ত সম্পদের ব্যবহার করে জীবিকায় সুস্থিতি আনার দিশা দেখিয়েছে Green College Project সেগুলির মধ্যে একটা হল তাল ও খেজুর গাছের রস প্রক্রিয়াকরণের মাধ্যমে রস ও গুড় তৈরি। প্রকৃতি এমন ভাবেই সাজিয়েছে তার সম্পদ যে শীতের মরসুমে খেজুর রস ও গরমের মরসুমে তাল রস পাওয়া যায়। আর এই দুটি গাছ গ্রামীণ এলাকায় সহজলভ্য কিন্তু অনাদরে পড়ে থাকে। এই দুটি গাছের রস থেকে গুড় ও পাটালি খাবার হিসাবে সমাদৃত। এই জীবিকাও প্রাচীন, কিন্তু এই কাজকে আরও আধুনিক ভাবে দক্ষতার সঙ্গে দলবদ্ধ ভাবে করার প্রশিক্ষণ দিচ্ছে রামকৃষ্ণ মিশন ও DRCSC. বাঁকুড়া বীরভূমের আদিবাসী পুরুষ ও মহিলারা দলবদ্ধভাবে প্রশিক্ষণের পর এই কাজকে মুলো জীবিকায় পরিণত করে নিয়েছে। তাল বা খেজুর গাছে ওঠার মোট বিপদজনক কাজের জন্য যেমন Insurance এর আওতায় এসেছে তারা তেমনি প্রশিক্ষণে শেষ নয় উৎপাদিত দ্রব্য বাজারজাত করা পর্যন্ত সহযোগিতা পাচ্ছে।
এর পর উল্লেখযোগ্য হল ঘাস ও খড়ের ব্যবহারে মাদুর ব্যাগ এর মত নানান ব্যবহারের জিনিস তৈরির প্রশিক্ষণ। পশ্চিম মেদিনীপুরের অমরদা গ্রামে তো রীতিমত তৈরি হয়ে গেছে Mat Unit যা বর্তমানে registered, ১২ জন গ্রামের মহিলা তাতে যুক্ত, তাদের তৈরি জিনিসপত্র রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তে উল্লেখযোগ্য মেলায় বিক্রি হয়, এছাড়া রাজ্যের বাইরেও যাচ্ছে তাদের জিনিস। স্থানীয় বাজার থেকে কলকাতা সর্বত্র গ্রহণযোগ্যতা দিন দিন বাড়ছে। এছাড়া শালপাতা ব্যাবহার করে থালা বা বাসন বানানোর কথা আগেই উল্লেখ করা হয়েছে। প্রানিপালন ও প্রাণী চিকিৎসার মত প্রশিক্ষণে উপক্রিত মানুষের সংখ্যা কম নয়। সুন্দরবনের মত এলাকায় যেখানে বিদ্যুৎ পৌঁছায়নি সেখানে পরিবেশ-বান্ধব বিকল্প উপায় হিসাবে সোলার বিদ্যুতের প্রচলন অনেকদিনের। ওই এলাকায় সোলার বিদ্যুতের সরঞ্জাম মেরামতি ইত্যাদির মত প্রশিক্ষণ অনেক বেকারকে ভরসা যোগাচ্ছে। স্বাস্থ্যের পক্ষে উপকারী হিসাবে খরগোশের মাংস যে ভবিষ্যতে জনপ্রিয় হতে চলেছে সে কথা মাথায় রেখে খরগোশ পালনের প্রশিক্ষণেও সারা মিলেছে ভালোয়।
সর্বোপরি বলা যায় গ্রিন কলেজ প্রজেক্টের লক্ষ্য অনুযায়ী গ্রামীণ সম্পদকে পরিবেশ-বান্ধব উপায়ে ব্যবহার করে জীবিকার সমস্যার সমাধান ও ভবিষ্যৎ সুরক্ষিত করার যে প্রয়াস রামকৃষ্ণ মিশন ও DRCSC চালিয়ে যাচ্ছে গ্রামীণ সমাজ অর্থনীতিতে তার প্রভাব সদর্থক ও সুদূরপ্রসারী একথা বলায় যায়।
সর্বশেষ এডিট : ০৯ ই মে, ২০১৭ বিকাল ৫:১০