সব্যসাচী মণ্ডল
“আধুনিক চিকিৎসা-জগতে সেরা ডাক্তার ও কৃতি শল্য-চিকিৎসকের সংখ্যা কম হলে ক্ষতি নেই, দরকার সেইসব চিকিৎসকদের, যারা দূরদর্শী, দেশকর্মী ও সমাজ-সচেতন।” --- ডাঃ নর্মান বেথুন।
মোটামুটি গোছান ক্লিনিক। একদিকের দেওয়ালে মানব শরীরের নানা অঙ্গপ্রত্যঙ্গের ছবি পাশেই ফ্রেমে বাঁধানো উপরের কথাগুলি। অন্যদিকের দেওয়াল জুড়ে ক্যালেন্ডার, ওষুধ কোম্পানির বিজ্ঞাপন, পোস্টার। ডাক্তারবাবুর পিছনের দেওয়াল জুড়ে শেল্ফ ভর্তি ওষুধ। ঘরের মাঝখানে মাঝারি সাইজের টেবিলেও নানা আকারের রং-বেরঙের ওষুধের বাক্স। ডাক্তারের সামনে টেবিলের উল্টো দিকের বেঞ্চে বসে অল্প বয়েসি মা। তার কোলে দেড়-দুই বছরের শিশু আর পাসে বসা ছেলেটির পাঁচ কি ছয়। বড়টির পরনে হাফ প্যান্ট, জামাটা ফুল হাতা, কোলের শিশুটির গায়ে লুঙ্গি জড়ানো চাদরের মত করে। ছোটটি নতুন পরিবেশ বলে হয়ত একটু চুপচাপ, বড়টি যেভাবে টেবিলের এটা-সেটা নাড়ছে তাতে মনে হয় পরিবেশটির সঙ্গে পরিচিত। ডাক্তারবাবু দুটি শিশু কেই দেখলেন, ওষুধ দিলেন একজনের জন্য, বুঝিয়ে দিলেন কখন কিভাবে তা খেতে হবে। অন্যটির জন্য দিলেন খাওয়া দাওয়া ঠিক করার পরামর্শ।
ডাক্তারবাবুর নাম উত্তম মণ্ডল, এই গ্রামেরই ছেলে। বয়স আন্দাজ ৬০ ছুঁই ছুঁই। অভাবের সংসারে পড়াশোনা বেশিদূর করে উঠতে পারেননি। প্রথম কাজ শুরু করেন ব্লক হাসপাতালের সামনের একটা ওষুধের দোকানে। সপ্তাহের নানা দিনে নানা সময়ে নানা বিষয়ের বিশেষজ্ঞ ডাক্তার সেখানে এসে রুগী দেখতেন। ক্রমে সেই সব ডাক্তারের সংস্পর্শে আসা এবং এই রকমই একজন ডাক্তারের কাছে থেকে ডাক্তারি শেখা। কয়েক বছর পর নিজের গ্রামেই খুলে দিলেন নিজস্ব ক্লিনিক। আজ দীর্ঘ ৩৫ বছর এখানেই চিকিৎসা করছেন তিনি। গ্রামের মানুষের কাছে তিনি সম্মানীয় ডাক্তারবাবু বা উত্তম ডাক্তার।
শুধু আমাদের রাজ্যেই নয় সারাদেশেই, গ্রামাঞ্চলে উত্তম বাবুর মত কয়েক লক্ষ্য মানুষ প্রথাগত প্রশিক্ষণ ছাড়াই চিকিৎসা করছেন। বর্তমানে আমাদের রাজ্য সরকার এই রকম ডাক্তারবাবুদের জন্য স্বল্পমেয়াদী ডাক্তারি প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে চলেছেন। রাজ্য সরকারের এই সিদ্ধান্তের পক্ষে বিপক্ষে নানা মতও উঠে আসছে। এইরকম পরিস্থিতিতে নিজের অবস্থান ঠিক কি হওয়া উচিত বোঝার জন্য নিজের কাছেই নিজের প্রশ্ন –
কি হত আমার বাড়ি যদি গ্রামে হত?
প্রত্যন্ত গ্রাম যেখানে বিদ্যুৎ নেই, আর যোগাযোগ ব্যবস্থাও খারাপ। হাসপাতাল হয়ত আছে ব্লক শহরে কিন্ত উপযুক্ত পরিষেবার জন্য প্রয়োজনীয় পরিকাঠাম নেই। না, আমার অন্তত এত চিন্তার কিছু নেই, আমার বাড়ি শহরে। পা বাড়ালেই MBBS-MD-Child Specialist-Cardio-Neuro ইত্যাদি ইত্যাদি বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের ছড়াছড়ি। এছাড়াও ন্যুনতম পরিকাঠাম যুক্ত সরকারী হাঁসপাতাল আছে। হাঁসপাতাল পৌঁছানোর ব্যবস্থাও ভালো। আর ফেল কড়ি মাখ তেল – ছোট বড় নার্সিংহোমের অভাব নেই। তাহলে গ্রামের মানুষ? তাহলে কি তারা একেবারে পথে পড়ে আছে? গ্রামের মানুষের সঙ্গে কথা বললেই জানা যায় স্বাস্থ্য পরিষেবার চরম ঘাটতির শিকার তারা কিন্ত একেবারে পথে পড়েও নেই তারা। তাদের জন্য আছেন উত্তম বাবুর মত গ্রামের ডাক্তারেরা।
আমরা সবাই কমবেশি এই গ্রামের ডাক্তারদের সঙ্গে পরিচিত। গ্রামের দিকে শুধু টিউশন দেয় যারা তাদের নামের সঙ্গেও যেমন জুড়ে যায় মাস্টার শব্দটি তেমন করেই নামের পাশে ডাক্তার শব্দটি জুড়ে যায় কিছু মানুষের নামের পাশে। কারণ তাঁরা ডাক্তার নন কিন্ত গ্রামে গঞ্জে ডাক্তারি করেন। গ্রামের এই সব ডাক্তারেরা প্রথাগত ডাক্তারি প্রশিক্ষণ পায়নি, কিন্ত কোন ফার্মেসিতে থেকে, কোন পাশ করা ডাক্তারের সঙ্গে থেকে শেখেন ডাক্তারি। অনেক সময় দেখা যায় এলাকারই কোন অপ্রশিক্ষিত অথচ দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতায় সমৃদ্ধ ডাক্তারের কাছেও এরা শিক্ষা নেয়। পরবর্তী কালে এরা নিজের এলাকায় বা অন্যকোন গ্রামীণ এলাকায় নিজেদের পসার জমায়। এই ডাক্তারদের আমরা আরও বেশি করে চিনি হাতুড়ে ডাক্তার নামে। সব উন্নয়নশীল দেশেই স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় নানা খামতি থাকে। স্বাস্থ্য ব্যবস্থার ফাঁকফোকর দিয়ে পরিষেবার ঘাটতি থাকা এলাকায় জাঁকিয়ে বসেন এই ধরনের ডাক্তারেরা। উদাহরণস্বরূপ বলা যায় আমাদের দুই প্রতিবেশী দেশ চিন বা বাংলাদেশের কথা। চীনে এই ধরনের ডাক্তারদের “বেয়ার-ফুট ডক্টর” বা “খালি-পদ ডাক্তার” বলা হয়। এরাজ্যের মত বাংলা দেশেও হাতুড়ে ডাক্তার বলা হয়।
বহুকাল আগেও আমাদের গ্রাম প্রধান দেশের মানুষের চিকিৎসা গ্রামীণ কবিরাজ-বৈদ্য দের হাতেই ছিল। ইংরেজ শাসনেই আমাদের প্রথম ইউরোপীয় চিকিৎসা পদ্ধতির সঙ্গে পরিচয়। ব্রিটিশ সরকার প্রথম উপমহাদেশের অঙ্গরাজ্যগুলির জন্য চিকিৎসা ব্যবস্থা প্রচলন করেন। ১৭৬৪ সালের Indian Medical Service ছিল প্রথম উদ্যোগ। যদিও সেটা ছিল ব্রিটিশ সিভিলিয়ান ও মিলিটারি সার্ভিস এর জন্য। ১৮২২ সালে ২০ জন ভারতীয় ছাত্রকে নিয়ে নেটিভ মেডিক্যাল কাউন্সিল এবং এখানেই প্রথম মাতৃ ভাষায় ডাক্তারি প্রশিক্ষণের প্রথম উদ্যোগ নেওয়া হয়। এই সময় এনাটমি, মেডিসিন, সার্জারি ছাড়াও ইউনানি ও আয়ুর্বেদিক পড়ানও শুরু হয়। ১৮৩৫ সালে তৈরি হয় মেডিক্যাল কলেজ। ১৮৫৭ সালে চালু হয় তিনটি ডিগ্রী – লাইসেন্সিয়েট ইন মেডিক্যাল এন্ড সার্জারি, ব্যাচেলর ইন মেডিসিন ও ডক্টর ইন মেডিসিন। পরবর্তীকালে অনেক পরিবর্তনের মধ্যে দিয়ে আসে এল এম এফ কোর্স যার পরিসমাপ্তি ঘটে ১৯৪৬ সালে। এল এম এফ কোর্স-এর পরিসমাপ্তির সঙ্গে সঙ্গে শেষ হয়ে যায় স্বল্পমেয়াদী ডাক্তারি প্রশিক্ষণ। কারণ এটি ছিল তিন বছরের কোর্স। এর পর শুরু হয় এম বি বি এস কোর্স। তুলনামূলক দীর্ঘমেয়াদী (৫ বছর), উচ্চ-মেধার, খরচ সাপেক্ষ এই কোর্স আজ পর্যন্ত স্বীকৃত ডাক্তারি প্রশিক্ষণ। অর্ধ শতাব্দীরও বেশি সময় চালু এই ডাক্তারি প্রশিক্ষণ ব্যবস্থাও কিন্ত আমাদের গ্রাম গঞ্জের জন্য প্রয়োজনীয় সংখ্যায় ডাক্তার তৈরি করতে পারেনি। পাশ করা ডাক্তারেরা শহরের অনুকূল পরিবেশ ছেড়ে গ্রামের পরিবেশে গিয়ে থেকে চিকিৎসা করতে রাজি নন। শহর থেকে মোটামুটি যোগাযোগ ব্যবস্থা থাকা ও অন্যান্য সুবিধা থাকা ব্লক শহর পর্যন্ত তাদের যাতায়াত।
এই রকম একটা অবস্থায় দাড়িয়ে রাজ্য সরকারের গ্রামের ডাক্তারদের প্রশিক্ষণের সিদ্ধান্ত কিন্ত ঘুরিয়ে প্রমাণ করে যে গ্রামের মানুষ উপযুক্ত স্বাস্থ্য পরিষেবা পাচ্ছে না। পরিষেবার সেই ঘাটতি পূরণের জন্যই যে এই প্রশিক্ষণ তা বলার অপেক্ষা রাখেনা। কিন্ত এই ধরনের উদ্যোগ এই প্রথম নয়। প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য, পূর্বতন সরকার একই উদ্দেশ্য মাথায় নিয়ে তিন বছরের ডাক্তারি কোর্স চালু করেছিল ১৯৮০ সালে। তিন বছরের কোর্সের জন্য যোগ্যতা দরকার হত উচ্চমাধ্যমিক পাশ। প্রথমে এই কোর্সের নাম রাখা হয়েছিল ডিপ্লোমা ইন কমিউনিটি ফিজিসিয়ান। ১৮৮৭ সালে এই নাম পরিবর্তন করে নতুন নাম দেওয়া হয় – ডিপ্লোমা ইন কমিউনিটি মেডিক্যাল সার্ভিস। এই স্বল্প মেয়াদী কোর্সের লক্ষ্য ছিল গ্রামীণ এলাকায় ডাক্তারের অভাব মেটানো। আর তাই গ্রামাঞ্চলের স্বাস্থ্যকেন্দ্রেই ডাক্তারি করা যাবে এবং কোন প্রাইভেট প্র্যাকটিস করা যাবে না – ভর্তির সময় এই রকম শর্তও রাখা হয়েছিল।
রাজ্যসরকারের প্রথম উদ্যোগ কিন্ত সফল হয়নি। মাত্র তিন বছর চলেছিল। প্রথম ব্যাচের ছাত্র দের কোর্স শেষ হওয়ার পরেও ডাক্তারি নথিভুক্তিকরণের ব্যবস্থা সরকার করতে পারেনি। তিনটি ব্যাচের পর ছাত্র ছাত্রীদের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত হয়ে পড়ে। সমাজের উঁচু তলার বিরোধিতা আসে প্রবল ভাবে। এই কোর্সের সঙ্গে যুক্ত ছাত্র-ছাত্রীরা আন্দোলনের পথ বেছে নেয়। প্রথমে হাই কোর্ট পরে সুপ্রিম কোর্ট পর্যন্ত লড়াই করে। শেষ পর্যন্ত ২০০৩ সালে সুপ্রিম কোর্ট নথিভুক্তকরণের পক্ষেই রায় দেয়। সুপ্রিমকোর্টের এই রায় এর পর অনেক রাজ্য সরকার এমনকি কেন্দ্র সরকারও স্বল্প মেয়াদী ডাক্তারি কোর্স সম্পর্কে ভাবছে। কয়েকবছর আগেই কেন্দ্র সরকার ঘোষণা করে ব্যাচেলর ইন মেডিক্যাল অফ রুরাল মেডিসিন এন্ড সার্জারি কোর্স যা সাড়ে তিন বছরের হবে। বেশকিছু রাজ্য সরকারও (যেমন বিহার, ঝাড়খণ্ড, আসাম) চালু করেছে স্বল্প মেয়াদী ডাক্তারি কোর্স।
তিন দশক পর আবার উদ্যোগ নিলো বর্তমান রাজ্য সরকার। এবার প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে গ্রামীণ ডাক্তারদের এবং কোর্স হবে তিন বছরের। এবারের বিতর্কটাও সেই একই থেকে যাচ্ছে। বিতর্কের মুলে যে যুক্তি গুলি উঠে আসছে তা হল সরকার নিজস্ব পরিকাঠাম ও অন্যান্য দুর্বলতা ঢাকতে গ্রামের মানুষের জন্য দ্বিতীয় শ্রেণীর ডাক্তার তৈরি করতে চলেছে। স্বল্প মেয়াদী (তিন বছরের) কোর্সে পরিপূর্ণ শিক্ষা দেওয়া কি সম্ভব না মেধার মূল্য অস্বীকার করা সম্ভব? এই কোর্স চালু হলে গ্রামের জন্য অর্ধ চিকিৎসক সম্প্রদায় তৈরি হবে ও ক্রমে শহরের জন্য পূর্ণাঙ্গ ও গ্রামের জন্য অর্ধ-চিকিৎসা ব্যবস্থা তৈরি হবে। চিকিৎসার মত বিষয় যেখানে আক্ষরিক অর্থেই মানুষের বাঁচা মরার প্রশ্ন জড়িত সেখানে কি এই রকম পরীক্ষা নিরীক্ষার সুযোগ আছে?
এই ধরনের সন্দেহ অমূলক নয়। কিন্ত বাস্তব পরিস্থিতি অন্য কথা বলছে। গ্রামীণ চিকিৎসক অর্থাৎ হাতুড়ে ডাক্তারদের অবৈধ করেই রাখা হয়েছে। তারপরও কি সরকার তাদের গ্রামে গঞ্জে চিকিৎসা করা থেকে বিরত করতে পেরেছে? না সরকার বাধ্য করতে পেরেছে পাশ করা ডাক্তারদের গ্রামে গিয়ে চিকিৎসা করতে? তাহলে গ্রামীণ ডাক্তারদের অবৈধ করে রেখেই বা আমরা কি পাচ্ছি? বরং যত দিন যাচ্ছে ততই এরা জাঁকিয়ে বসছে। এই জাঁকিয়ে বসার পিছনে অনেক গুল কারণ কাজ করছে। আই আই এইচ এম আর – ফিউচার হেলথ সিস্টেমস-এর বেশ কিছু গবেষণা থেকে উঠে এসেছে গ্রামীণ ডাক্তারদের বর্তমান অবস্থা, গ্রামীণ সমাজে ও স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় তাদের ভূমিকা ও প্রভাব।
২০০৯ সালের গবেষণা থেকে উঠে এসেছে শুধু সুন্দরবন অঞ্চলে ৬২% মানুষ গ্রামীণ ডাক্তারদের কাছে স্বাস্থ্য পরিষেবা নেন। সমগ্র পশ্চিমবঙ্গে তখন এই হার ছিল ৫৩%। গ্রামের ডাক্তারদের এই প্রভাবের পিছনে অনেকগুলি কারণ গবেষণা থেকে উঠে এসেছিল। একটি হল সহজলভ্যতা। ডাক্তারদের দিনে বা রাতে সব সময় পাওয়া যায়। পাড়ার বা পাশের পাড়ার বা গ্রামেরই ছেলে এবং এলাকাতে থেকে চিকিৎসা করেন। গ্রামের ডাক্তারেরাও জানেন তাদের পসার বাড়াতে ও বজায় রাখতে গেলে শুধু মাত্র পাড়ার মোড়ে, গ্রামের বাজারে বা বাড়ির মধ্যে থাকা চেম্বারে চিকিৎসা করলেই হবেনা বরং তাদের গ্রামে গ্রামে ঘুরতে হবে। তাই ফোন করলেই তারা পৌঁছে যান রুগীর বাড়িতে। এছাড়া বাড়ির কেও অসুস্থ হলে দুরের হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া মানে একদিনের কাজ নষ্ট, অনেক সময় প্রয়োজন সঙ্গে যাওয়ার লোক। বিপরীত দিকে কলের ছেলেকে নিয়েই গ্রামের ডাক্তারের চেম্বারে চলে জাওয়া যায় বা ফোন করেই ডেকে নেওয়া যায় বাড়িতে। আর একটা সুবিধা হল, দরকারের সময় অর্থের সংস্থান না থাকলেও চিন্তার কিছু নেই, গ্রামের ডাক্তার ধারেও চিকিৎসা করেন। অনেকক্ষেত্রে বিনা পয়সার হাসপাতালের থেকেও খরচ কম হয় গ্রামের ডাক্তারের কাছে চিকিৎসায়। কারণ, যাতায়াত, খাওয়া খরচ, একদিনের কাজ নষ্ট, তা ছাড়া হাসপাতালে সব ওষুধও পাওয়া যায়না। এছাড়াও, গ্রামের ডাক্তার পরিচিত মুখের কারণে মানুষের বিশ্বাস বেড়ে যায়। পরিষেবার সঙ্গে আন্তরিকতা যোগ হয়ে ধীরে ধীরে গড়ে ওঠে আলাদা সাংস্কৃতিক সম্পর্ক। এই সম্পর্ক ধরেই গ্রামের ডাক্তারেরা পারিবারিক ডাক্তার হয়ে ওঠেন।
এছাড়া সরকারী স্বাস্থ্য পরিষেবার খামতিও উল্লেখযোগ্য। পাথরপ্রতিমা ব্লকের উপর ডিপার্টমেন্ট অফ হেলথ এন্ড ফ্যামিলি ওয়েলফেয়ার-এর একটি রিপোর্ট উল্লেখ করা যায় যেখানে দেখা যাচ্ছে জনসংখ্যা পিছু এ এন এম-এর ঘাটতি ২৫%, প্রাইমারী হেলথ সেন্টারের ঘাটতি ৭৮% এবং রুরাল হসপিটাল বা ব্লক প্রাইমারী হাসপাতালের ঘাটতি ৬৭%। পাথরপ্রতিমা ব্লকেই ফিউচার হেলথ সিস্টেমস এর গবেষণায় দেখা গেছে গ্রামীণ ডাক্তারের সংখ্যা প্রায় ৪০০। অর্থাৎ প্রতি ৯০০ জন পিছু একজন গ্রামীণ ডাক্তার। সেখানেই একজন সরকারী ডাক্তার পিছু ৩৫ হাজার মানুষ। পাথরপ্রতিমা ব্লকের গ্রামীণ চিকিৎসকদের সংগঠন “গ্রামীণ চিকিৎসক সমিতির” সভাপতি উজ্জ্বল কুমার মণ্ডল এর মতে বর্তমানে এই গ্রামীণ ডাক্তারের সংখ্যা হাজার ছুঁয়ে গেছে।
অতি সম্প্রতি আই আই এইচ এম আর – ফিউচার হেলথ সিস্টেমস-এর আর একটি গবেষণা থেকে দেখা গেছে এই গ্রামের ডাক্তারেরা কিভাবে নিজেদের ভীতটিকে শক্ত করে যাচ্ছেন। তাঁরাও তাদের মত করে চেষ্টা করে যাচ্ছেন গ্রামীণ স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় নিজেদের উপযুক্ত করে তলার। গ্রামের ডাক্তারদের প্রথম পাঠ পাস করা ডাক্তারদের কাছে। পসার বাড়াতে বা মানুষের কাছে গ্রহণ যোগ্যতা বাড়াতে পরবর্তী কালেও বিভিন্ন স্পেশালিষ্ট ডাক্তারদের সঙ্গে যোগাযোগ তৈরি করেন তাঁরা। প্রয়োজন মত তারা নানা রুগী,তার রোগ, চিকিৎসা পদ্ধতি সম্পর্কে এই পাস করা ডাক্তারদের কাছে পরামর্শ নেন। নিজের আয়ত্তের বাইরে বুঝতে পারলে কখন রুগীকে পাঠিয়ে দেন বা সশরীরে রুগীকে নিয়ে হাজির হন এই পাস করা ডাক্তারবাবুদের কাছে। একই রকম ভাবে তাঁরা যোগাযোগ তৈরি করেন সরকারী হাসপাতালের (ডাক্তারদের) সঙ্গে, প্রাইভেট নার্সিংহোমের সঙ্গে, ডায়াগনস্টিক সেন্টারের সঙ্গে এমনকি গ্রামের ভ্যান থেকে গাড়ি বা এ্যাম্বুলেন্স এর সঙ্গে। এভাবেই সরকারী স্বীকৃত রেফারেল সিস্টেমের বাইরে ধীরে ধীরে গরে উঠেছে স্বতন্ত্র “প্যারালাল রেফারেল সিস্টেম”। সংকটজনক অবস্থায় থাকা রুগীকে শহরের নার্সিংহোমে বা সরকারী হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার সময়েও তাঁরা পাশে পান এই গ্রামের ডাক্তারদের। গ্রামের মানুষের কাছে এটাই অনেক বড় ব্যাপার যে সংকটজনক অবস্থায় থাকা তাদের বাড়ির লোকের সঙ্গে তাদের গ্রামের ডাক্তার যাচ্ছে। রাস্তায় প্রয়োজনীয় চিকিৎসা যেমন তিনি দিতে পারবেন তেমনি হাসপাতালের মত অচেনা পরিবেশে রুগী ভর্তি করা ডাক্তারের সঙ্গে কথা বলা বা ওষুধপত্রের ব্যবস্থা করার মত দায়িত্ব তাঁরা নিয়ে নেন।
গ্রামীণ এলাকায় গ্রামীণ ডাক্তারদের ভূমিকা বা প্রভাব যে অসীম তা বুঝতে পেরেছে বাজারের নামি দামি ওষুধ কোম্পানিগুলো। আর তাই তাদের মেডিক্যাল রিপ্রেজেন্টেটিভরা পৌঁছে যাচ্ছে প্রত্যন্ত এলাকায় প্র্যাকটিস করা গ্রামের ডাক্তারদের চেম্বারে বা বাড়িতে। বিভিন্ন ওষুধ কোম্পানি এই রকম এলাকায় গ্রামের ডাক্তারদের জন্য প্রশিক্ষণের ব্যবস্থাও করে। গ্রামের ডাক্তারেরাও আগ্রহের সঙ্গে এই ট্রেনিং করেন, খোঁজ খবর রাখেন ট্রেনিং-এর। তাছাড়া তাঁরা বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা পরিচালিত প্রশিক্ষণ বা স্বাস্থ্য-কর্মসূচীতে যোগ দিয়ে নিজেদের অবস্থান কে শক্ত করে তোলেন। ধীরে ধীরে তো অনেক গ্রামীণ ডাক্তারও বিভিন্ন বিষয়ে বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের পরিচয় পান। প্রথম যার কাছে শিখেছিলেন তার ডাক্তারির বিশেষজ্ঞতা, এই ধরনের ট্রেনিং, দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতা মিলে কেও চর্মরোগ বিশেষজ্ঞ হয়ে যান তো কেও শিশু রোগ বিশেষজ্ঞ।
অর্থাৎ, গ্রামের ডাক্তারবাবুরাও গ্রামীণ পরিস্থিতিতে তাদের অবস্থানকে ভালো করে বুঝে নিয়েছেন। তাঁরা যেমন যুগোপযোগী হওয়ার জন্য তাদের নেটওয়ার্ক তৈরি ও নেটওয়ার্কটিকে শক্তিশালী করে তুলছেন তেমনি আবার বেসরকারি ট্রেনিং নিচ্ছেন। আর নিজেদের প্রয়োজনেই তাঁরা সঙ্ঘবদ্ধ হয়েছেন, নানা সময়ে আন্দোলন করেছেন সরকারী স্বীকৃতির দাবিতে। নিজেদের উপর থেকে অবৈধ তকমা ঝেড়ে ফেলতে চেয়েছেন। এই ডাক্তারবাবুদের গ্রামে ভূমিকা বা প্রভাব যে কতটা আর প্রশিক্ষণও যে কতটা দরকারি তা কিন্ত গ্রামীণ স্বাস্থ্য পরিষেবায় থাকা স্বাস্থ্যকর্মী বা সরকারী ডাক্তারবাবুরাও জানেন। পাথরপ্রতিমা ব্লকেই অনেক গ্রামীণ ডাক্তার বলেছেন তারা প্রশিক্ষণ নিয়েছেন তাদেরই ব্লক হাসপাতালে, বি এম ও এইচ সাহেবের কাছে। এই প্রশিক্ষণও কিন্ত ৫ থেক ৭ বছর ধরে চলে। অনেক ডাক্তারবাবু প্রশিক্ষণ চলাকালীন হাসপাতালের ডাক্তারবাবুদের পাশে থেকে রুগী দেখেছেন। ব্লক হাসপাতালের ডাক্তার ট্রেনিং এর ব্যবস্থা করলেও সরকারী সার্টিফিকেট দিতে পারেননি, ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন এন জি ওর সার্টিফিকেট এর। এমন উদাহরণ কিন্ত অনেক জায়গায় দেখা যায়। গ্রামীণ স্বাস্থ্য পরিষেবায় যারা কাজ করেন তাঁরাও গ্রামের ডাক্তারদের প্রভাব অস্বীকার করতে পারেননি। গ্রামের ডাক্তারদের সহযোগিতা প্রয়োজন হয়েছে পোলিও প্রোগ্রামে। প্রথমদিকে সচেতনতার অভাবে গ্রামের মানুষেরা স্বাস্থ্য কর্মীদের ফিরিয়ে দেয়। মানুষকে পোলিওর উপযোগিতা বোঝানোর জন্য গ্রামের ডাক্তারদের ব্যবহার করা হয় এবং তা কাজেও দেয়।
এটুকু স্পষ্ট, গ্রামের ডাক্তারদের কাগজে কলমে অবৈধ করে রাখা হলেও উৎখাত করে ফেলা সম্ভব নয়। এতদিন সরকারের এই প্রসঙ্গে নীরব অবস্থান সেকথাই প্রমাণ করে। সুতরাং বর্তমান রাজ্যসরকারের প্রশিক্ষণের উদ্যোগকে বিরোধিতা করে চিকিৎসা পরিষেবা থেকে বঞ্চিত গ্রামের মানুষদের জন্য কতটা পাশে দাঁড়ানো যাবে তা কিন্ত ভাবার।
এই ডাক্তারদের প্রথাগত শিক্ষা ও মেধা হয়ত নিয়ে প্রশ্ন থাকলেও তাঁরা যে সবসময় ভুল চিকিৎসা করবেন তাও সঠিক নয়। অনেক গ্রামের ডাক্তারের মুখেই শুনেছি তাদের যুক্তি - শহরের নাম করা ডাক্তারের চিকিৎসায় ভুলের উদাহরণ অজস্র, চিকিৎসায় অবহেলার খবরও নিত্যদিন পাওয়া যায়। কাজেই এখনও তাঁরা চিকিৎসা করছেন, ভুল করলে এখনও করছেন। তাদের চিকিৎসা বন্ধ করা যাবে না, বন্ধ করতে পারলেও এই পরিকাঠাম দিয়ে কি সম্ভব হবে সব মানুষকে পরিষেবা দেওয়া? উত্তর হল - না। যদি প্রশিক্ষণ দিয়ে ভুল গুলো কে বোঝান যায় এবং সঠিক চিকিৎসার দিকটি দেখানো যায় তাও কম কি? সাধারণত কয়েকটা রোগই বেশি দেখা যায় – জ্বর – সর্দি – কাশি – রক্তাল্পতা – চোট আঘাত – ব্লাড প্রেশার – সুগার এর সমস্যা। এখনও গ্রামের ডাক্তারেরা এই ধরনের রোগের চিকিৎসা করেন, নিজের আয়ত্তের বাইরে বুঝতে পারলে নিয়ে যান বা পাঠিয়ে দেন পরিচিত স্পেশালিষ্ট ডাক্তারের কাছে। প্রশিক্ষণের পর এই ডাক্তারবাবুদের থেকে দুই রকম সুবিধা পাওয়া যেতে পারে। প্রথমত, তাদের এতদিনের চিকিৎসা কে প্রশিক্ষণের মাধ্যমে বাঁধা গতে আনা, এন্টিবায়োটিক বা স্টেরয়েডের ব্যবহার নিয়ে সচেতনতা বাড়ানো বা লাগাম টানা যেতে পারে। দ্বিতীয়ত, প্রশিক্ষণের পর এই ডাক্তারবাবুদের মাধ্যমে সাধারণ মানুষকে আরও বেশি করে হসপিটাল মুখী করা যেতে পারে। অর্থাৎ সাধারণ গ্রামীণ দৈনন্দিন চিকিৎসার উপযুক্ত প্রশিক্ষণ টুকুই তিন বছরে দেওয়া হোক, বোঝানো হোক সীমাবদ্ধতা জানানো হক পরবর্তী পদক্ষেপ হিসাবে রোগীর জন্য করনীয় কি।
এই প্রশিক্ষণের সুফল পাওয়া যাবে তখনি যখন প্রশিক্ষণের পরে গ্রামীণ স্বাস্থ্য ব্যবস্থার একটা অংশ হিসেবে এই ডাক্তারবাবুদের যুক্ত করা যাবে। অন্যথায় শুধু প্রশিক্ষণের পর সার্টিফিকেট দিয়ে ছেড়ে দিলে হিতে বিপরীত হতে পারে। প্রশিক্ষণের পর গ্রামীণ স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় তাদের অন্তর্ভুক্তি হলে সরকার তাদের উপর নজর রাখতে পারবে যেটা শুধু মাত্র সার্টিফিকেট দিয়ে ছেড়ে দিলে সম্ভব নয়। আবার অন্তর্ভুক্তি প্রক্রিয়াটিও বিরাট আলোচনা সাপেক্ষ। আশা কর্মীদের মতই তাদের গ্রামের জন্য পুরুষ স্বাস্থ্যকর্মী হিসেবে ভাবা যেতে পারে। তাদেরকে বসানো যেতে পারে গ্রামীণ স্বাস্থ্য কেন্দ্রে বা অঙ্গনওয়াড়ি সেন্টারে। বিশেষত আশা কর্মীদের যেখানে কাজের সীমাবদ্ধতা মা ও শিশু স্বাস্থ্যের মধ্যে, তাও ডাক্তারি কোন অভিজ্ঞতা ছাড়াই। সেখানে গ্রামীণ ডাক্তারদের ডাক্তারির অভিজ্ঞতা আছে সঙ্গে যদি প্রশিক্ষণ যোগ হয় তাহলে গ্রাম পর্যায়ে তাদের জনসংযোগ ব্যবহার করা যাবে। এখানেই আবার বিরুদ্ধ মত আছে, আর তা হল, গ্রামের ডাক্তারেরা ডাক্তারি করে আর্থিক দিক থেকে যতটা লাভবান ততটা লাভবান হতে পারবেন কি গ্রামে পুরুষ স্বাস্থ্যকর্মী হিসেবে কাজ করে। যদি না হন তাহলে তাঁরা রাজি হবেন কি? যদি হয়ও তাহলেও তাঁরা পরবর্তী কালে অতিরিক্ত আয়ের জন্য ব্যবস্থার মধ্যে থেকে ব্যবস্থার পরিপন্থী পথ অবলম্বন করবেন না তো? উঠে আসতে পারে মর্যাদার প্রশ্ন। প্রশিক্ষিত না হলেও তাঁরা গ্রামের ডাক্তারবাবু, তাঁরা গ্রামীণ সমাজে যে রকম সম্মান পান পুরুষ স্বাস্থ্যকর্মী হিসেবে সেই সম্মানের জায়গাটা যদি না অনুভব করেন তাহলে কি হবে? সর্বোপরি বলা যায়, গ্রামের পরিষেবা বঞ্চিত মানুষগুলোর জন্য উদ্যোগ কে গ্রহণ করাই যুক্তিযুক্ত। সঠিক পরিকল্পনা ও তার সফল বাস্তবায়ন হলে আখেরে লাভবান হবেন কয়েক কোটি গ্রামের মানুষ।
সর্বশেষ এডিট : ১৫ ই জানুয়ারি, ২০১৬ সকাল ১১:৩২