বাংলা সাহিত্যের বিশাল জগতে মৌলিক গোয়েন্দা কাহিনী প্রায় নেই বললেই চলে, বেশির ভাগই বিদেশী গল্পের ছায়াবলম্বনে লেখা, সেদিক থেকে অন্যতম জনপ্রিয় চরিত্রের কথা বলতে গেলে প্রথমেই আসবে অবশ্যই সত্যজিৎ রায়ের 'ফেলুদা'!
সত্যজিতের চোখে যেমন দেখতে ফেুলদা ও তপেশ
সব বয়সের, সব সময়ের, সব মানুষের কাছে সমান জনপ্রিয় 'ফেলুদা'র গল্পের প্রতিটি কাহিনীই কিন্তু মৌলিক। আর এই গল্প গুলো বাংলা ভাষা ছাড়াও আরও পাঁচটা ভারতীয় এবং চারটা বিদেশী ভাষায় অনূদিত হয়েছে, সুতরাং বলা যায় ভিন্ন ভাষাভাষিদের কাছেও ফেলু মিত্তিরের কদর নেহায়েত কম নয়!
১৯৬৫ থেকে ১৯৯১ মোট ২৬ বছর ধরে লেখা হয়েছে ফেলুদার গোয়েন্দা কাহিনী গুলো, এবং সব গুলোই তার অন্যতম সহকারী ও রহস্য অভিযানের সংঙ্গী জ্যাঠতুতো (শেষ দিকে তাকে বলা হয়েছে পিসতুতো) ভাই 'তোপেশ' এর জবানীতে লেখা, অনেকটাই শার্লক হোমসের মতন।
তীক্ষ বুদ্ধির, হ্যান্ডসাম গোয়েন্দা প্রদোষ চন্দ্র মিত্র ওরফে প্রদোষ সি মিটার ওরফে ফেলু মিত্তির ওরফে ফেলুদার বয়স ২৭ আর তার সহকারী তপেশ রঞ্জন মিত্র মানে তপশের বয়স ১৩ বছর! মজার ব্যাপার হলো মোট ২৬ বছর ধরে লেখা ফেলুদা কাহিনীর শেষ পর্যায়ে এসে ফেলুদার বয়স ৩৫ বছর হলেও,বেচারা তপেশ সেই ১৩ তেই আটকে গিয়েছিল!!
ফেলুদার এডভেঞ্চারের আরেক জন সঙ্গী হলেন 'রহস্য-রোমাঞ্চ' সিরিজের জনপ্রিয় লেখক লালমোহন গাঙ্গুলি, যিনি কিনা জটায়ু ছদ্মনামে 'হান্ডুরাসে হাহাকার' কিংবা 'ভ্যাংকুবারে ভ্যাম্পায়ার' টাইপের দূর্ধষ সব কাহিনী লেখেন আর সবুজ রং এর এম্বেসডর গাড়ি চড়ে ঘুরে বেড়ান! তার আবার একটা শখও আছে, প্রায় প্রতি অভিযানে বের হবার সময়ে সঙ্গে করে নিয়ে নেন বিচিত্র সব অস্ত্র, এর মধ্যে অস্ট্রেলিয়ান বুমেরাং থেকে শুরু করে ভেজালী পর্যন্ত আছে, যদিও কাজে সেগুলো লাগাতে পারেন না ঠিকঠাক ভাবে!
শুরুর গল্পে জটায়ুকে চশমা পরা আর গোঁফ বিহীন একেছিলেন সত্যজিত, পরের দিকে সব বইতেই আবার তার গোঁফ আছে, যেটা ট্রেড মার্কের মতো হয়ে গিয়েছিল!
বেটে খাট, টাক মাথা মজার চরিত্রের জটায়ু অবশ্য শুরুর দিকের গল্প গুলোতে ছিলেন না, তাকে প্রথম দেখা যায় 'সোনার কেল্লা' গল্পতে! এরপর থেকে প্রতি সিরিজেই তিনি আছেন ফেলুদা সিরিজের একজন অবশ্যক চরিত্র হিসেবে।
তবে আমার কাছে মাঝে মাঝে মনে হয়, ফেলুদার চরিত্র রূপায়নে সত্যজিৎ রায় কি শার্লক হোমসকে অনুসরন করেছেন? কেন বলছি এ কথা? ভাল করলে খেয়াল করলে দেখা যাবে হোমসের সাথে বেশ অনেক কিছুই মিল আছে ফেলু মিত্তিরের............এরা দু'জনেই তামাক প্রিয়, হোমসের প্রিয় জিনিস পাইপ, ফেলুদার চারমিনার, হোমস সব সময়ে সাথে রাখতেন প্রিয় পিস্তল A Webley Bulldog, আর ফেলুদা কোল্ট!
হোমস যে কোন গভীর সমস্যায় পরলে পরামর্শের জন্য সাহায্য চাইতেন ভাই মাইক্রফট হোমসের কাছে, আর ফেলুদা নিতেন তাদের গ্রাম সম্পর্কিয় সিধু জ্যাঠা'র কাছ থেকে, দু'জনাই আকৃতদার, বেহোমিয়ান ধরনের, সমস্যার সমাধানে দু'জনাই অস্ত্রের চাইতে মেধা আর বুদ্ধ বিশ্লেষণকে ব্যবাহর করেছেন বেশি!
ফেলুদা ইন এ্যকশন! তিনি আবার জুজুৎসুতে ব্লাক বেল্ট সেই সাথে ভোরে নিয়মিত যোগ ব্যায়মও করেন
যাই হোক, ফেলুদা সিরিজের প্রথম গল্পটি ছিল ১৯৬৫ সালে লেখা "ফেলুদার গোয়েন্দাগিরি", এটা ছোট গল্প ধরনের ছিল। এরপরের বছর লিখেলেন "বাদশাহী আংটি" মূলত: এখান থেকেই ফেলু মিত্তিরের হিট হওয়া শুরু হয়!
শুরুর দিকে সত্যজিৎ রায় বছরে একটা করে 'ফেলুদা' লিখতেন, পরে এর জনপ্রিয়তা এতই বেড়ে যায় যে, তাঁকে বছরে কমপক্ষে ২টা, মাঝে মাঝে ৩টাও লিখতে হয়েছিল; যেমন, ১৯৮৯ সালে একটানা ১১ দিনে তিনি তিনটা কাহিনী লেখেন, 'ড: মুনশীর ডায়েরী,' গোলাপী মুক্তো রহস্য' আর 'লন্ডনে ফেলুদা!'
ছদ্মবেশে তিন জন
ফেলুদার গল্প গুলো যারা পড়েছেন তারা নিশ্চয়ই এক বাক্যে মেনে নেবেন যে গল্প গুলোর একটা বড় আকর্ষণ হলো গল্প গুলোতে রহস্যের পাশাপাশি দেশ ভ্রমনেরও একটা স্বাদ পাওয়া যায়!
এ প্রসঙ্গে সত্যজিৎ রায়ের ছেলে সন্দীপ রায় লিখেছন --------
"ফেলুদার যাওয়া সব জায়গাতেই বাবা কোন না কোন সময়ে গেছেন।
দার্জিলিং ছিল বাবার খুব প্রিয় জায়গা, সুতরাং তাঁর প্রথম মৌলিক চিত্রনাট্য 'কাঞ্চনজঙ্ঘা' আর প্রথম ফেলুদা এই প্লটেরই হবে, এটাই স্বাভাবিক।
আর ওঁর ছোটবেলায় ঘোরা লখনৌ ও কাশ্মীরের স্মৃতি থেকে লেখা হয়েছিল 'বাদশাহী আংটি' ও 'ভুস্বর্গ ভয়ংকর'।
ম্যানিলায় প্রথম ফ্লিম ফেস্টিভ্যালে যাবার পথে হংকং দেখে মুগ্ধ হয়ে ফিরে এসে লিখলেন 'টিনটোরেটর যীশু'!
এছাড়া সত্যজিৎ এর ফ্লিমের জীবনের সাথেও খুব কাছাকাছি জড়িয়ে ছিল ফেলুদা! যেখানেই তিনি শ্যুটিং করেছেন, ফিরে এসে সেই এলাকার পটভূমিকায় লিখেছেন একটা করে ফেলু কাহিনী, যেমন------সিকিমের উপরে একটা প্রামাণ্য চিত্র করার পরই লিখলেন 'গ্যাংটকে গন্ডোগল', জয়সলমীর আর সিমলায় গুপী গাইন-বাঘা বাইন' শ্যুটিং এর পরে জন্ম নিল 'সোনার কেল্লা' ও 'বাক্স রহস্য', বেনারসে 'অপরাজিতের' পরে 'জয় বাবা ফেলুনাথ' আর নেপালে 'হীরক রাজার দেশে' করার পরে লিখেছিলেন 'যত কান্ড কাঠমুন্ডুতে'!
জনপ্রিয় এই গোয়েন্দাকে নিয়ে সিনেমা হবে না; তাকি হয়! তাই বইয়ের পাশাপাশি ফেলুদা চলে এসেছিল সিনেমার পর্দাতেও আর সেখানেও সে যথারিতী হিট!
এখন পর্যন্ত সিনেমায় ফেলুদার চরিত্রে অভিনয় করেছেন মোট তিন জন, শশী কাপুর, সৌমিত্র এবং সব্যসাচী চক্রবর্তী, তবে আমার কাছে সব্যসাচীকেই সব চাইতে এপ্রোপিয়েট মনে হয়েছে ফেলুদা হিসেবে। জটায়ু করেছেন সন্তোষ দত্ত আর বিধু ভট্টাচার্য, এখানে আমার কাছে বিধু মশাইকে দূর্দান্ত লেগেছে সব কিছু মিলিয়ে!
সব কথার শেষ কথা হলো, ফেলুদা সিরিজ যারা পড়েনি তারা ঠকেছে, এটা অবশ্য আমার বক্তব্য নয়, লিলা মজুমদারের, আমিও তাঁর সাথে একমত।
পড়তে পড়তে পড়তে ভর্তা বানিয়ে ফেলসি বই গুলা
যদিও আমি বই কিনে বই পড়ার পক্ষে, তবুও ফেলুদার অল্প কয়েটা গল্পের অনলাইন ভার্সন দিলাম এখানে.....
১। বাদশাহী আংটি
২। ছিন্নমস্তার অভিশাপ, সোনার কেল্লা আর গোলাপি মুক্তা রহস্য
৩। জাহাঙ্গীরের স্বর্ণমুদ্রা
৪।ঘুরঘুটিয়ার ঘটনা
৫।গ্যাংটকে গন্ডোগোল
৬।গোঁসাইপুর সরগরম
৭। রবার্টসনের রুবি
আর যারা সিনেমা দেখতে ভালবাসেন তাদের জন্য রয়েছে ব্লগার পুশকিনের চমৎকার একটা পোস্ট, এখান থেকে ফেলুদার সব সিনেমার গুলোর ডাউনলোড লিংক পেয়ে যাবেন.........
সত্যজিৎ এর ফেলুদা ও আমার ভাবনা,সাথে ফেলুদার সকল মুভির ডাউনলোড লিংক
আর যদি শুয়ে বসে শুধু শুনতে চান গল্প গুলো তাহলে বেশ কিছু গল্পের অডিও লিংক পাবেন এখানে......
সত্যজিতের ‘ফেলুদা’ সমগ্র : এখন পর্যন্ত প্রকাশিত সকল সিনেমা, ইবুক,কমিকস্, অডিও নাটক এর মেগা কালেকশন
রেডিও মিরচি
গোয়েন্দা ফেলু মিত্তিরের সাথে সবার সময় ভাল কাটুক!
সকলকে ব্লগ দিবস আর নতুন বছরের আগাম শুভেচ্ছা,
দিন গুলো এবং রাত গুলোও চমৎকার কাটুক, নিরাপদে থাকুন........
লেখার তথ্যসূত্র:
সন্দীপ রায়: সন্দেশ, 'ফেলুদার বিশেষ সংখ্যা, ১৪০২।
লীলা মজুমদার: সন্দেশ, 'ফেলুদার বিশেষ সংখ্যা, ১৪০২।
সর্বশেষ এডিট : ১৮ ই ডিসেম্বর, ২০১২ রাত ১২:০২