somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

সুন্দরবনের স্বাস্থ্য চিত্র

০২ রা জুন, ২০১৫ বিকাল ৫:১৩
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

প্রথম পর্ব – অরন্যে রোদন

বছর দুয়েক আগের কথা। পাথরপ্রতিমা ফিরতে হবে, ইন্দ্রপুর ঘাটে বসে আছি। বিকেল ৪ টের শেষ সার্ভিস যাতে না হারায় তাই বেশ খানিকটা আগেই ঘাটে পৌঁছে গেছি। জলে ডুবু ডুবু বানী জঙ্গলের দিকে তাকিয়ে কি ভাবছিলাম তা আজ আর মনে পড়ে না।
“তা... বাবুর বাড়ি কোথায়?”
পাশে বসা লোকটির প্রতি খেয়াল হল। ঢালু কপাল, গালের হাড় উচু, চোখ কিছুটা বসা। মাথার সামনের দিকে চুল পড়ে গেছে। দড়ির মত পাকানো শরীর। মুখ বা শরীর দেখে বয়স আন্দাজ করা যায় না। মাঝ বয়সের বলেই মনে হয়।
বাড়ি কলকাতা শুনে যে ভঙ্গিতে তিনি ‘হুম’ বললেন যেন এটাই আশা করেছিলেন। জানতে চাইলেন – “কার ঘরে আশা হয়েছিল?”
আমি যে কারও ঘরে আত্মীয় হয়ে আসিনি এটা তে তার মুখে কোন ভাবান্তর চোখে পড়েনি। স্বাস্থ্য নিয়ে গবেষণা করি শুনে তিনি অবাক হলেন। দুচার কথার পরেই এসে গেল আইলা প্রসঙ্গ। ভদ্রলোকের নাম মনে আছে, সনাতন জানা। তার মুখে শুনছিলাম দুর্যোগের কথা। আইলারও তিন বছর পরের কথা। আইলায় ভাঙ্গা বাঁধ তার চাষের জমি নষ্ট করেছিল। তার বাড়ি ভেঙেছিল। পরের তিন বছরেও কাজ হয়নি ৬০০ মিটার ভাঙ্গা বাঁধের। জমি অধিগ্রহণ, ক্ষতিপূরণ, কংক্রিট না বালির বস্তা – এই নিয়ে গ্রামে রাজনীতি হয়েছে খুব কিন্ত বাঁধ হয়নি একটুকুও। ফসল ফলিয়ে সংসার চালান কৃষক মানুষটি পরের তিন বছরে মীন ধরে গ্রামে-গ্রামের বাইরে দিন মজুরি করে আবার ছিটে বেড়ার বাড়ি করেছে। দুই মেয়ের পর আরও এক ছেলে হয়েছে। সনাতন জানা চেয়েছে শুধু বাঁধ টা হয়ে যাক। প্রতি মাসের কোটালের জল যদি আটকানো যায় তবে ধীরে ধীরে সে আবার ফসল ফলাবে জমিতে।
“ভাদ্র মাসের ভরা কোটালের সময়। সন্ধ্যের পর হাওয়ার দাপট বাড়তে বাড়তে ঝড়ে পরিণত হল। অল্প কিছুক্ষনের মধ্যে প্রবল হাওয়ার সঙ্গে জল ফুলে উঠে আছড়ে পড়তে লাগল বাড়ির কাছেই। বিপদ বুঝে চাল ডালের বস্তা মাথায় আর ২ বছরের ছোটো ছেলেকে কোলে নিয়ে লাগালাম ছুট। স্কুল ঘর অনেক দূরে কিন্ত যত দূর এগিয়ে যাওয়া যায়। পিছনে একটু বড় দুই মেয়েকে নিয়ে বউ। ঝড় আরও বেড়ে গেল, এই বড় বড় ঢেও ধরে ফেলল। মাথার জিনিস ফেলে ছেলেটাকে জড়িয়ে রাস্তার ধারে একটা গাছে জড়িয়ে ধরে থাকলাম। অন্ধকারে খেয়াল করলাম বউ আর একটা গাছ জড়িয়ে। মেয়ে দুটো মাকে জড়িয়ে ধরে আছে। ঝড় কমে গেল, বড় বড় ঢেও নেই, কিন্ত জল তখনও ঢুকছে। সেই জল সাতরে কোন রকমে স্কুল পর্যন্ত আসতে পারি সেবার। সেবারে সব ভেসে গিয়েছিল আমার।
২ দিন পর ছেলেটার ডাইরিয়া শুরু হল। আমাদের এখানে হরিপদ ডাক্তার, উনিই ভরসা। তখন উনার খুব চাপ। একদিনেই শরীর ঠাণ্ডা হয়েগেল। রাত্রে বেলা ডাক্তার এল স্যালাইন নিয়ে কিন্ত ভেন খুজে পেল না। মাঝ রাত্রে ডাক্তার বললে পাথরে(পাথরপ্রতিমা) নিয়ে যাও। সেই রাত্রে বলে কয়ে কোনরকমে একটা নৌকো ঠিক করলাম। কিন্ত পাথরে পৌঁছানর আগেই ছেলেটা চলে গেল। ...আমার তো একরকম... কিন্ত বউটা এখন মাঝে মাঝে কাঁদে।”
আমার মনে হল তার চেহারাতেও বিকৃতির ছাপ, কান্নার আগের মুহূর্তে যেমন হয় আর কি। নৌকা এসে গেছে। ফিরতে হবে। দূরে ঘাটে বসে থাকা মানুষটির চোখে চিক চিক করে ওঠা জল মনে করিয়ে দিল আর একটি মুখকে, যে এখনো নদীর ধারে ভাঙ্গাচোরা ঘরে কি উঠোনে একাজ সেকাজের ফাকে কেদে ওঠে চোখ মুছে নেয়।
সবুজ অরন্যের সুন্দরবন, কিন্ত এখানকার মানুষের কথা বরং অনেক ধূসর। সনাতন জানার মত পরিস্থিতির স্হবীকার হতে হয় সুন্দরনবাসীদের প্রায় নিয়মিত। সুন্দরবনের ভৌগলিক বিশেষত্ব, এখানকার মানুষের জীবন-জীবিকার বিশেষ চিত্র বাকি বাংলার থেকে আলাদা। জীবিকার স্থিতি নেই। নোনা জলের থেকে চাষের জমি বাচানর লড়াই, কাঁকড়া মধুর জঙ্গলের অধিকার নিয়ে বাঘের সঙ্গে লড়াই। চাষের জমি বাঁচাতে রুগ্ন বাঁধ আর নোনা জলের সঙ্গে লড়াই। সুন্দরবনের মানুষের এটাই স্বাভাবিক জীবন। সনাতন জানার মত মানুষেরা জীবন যাপনের এই লড়াই থেকে পিছিয়ে আসেনি কখনও। কিন্ত এরাও অসহায় হয়ে পড়ে যখন সুচিকিৎসার চাহিদা প্রবল হয়ে ওঠে। সুচিকিৎসার চাহিদা অন্ন বস্ত্র বাসস্থানের মত প্রতিদিনকার নয়, কিন্ত প্রত্যক্ষ ভাবে বাঁচা মরার প্রশ্ন।
যে কোন জনগোষ্ঠীর জন্য শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খুব গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। কিন্ত এই বিশেষ অঞ্চলের মানুষের জন্য স্বাস্থ্য ব্যবস্থা মোটেই বিশেষ কিছু নয়। স্বাস্থ্য ব্যবস্থা আছে কিন্ত সেখানে নেই এর তালিকা দীর্ঘ। নদী নালা দ্বীপ পেরিয়ে হাসপাতাল, কিন্ত ডাক্তার নেই, ওষুধ নেই, পরীক্ষা নিরীক্ষার ব্যবস্থা নেই। পাস করা ডাক্তার সহজে আসতে চান না নোনা গাং পেরিয়ে। মানুষের অসুখ বিসুখের চিকিৎসা গ্রামের স্বশিক্ষিত ডাক্তারের হাতে। অনেক ছোটো খাটো রোগ শরীরে পুসে রাখা, সরদি কাসিতে চান না করে সরষে তেল মাখা, উপোষ করে জ্বর পালানোর অভ্যাস করে নেয় এরা দিনে দিনে।
কয়েক বছরধরে সুন্দরবনের নানা জায়গায় চলা ফিউচার হেলথ সিস্টেমস এর গবেষণা এখানকার স্বাস্থ্য-চিত্রের দৈন্যতাকেই তুলে ধরেছে। সুন্দরবনের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম, অর্থাৎ শিশুদের স্বাস্থ্য কি ভালো জায়গায় আছে? না কি আশঙ্কা করার মত যথেষ্ট কারণ রয়েছে বাংলার এই প্রান্তের শিশু ও তাদের মায়ের স্বাস্থ্য নিয়ে? স্বাস্থ্য পরিষেবা কি সহজলভ্য, নির্ভরযোগ্য? গবেষণা থেকে প্রকাশিত তথ্য কিন্ত বলে আশঙ্কার কারণ অনেক। ভাববার মত আলচনা করবার মত বিষয়ও অনেক। পর্যায়ক্রমে সেই চিত্র তুলে ধরা হবে। কিন্ত আপাতত এটুকু বলাই যায় যে সুন্দরবনের মানুষ ঝড় জল দুর্যোগের সঙ্গে লড়তে পারে বাঘ কুমিরের সাথে লড়তে পারে তার জন্য তার সংসারের জন্য, কিন্ত রোগ-ভোগে তারা অসহায়, কান্না ছাড়া পথ থাকে না। সুন্দরবনের মানুষের দীর্ঘদিনের এই কান্না আক্ষরিক অর্থেই অরন্যে রোদন হয়ে যায়।

সব্যসাচী মণ্ডল

সর্বশেষ এডিট : ১১ ই জুন, ২০১৫ দুপুর ১:১৬
০টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

মি. চুপ্পুর পক্ষ নিয়েছে বিএনপি-জামাত; কারণ কী?

লিখেছেন সৈয়দ মশিউর রহমান, ৩১ শে অক্টোবর, ২০২৪ বিকাল ৩:৩৬


বিএনপি গত ১৬ বছর আম্লিগের এগুচ্ছ কেশও ছিড়তে পারেনি অথচ যখন ছাত্ররা গণহত্যাকারীদের হটিয়েছে তখন কেন বিএনপি চু্প্পুর পক্ষ নিচ্ছে? অনেকেই বলছে সাংবিধানিক শুন্যতা সৃষ্টি হবে তার সংগে বিএনপিও... ...বাকিটুকু পড়ুন

=এতো কাঁদাও কেনো=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ৩১ শে অক্টোবর, ২০২৪ বিকাল ৫:০৬




আয়না হতে চেয়েছিলে আমার। মেনে নিয়ে কথা, তোমায় আয়না ভেবে বসি, দেখতে চাই তোমাতে আমি আর আমার সুখ দু:খ আনন্দ বেদনা। রোদ্দুরের আলোয় কিংবা রাতের আঁধারে আলোয় আলোকিত মনের... ...বাকিটুকু পড়ুন

ব্লগারেরা প্রেসিডেন্ট চুপ্পুমিয়াকে চান না, কিন্তু বিএনপি কেন চায়?

লিখেছেন সোনাগাজী, ৩১ শে অক্টোবর, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:২৪



**** এখন থেকে ১৯ মিনিট পরে (বৃহ: রাত ১২'টায় ) আমার সেমিব্যান তুলে নেয়া হবে; সামুটিককে ধন্যবাদ। ****

***** আমাকে সেমিব্যান থেকে "জেনারেল" করা... ...বাকিটুকু পড়ুন

ফিকাহের পরিবর্তে আল্লাহর হাদিসও মানা যায় না

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ৩১ শে অক্টোবর, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:০৪




সূরা: ৪ নিসা, ৮৭ নং আয়াতের অনুবাদ-
৮৭। আল্লাহ, তিনি ব্যতীত কোন ইলাহ নাই। তিনি তোমাদেরকে কেয়ামতের দিন একত্র করবেন, তাতে কোন সন্দেহ নাই। হাদিসে কে আল্লাহ থেকে বেশী... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ্‌ সাহেবের ডায়রি ।। পৃথিবীকে ঠান্ডা করতে ছিটানো হবে ৫০ লাখ টন হীরার গুঁড়ো

লিখেছেন শাহ আজিজ, ৩১ শে অক্টোবর, ২০২৪ রাত ৯:০২




জলবায়ূ পরিবর্তনের ফলে বেড়েছে তাপমাত্রা। এতে স্বাভাবিক জীবনযাত্রা ব্যাহত হচ্ছে। তাই উত্তপ্ত এই পৃথিবীকে শীতল করার জন্য বায়ুমণ্ডলে ছড়ানো হতে পারে ৫০ লাখ টন হীরার ধূলিকণা।... ...বাকিটুকু পড়ুন

×