গতকাল প্রথম আলোর নকশা খুলে দেখি পান্তা ভাত রাঁধার রেসিপি দেয়া হয়েছে...."গরম ভাত রান্না করে এতে পরিস্কার পানি ঢেলে ঢেকে রাখতে হবে!!"
দেখে একটু ভ্যাবাচেকা খেলাম, তবে সেটাই শেষ না, এরপর গেলাম মীনা বাজার মাছ কিনতে, দেখি দুই কেজি বা দেড় কেজির মত এক একটা ইলিশ মানুষ হাসিমুখে ৩৩৫০ টাকা দিয়ে কিনে নিয়ে যাচ্ছে!!
তবে আমার মত নাদান পাবলিক ভেবাচ্যাকা খেলেই কি আর না খেলেই কি, চলে এলো পয়েলা বৈশাখ, এবার শুরু হবে গরম ভাতে পানি ঢেলে পান্তা এবং সেই সাথে ইলিশ, নানা রকম খরচান্ত ভর্তা খাবার আর সাদা লালে নিজেকে রাঙ্গিয়ে দেবার দিন।
বাঙ্গালী উৎসব প্রিয় জাতি! তাই একুশে ফেব্রুয়ারী থেকে শুরু করে স্বাধীনতা দিবস সব কিছুই আজ একদিক থেকে উৎসবের দিনে রূপান্তরিত হয়ে গেছে! যদিও এই দিন গুলোর তাৎপর্য কি, সেটা জানতে চাইলে অনেকেই আকশপাতাল চিন্তায় পরে যায়! যাই হোক, সে কথায় আমরা আর না গেলাম!
এতে করে অবশ্য আমাদের পোষাক শিল্পের বিকাশ হচ্ছে, এইবা কম কিসে! একুশে ফ্রেব্রুয়ারীতে সব ফ্যাশান হাউজে সাদা-কালো, স্বাধীনতা আর বিজয় দিবসে লাল সবুজ আর পয়েলা বৈশাখে সাদা লালা ড্রেস বিক্রীর ধুম! কোন একদিন হয়তো দেখবো, ২৫ শে মার্চ উপলক্ষে সব কালো পোষাকের প্রচলন হলো বলে!
গত শুক্রবার আড়ং গিয়ে আমি ভিরমী খেয়ে গেলাম, এত্ত ভির যে সেলস গার্লদের সুললিত কন্ঠ গ্রাহকদের নিজের মানিব্যাগ, মোবইল, আর বাচ্চা সামাল দেবার কথা ঘোষণা দিতে হচ্ছে! এইটা কি কোরবানীর ঈদ না রোজার ঈদ ঠিক বুঝে উঠতে পারছিলাম না! পরে ঠেলে ঠুলে অতি কস্টে ভেতরে ঢুকে দেখি সব ড্রেস হলো লাল আর সাদা, তখন মনে পরলো; ওহ সামনেই তো পয়েলা বৈশাখ।
নিজেকে তাই ঘোর বাঙালী সাজাতে মানুষষের এত আয়োজন!
কালের পরিক্রমনে অনেক সংস্কৃতির গ্রহণ বর্জনে আমাদের মূল সংস্কৃতির কি কিছুটা পরিবর্তন হয়েছে অবশ্যই!
কিন্তু তাই বলে আসলেই কি পান্তা ইলিশ আর লালা পাড় সাদা শাড়ি আমাদের আদি আদর্শ বাঙালী খাদ্যাভাস ও বেশবিন্যাস রীতিতে ছিল?
ইতিহাস কি বলে?
ইতিহাসের জন্ম থেকে যে দেশের প্রথম ও প্রধান উৎপন্ন বস্তু ধান, সে দেশে প্রধান খাদ্যই তাই হবে এটাই স্বাভাবিক! ভাত খাবার এই অভ্যাস ও সংস্কার আস্ট্রিক ভাষী আদি-অস্ট্রীয় জনগোষ্ঠীর সভ্যতা ও সংস্কৃতির দান! সমাজের উচ্চবিত্ত থেকে নিম্নবিত্ত সকল স্তরের লোকের প্রাধান খাদ্য ছিল ভাত, হয়তো রান্নার পদ্ধতিতে কিছুটা তারতম্য হতো!
চতুর্দশ শতকের শেষ ভাগের একটা বই প্রাকৃত পৈঙ্গল গ্রন্থে বলা হয়েছে,
"ওগগারা ভত্তা গাইক ঘিত্তা"
মানে হলো খাটি ঘি সহযোগে গরম ভাত!
নৈষধচরিতে ভাতের আরও ডিটেইলস বর্ণনা আছে, "পরিবেশিত অন্ন হইতে ধুম উঠিতেছে, তাহার প্রতিটি কনা অভগ্ণ, একটি হইতে আরেকটি বিচ্ছিন্ন! সে অন্ন সুসিদ্ধ, সুস্বাদু আর শুভ্রব্ণম সরু ও সৌরভময়!
এসব কিছু থেকে এটা অনুমান করা যায় যে, বাঙ্গালীর রীতি ছিল গরম ফেনায়িত ভাত ঘি সহযোগে খাওয়া!
এতো গেলো ভাত, ভাতের সঙ্গে তারা আর কি খেতো?
"ওগগারা ভত্তা রম্ভঅ পত্তা গাইক ঘিত্তা দুদ্ধ সজুক্তা
মোইলি মচ্ছা নালিত গচ্ছা দিজ্জই কান্তা পুনবস্তা!"
মানে হলো সে রমনী কলাপাতায় গরম ভাত, গাওয়া ঘি, মৌরলা মাঝের ঝোল, নালিতা মানে পাট শাক প্রতিদিন পরিবেশন করতে পারেন, তার স্বামী পূণ্যবান!
মোট কথা ভাত সাধারণত খাওয়া হতো শাক সহযোগে! নিম্নবিত্তের প্রধান খাবারই ছিল শাক!
তবে খাদ্য তালিকায় মাছেরও একটা গুরুত্বপূর্ণ অবস্থা ছিন। মাছে ভাতে বাঙ্গালী নাম তো আর এম্নি এম্নি হয়নি! নদী বহুল বাংলায় স্বাভাবিক ভাবেই মাছ খাদ্য তালিকায় অন্যতম জায়গা করে নিয়েছিল! তবে বাঙ্গালীর এই মৎস প্রীতি আর্য সভ্যতার সংস্কৃতি কোনদিন সুনজরে দেখেনি!বিশেষ করে খ্রী: পূ: ষষ্ঠ-পঞ্চম শতক হতেই খাদ্যের জন্য প্রাণীহত্যার ব্যাপারে ব্রাক্ষন ধর্মে একটা নৈতিক আপত্তি ক্রমে মাথাচারা দিয়ে উঠছিল! সে অপত্তির ঢেউ যে বাঙলা দেশেই লাগেনি সেটা নয়, তবে বাঙালীর বহুদিনের অভ্যাসের সাথে ধর্মীয় বিধান সেদিন পেরে উঠতে পারেনি। তখন ভবদেব ভট্ট আর অন্যান্য শাস্ত্রকারগণ নানা রকম সুদীর্ঘ আলোচনার পরে এই সিদ্ধান্তে আসেন যে, কোন রকম তিথি, চতুর্দশী, পর্ব ইত্যাদি ছাড়া মাছ খাওয়া চলবে!
নববর্ষ কিন্তু একটা তিথি, তার উপর এই সময়টা ইলিশের প্রজনন হয় সেটা তারা মাথায় রাখা উচিত আমাদের!
বৃহধর্মপুরান মতে রোহিত (রুই), শফর (পুটি), সকুল (সোল) এবং শ্বেতবর্ণ ও আঁশ যুক্ত মাছ খাওয়া যাবে! প্রাণীজ আর উদ্ভিজ্জ তেলের বিবরণ দিতে গিয়ে জীমুতবাহন ইল্লিস (ইলিশ) এর তেলের কথা বলেছেন!
এখন বৈশাখে বেশ আয়োজন করে শুটকি ভর্তা খেলেও, আদি বাঙ্গালিদের শুটকি আর পঁচা মাছ খাওয়া শাস্ত্রীয় ভাবে নিষেধ ছিল! তবে নিম্নকোটির বাঙ্গালীরা নাকি শুটকি বা সিহুলী খেতে ভালবাসতো!অবশ্য শামুক, কাকড়া, বক, মোরগ, সারস, হাঁস, উট, গরু শুকর ইত্যাদির মাংস খাওয়াও নিষিদ্ধ ছিল !
আমাদের বহু প্রিয় খাদ্য আলু ভর্তা। বাংলায় আলুর আগমন কিন্তু বেশি দিনের নয়, মধ্যযুগে পর্তুগিজদের কল্যাণে এই প্রবল জনপ্রিয় খাদ্যটি আমাদের খাদ্য তালিকায় ঢুকে পরলো, তার আগে এর কোন অস্তিত্বই ছিল না!
এবার দেখি কেমন ছিল প্রাচীন বাংলার নারী পুরুষের সাজগোজ!
পুরুষেরা পরতেন ধুতি আর মেয়েরা শাড়ি। তবে সেই ধুতি আর শাড়ি পড়ার স্টাইল অবশ্য আজকের দিনের মতোন ছিল না। ছেলেদের ধুতি ছিল দৈর্ঘ্য ও প্রস্থে বেশ ছোট, হাটুর নীচে নামতো না লম্বায়। মেয়েরা শাড়ি কুঁচি দিয়ে শাড়ি পড়েলও দেহের উর্ধাঙ্গ ঢাকতে সেই শাড়ির আচল ব্যাবহার করতো না। উর্ধাঙ্গে ব্যবহার করতো কাচুলি কিংবা ওড়না!
নর্তকী শ্রেণীর নারীরা পরতেন পায়ের কন্ঠা পর্যন্ত লম্বা আটোসাটো পাজামা আর দেহের উর্ধাঙ্গে লম্বা উড়না!
বিবাহিত মেয়েরা সাজ করার সময়ে কপালে পরতেন কাজলের কালো টিপ, সিঁথিতে সিঁদুর, পা রাঙাতেন লাক্ষারস দিয়ে, ঠোঁট লাল হতো সিঁদুরে আর দেহ ও মুখন্ডল প্রসাধনে চন্দনের গুড়ো, মৃগনাভি, জাফরান ইত্যাদি!
এখনকার মতো তখনও নারীদের সৈন্দর্য্য চর্চায় ফুলের প্রবল আধিপত্য ছিল! নারীরা গলায় ফুলের মালা পরতেন, মাথার খোপায় ফুল গুজতেন!
নারায়ন পালের ভাগলপুর লিপিতে একটা লাইন আছে "বুকের বসন স্থানচুত্য হয়ে পড়াতে লজ্জায় আনতনয়না নারী লজ্জা নিবারণ করছেন তার গলার ফুলের মালা দিয়ে!"
রাজশেখর তার কাব্যমিমাংসা গ্রন্থের তৃতীয় অধ্যায়ে প্রাচ্য জনপদবাসীদের দৈনন্দিন প্রসাধনের বর্নণায় বলেছেন... "বুকে আর্দ্র চন্দন, গলায় সুতার হার, সীমান্ত পর্যন্ত আনা শিরোবসন, অনাবৃত বাহুমুল। গায়ে আগুরু -প্রসাধন! গায়ের রং যেন "কচি ঘাসের ডগার মতোন শ্যাম"...এই হলো গৌড়াঙ্গানাদের আসল চেহারা!
আবার সদুক্তিকর্ণামৃতধৃত নারীদের বেশভুষার আরও বিস্তৃত বিবরণ পাওয়া যায়!
বাস: সূক্ষং বপুষি ভুজয়ো; কাঞ্চনী চাঙ্গদশ্রীর
মালাগর্ভ: সুরভি মসৃনৈগন্ধতৈলৈ: শিখন্ড:।
কর্ণোত্তংসে নবশশিকলালির্মলং তালপত্রং।
বেশং কেষাং ন হরতি মনো বঙ্গবারাঙ্গনাম!
অর্থাৎ দেহে পাতলা সূক্ষবসন, বাহুতে সোনার বাজুবন্ধ, সুগন্ধী তৈল চর্চিত কেশ মাথার উপর চুতো করে বাঁধা, তাতে আবার ফুলের মালা জড়ানো, কানে নতুন চাঁদের মতো ঝকঝকে তাল পাতার গয়না....বঙ্গনারীদের এই বেশ কার না মন হরণ করে!!
সাজ নিয়ে সব চাইতে ইন্টারেস্টিং যে বর্ণানাটা দেখা যায় প্রাচীন বাংলা সাহিত্যে ও লিপি সাক্ষ্যে (দেওপাড়া প্রশস্তি, নৈহাটি লিপি).............সেটা হলো পুরুষের সাজের বর্ণানা। সেই সময়ে নারী এবং পুরুষেরা একই রকম অলংকার ব্যাবহার করতেন! নারী পুরুষ নির্বিশেষ একই রকম কানের দুল (কর্ন কুন্ডল ও কর্ণাঙ্গুরী), আংটি (আঙ্গুরীয়), মালা ও হার (কন্ঠাহার), চুড়ি (বলয়), বাজুবন্ধ (কেয়ুর), বিছা (মেখলা)...ইত্যাদি ব্যাবহার করতেন....একেবারে সাম্যবস্থা যাকে বলে!
অপরদিকে বাৎসায়ন বলেছেন " গৌড়িয় পুরুষেরা হস্তশোভী ও চিত্তগ্রাহী লম্বা লম্বা নখ রাখিতেন এবং সেই নখে নারীদের মনরঞ্জনের জন্য রং লাগাইতেন!" নারীরা লম্বা নখ রাখতেন কিনা সে বিষয়ে প্রাচীন বাংলার কোন সাহিত্যে কোন উদাহরণ পাওয়া যায় না।
আচ্ছা এক সময়ের পুরুষদের এই ফ্যাশান কবে থেকে একদম নারীদের হয়ে গেলো?
যাই হোক, মোটামুটি এই ছিল প্রাচীন বঙ্গের সাজগোজ আর খাওয়া দাওয়া!
অনেক খুজেও কি আমরা সেখানে পান্তা ইলিশ আর সাদা শাড়ি লাল পাড় দেখতে পাই? পাই না?
তাহলে কেন আমাদের যে ভাবেই হোক ৩৩৫০ টাকা দিয়ে হলেও ইলিশ খেতেই হবে, সাধ্যে কুলাক আর না কুলাক সাদা শাড়ি লাল পাড় পড়তেই হবে?
আমরা উৎসব প্রিয় জাতি অবশ্যই উৎসব পালন করবো ধর্মবর্ণ নির্বিশেষে তবে সেখানে কোন কর্পোরেট বানিজ্যিক হেজিমনি যেন ফায়দা না লুটতে পারে, সেটাও কি ভেবে দেখার সময় আসেনি এখনও?
এই ইলিশের দাম ১৫ তারিখেই কমে অর্ধেক হয়ে যাবে! না হয় এদিন আমরা নাই খেলাম ইলিশ! এখন ইলিশের প্রজনন ঋতু, এই সময়টা ধৈর্য্য ধরে নিজের জিবকে একটু সংবরন করলে পরের অনেক গুলো মাস অনেক সুলভে ইলিশ খেতে পারবো আমরা। আসলে আইন করে এই সময়ে ইলিশ ধরা বন্ধ করা উচিত!
নববর্যের সাথে, ঐতিহ্যের সাথে ইলিশের কোন সম্পর্ক নাই, এই জিনিসটা সবাই কবে অনুধাবন করতে পারবে????
আমাদের এক বস আছেন, রিংকু ভাই, তিনি সেদিন এক অভিনব বুদ্ধি দিলেন, যদি খুব বেশি ইলিশ খেতে ইচ্ছা করে তবে ইলিশের তেলে ম্যানেজ করে সিলভার কাপ মাছ কড়া করে ভেজে খেয়ে ফেললেই হয়, ইলিশের গন্ধ হলেই তো হলো!!
হা হা হা
সবাই কে নববর্ষের অগ্রীম শুভেচ্ছা!
নতুন বছর খুব ভাল কাটুক সকলের!
তথ্য সূত্র: নিহাররঞ্জন মিত্র: বাঙালির ইতিহাস
ছবি: রাজা রবি বর্মা
সর্বশেষ এডিট : ২২ শে অক্টোবর, ২০১২ বিকাল ৫:২৮