somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

মীন ধরার আখ্যান।

০৩ রা আগস্ট, ২০১৫ দুপুর ১২:০৬
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
সব্যসাচী মণ্ডল


পাথরপ্রতিমার অনিমা দাস বলছিলেন, বাড়ি বসে জলের শব্দ শুনে বলে দিতে পারেন জোয়ার না ভাঁটা’। স্বাভাবিক, শীত-গ্রীষ্মে, দীন-দুপুরের খেয়াল চলে না এই জীবিকায়। বাঁশের বাখারিতে বাঁধা মশারির মত জাল আর এলুমিনিয়ামের হাড়ি নিয়ে কখনো কমর জল তো কখনো বুক জল ঠেলে মীন ধরাতেই শেষ নয়, ডাঙ্গায় উঠে ভিজে কাপড়েই ঘণ্টাভর ঝিনুকের খোল বা বাটি নিয়ে তীক্ষ্ণ নজরে একটা একটা করে চলে মীন বাছায়। হাজার মীন ধরে কখনও মেলে ৪০০ টাকা কখন ২০০ টাকা।
সমগ্র সুন্দরবনে এক বিশাল সংখ্যক পরিবারের সংসার চলে এই জীবিকায়। কিন্ত এই মীন ধরায় ঝক্কি অনেক, বিপদ ও আছে। যেমন আইন অনুযায়ী এই সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। সুন্দরবনের জীব বৈচিত্র্য রক্ষার পরিপন্থী এই জীবিকা। মীন ধরার ঘন জালে প্রতিদিন উঠে আসছে নানা প্রজাতির মাছ, মেথি, আবর্জনা যা মীন বেছে নেওয়ার পর ডাঙ্গায় ফেলে দেওয়া হয় বেশিরভাগ সময়। নানা শামুক, বিভিন্ন প্রজাতির মাছ যেমন ধ্বংস হচ্ছে তেমনি যেখানে সেখানে নদিতে নামা, জাল টানার ফলে স্বাভাবিক পলি জমায় বাঁধা পড়ছে, ক্ষতি হচ্ছে বাঁধেরও। সরকারি আইনও আছে এর জন্য। পশ্চিমবঙ্গ সরকারের inland fisheries act 1984 যার ৪৬ এর ১ ও ২ ধারায় নদিতে বা উন্মুক্ত জলাশয়ে ১২ মিমি বা তার কম ফাঁস যুক্ত জাল টানা যাবে না বলে উল্লেখ করা আছে।
নামখানার মৌশুনি দ্বীপের পার্বতী সাহু আমার কাছেই প্রথম শুনলেন আইনের কথা আর শুনে বললেন ‘আইন না করে যদি বাঁধ করত তাহলে আর আমাদের জলে নামতে হত না। সাধ করে তো আর জলে নামিনি।’ মৌশুনি দ্বীপেরই আর এক দিদির কাছে শুনছিলাম নোনা জলে নামার কথা। আইলায় বাধ ভাঙ্গার পর চাষি পরিবারের প্রধান চলে গেল কেরালায় রাজমিস্ত্রির শ্রমিক হয়ে। তাকেও নামতে হল অন্যদের মত জাল আর হাড়ি নিয়ে নোনা জলে।
জীবিকা হিসেবে মীন ধরা সুন্দরবনের অন্যান্য জীবিকার মত প্রাচীন কিছু নয়। গত শতাব্দীর সত্তরের দশকের মাঝামাঝি সময়ে মীন ধরে জীবিকা নির্বাহের শুরু হয় সুন্দরবনের উত্তরের দ্বীপ গুলিতে। ৮০-র দশকের শুরুতে দ্রুত জনপ্রিয় হয়েছে, এর একটা কারণ হল সরকারের জঙ্গলে নজরদারির কড়াকড়ি। ওই সময় থেকেই ‘জঙ্গল-ব্যবসার’ জন্য অর্থাৎ মধু, মাছ, কাঁকড়া ধরার জন্য শুরু হয় সরকারি ‘পাস’ বা অনুমতি পত্র। বেশ কিছু টাকার বিনিময়ে মিলত সরকারি অনুমতি পত্র। বিনা অনুমতি পত্রে জঙ্গলে ধরা পড়লে ছিল অনেক টাকার ‘ফাইন’। অভাবী মানুষগুলোর কাছে তাই জঙ্গলের পরিবর্তে নদিতে মীন ধরা লাভজনক হয়ে গিয়েছিল। এছাড়া, সুন্দরবন অবস্থানগত ভাবেই দুর্যোগ প্রবণ অঞ্চল। বড় বড় প্রাকৃতিক দুর্যোগে বাধ ভেঙ্গেছে চাষের জমি নষ্ট হয়েছে আর তখনই মীন ধরে জীবিকা নির্বাহের প্রবণতা বেড়েছে। ১৯৮১ সাল, ১৯৮৮ সাল বা সাম্প্রতিক অতীতে ২০০৯ সালের আইলার পর একটা বিশাল অংশের বাধ ভেঙ্গেছে। নোনা জলে ভাসা চাষের জমি উর্বরতা হারিয়েছে। হটাত করে দুর্যোগে হারানো পরম্পরাগত জীবিকার বিকল্প হয়েছে মীন ধরা। সারাদিনে পরিবারের কয়েকজনের পরিশ্রমের ফলে অন্তত কাঁচা পয়সার আমদানি আছে।
ফিউচার হেলথ সিস্টেমস এর গবেষণা থেকে দেখা গেছে ২০০৯ সালের আইলার পর বিকল্প জীবিকার জন্য সুন্দরবনের মানুষ অনেক বেশী সংখ্যায় কলকাতা সহ নানা রাজ্যে পাড়ি দিয়েছে। পরিবারের সমর্থ পুরুষ যখন দূর দেশে অর্থ উপার্জনের চেষ্টায়, বাড়ির মহিলারা কিন্ত চুপ করে শুধু বসে থাকেনি। ঘর সংসারের কাজের ফাঁকে তারাও নানান জীবিকার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে। মীন ধরা এরকমই একটা জীবিকা, বরং বলা যায় মীন ধরায় মহিলাদেরই প্রাধান্য অনেক বেশী। দিনের পর দিন নোনা জলে মীন ধরার ফল কিন্ত ভয়ানক ভাবে আঘাত হেনেছে এই মহিলাদের শরীরে।
ফিউচার হেলথ সিস্টেমস এর নানা গবেষণায় দিদিদের সাক্ষাৎকারে উঠে এসেছে এমনি ভয়ানক ছবি। দিনের পর দিন ঘণ্টার পর ঘণ্টা নোনা জলে কাটানোর ফলে নানান চর্মরোগের শিকার হতে হচ্ছে এই মহিলাদের। পেট চালাতে গিয়ে এই মহিলারা চর্মরোগকে সাধারণত উপেক্ষা করে থাকেন ‘নোনা লেগেছে’ বলে। বাড়াবাড়ি হলে আছে গ্রামেরই স্বশিক্ষিত ডাক্তার। এখানেই শেষ নয়। দেখা গেছে কোমর কি বুক জলে দাড়িয়ে মীন ধরার ফলে মেয়েদের নানান জটিল যৌনাঙ্গের রোগের শিকার হতে হয়। গবেষণায় অংশ নেওয়া অনেক মায়েরাই জানিয়েছেন মীন ধরার ফলে তাদের অনেক মেয়েলি রোগে ভুগতে হয়েছে, অনেকে তার নিজের বা প্রতিবেশীর জরায়ুর ক্যান্সার এর কোথাও উল্লেখ করেছেন। কিন্ত মেয়েলি রোগের কথা তারা গোপন রাখতেই অভ্যস্ত। কিন্ত কেন? সহজ উত্তর হল – ‘এ আবার প্রকাশ করার মত কথা নাকি?’
সুন্দরবনের মত প্রত্যন্ত এলাকা যেখানে সরকারি ডাক্তার মেলা ভার সেখানে স্ত্রী রোগ বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের তো প্রশ্নই ওঠে না। সাধারণ অভ্যাস তাই প্রথমে প্রকাশ না করা, পরে রোগের বাড়াবাড়ি হলে গ্রামের স্বশিক্ষিত ডাক্তার ভরসা। গ্রামের ডাক্তারের কাছে এই ধরণের রোগের চিকিৎসা পরিষেবা গ্রহণে সঙ্কোচের কথাও শোনা যায় যেমন দিদিদের কাছে তেমনি ডাক্তার দের কাছেও। এরকমই একজন ডাক্তার জি-প্লটের শশাঙ্ক হালদার বলছিলেন, এই এলাকার মেয়েদের নানারকম স্ত্রী রোগের শিকার হতে দেখা যায়। বিশেষ করে যারা জলে নামে মীন ধরতে। কিন্ত সঙ্কোচে প্রথমেই ডাক্তারের কাছে আসেনা। আসে বাড়াবাড়ি হলে। তাঁর অকপট স্বীকারোক্তি সব রোগের যে চিকিৎসা আমাদের সব সময় জানা থাকে তাও না, কখনও বই পড়ে দেখে নিই, কখনও খোঁজ খবর করে রায়দিঘি কাকদ্বীপ ডায়মন্ডের স্ত্রী রোগ বিশেষজ্ঞের কাছে যেতে বলি।
সাধারণ স্ত্রীরোগ উপেক্ষা আর সঙ্কোচে যেমন ভয়ঙ্কর হয়ে ওঠে, তেমনি আবার ভুগতে হয় জরায়ুর ক্যান্সারের মত ভয়ানক রোগে। মীন ধরার মত জীবিকার ফলে শুধু জটিল স্ত্রী রোগ বা জরায়ুর ক্যান্সার নয় মৃত সন্তান বা প্রতিবন্ধী শিশুর জন্ম দেওয়ার ঘটনাও ঘটতে পারে বলছিলেন আর এক ডাক্তার হরিপদ মাইতি। একটি গ্রামে তিনি দীর্ঘ ১০ বছর প্রায় ডাক্তারি করছেন। তাঁর অভিজ্ঞতায় মীন ধরা প্রায় প্রত্যেকটি মায়েরই কোন না কোন স্ত্রী রোগ আছেই। কেন্দ্র সরকারের ডিপার্টমেন্ট অফ হেলথ রিসার্চের রিপোর্টেও উঠে এসেছে সেই তথ্য, যেখানে বলা হয়েছে সুন্দরবনের ৫৩ শতাংশ মহিলায় নানা স্ত্রীরোগের শিকার।
একদিকে নোনা জল প্রথাগত জীবিকায় ছেঁদ টেনে সুন্দরবনের মানুষকে অনিশ্চয়তায় ঠেলে দিয়েছে। অন্যদিকে সুন্দরবনের মহিলারা সেই নোনা জলে নেমে বাঁচার রসদ জোগাড়ে প্রতিদিন লড়াই করে যাচ্ছে। আইনি বাঁধা ধর্তব্যের মধ্যে পড়েনি, দরিদ্রতা, বিকল্প জীবিকার অভাব এর কারণ। কিন্ত নোনা জলের ঘা বিশাল বড় বাঁধা হয়ে দাঁড়িয়েছে তাদের ভবিষ্যৎ সুস্থ স্বাভাবিক জীবনের মাঝখানে। অনেক মহিলাই জানেন এই ঝুঁকির কথা কিন্ত এর সমাধান অন্তত তাদের কাছে নেই। সরকারি রিপোর্ট প্রমাণ করে যে তা সরকারের জানা। কিন্ত সমাধানে আগ্রহ কই? চাই বিকল্প জীবিকা, চাই উন্নত স্বাস্থ্য পরিষেবা। যতদিন না তা হয় ততদিন পর্যন্ত সুন্দরবনের মহিলাদের ভবিষ্যৎ জুড়ে রয়েছে নোনা জল আর রোগ ব্যাধি।


সর্বশেষ এডিট : ০৩ রা আগস্ট, ২০১৫ দুপুর ২:৩০
০টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

মি. চুপ্পুর পক্ষ নিয়েছে বিএনপি-জামাত; কারণ কী?

লিখেছেন সৈয়দ মশিউর রহমান, ৩১ শে অক্টোবর, ২০২৪ বিকাল ৩:৩৬


বিএনপি গত ১৬ বছর আম্লিগের এগুচ্ছ কেশও ছিড়তে পারেনি অথচ যখন ছাত্ররা গণহত্যাকারীদের হটিয়েছে তখন কেন বিএনপি চু্প্পুর পক্ষ নিচ্ছে? অনেকেই বলছে সাংবিধানিক শুন্যতা সৃষ্টি হবে তার সংগে বিএনপিও... ...বাকিটুকু পড়ুন

=এতো কাঁদাও কেনো=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ৩১ শে অক্টোবর, ২০২৪ বিকাল ৫:০৬




আয়না হতে চেয়েছিলে আমার। মেনে নিয়ে কথা, তোমায় আয়না ভেবে বসি, দেখতে চাই তোমাতে আমি আর আমার সুখ দু:খ আনন্দ বেদনা। রোদ্দুরের আলোয় কিংবা রাতের আঁধারে আলোয় আলোকিত মনের... ...বাকিটুকু পড়ুন

ব্লগারেরা প্রেসিডেন্ট চুপ্পুমিয়াকে চান না, কিন্তু বিএনপি কেন চায়?

লিখেছেন সোনাগাজী, ৩১ শে অক্টোবর, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:২৪



**** এখন থেকে ১৯ মিনিট পরে (বৃহ: রাত ১২'টায় ) আমার সেমিব্যান তুলে নেয়া হবে; সামুটিককে ধন্যবাদ। ****

***** আমাকে সেমিব্যান থেকে "জেনারেল" করা... ...বাকিটুকু পড়ুন

ফিকাহের পরিবর্তে আল্লাহর হাদিসও মানা যায় না

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ৩১ শে অক্টোবর, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:০৪




সূরা: ৪ নিসা, ৮৭ নং আয়াতের অনুবাদ-
৮৭। আল্লাহ, তিনি ব্যতীত কোন ইলাহ নাই। তিনি তোমাদেরকে কেয়ামতের দিন একত্র করবেন, তাতে কোন সন্দেহ নাই। হাদিসে কে আল্লাহ থেকে বেশী... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ্‌ সাহেবের ডায়রি ।। পৃথিবীকে ঠান্ডা করতে ছিটানো হবে ৫০ লাখ টন হীরার গুঁড়ো

লিখেছেন শাহ আজিজ, ৩১ শে অক্টোবর, ২০২৪ রাত ৯:০২




জলবায়ূ পরিবর্তনের ফলে বেড়েছে তাপমাত্রা। এতে স্বাভাবিক জীবনযাত্রা ব্যাহত হচ্ছে। তাই উত্তপ্ত এই পৃথিবীকে শীতল করার জন্য বায়ুমণ্ডলে ছড়ানো হতে পারে ৫০ লাখ টন হীরার ধূলিকণা।... ...বাকিটুকু পড়ুন

×