
যদি বলা হয় বাংলা রূপকথার ও লোক কাহিনীর একটা বড় অংশ জুড়ে কোন প্রাণীর অবস্থান, নির্দিধায় সাবাই বলবে বাঘ.....শুধু বাঘ না বাঘ আবার মামাও। মানুষের আত্মীক সম্পর্ক গুলোর মধ্যে সবচাইতে মধুর সম্ভাষন। এই রাজসিক বঙ্গ শার্দুলের হলুদ ও কালো ডোরাকাটা দাগের মধ্যে তাকালে একটা অদ্ভুত গতির ব্যাঞ্জনা টের পাওয়া যায়, হলুদ কালোর একটা চমৎকার অপটিক্যাল ইলিউশন।
একসময় জংগলময় বাংলার জীবনের সাথেই জড়িয়ে ছিল বাঘ , শুধু সুন্দরবন বলে নয়, বাংলার প্রতিটি অঞ্চলেই কিন্তু বাঘের গল্প শোনা যায়। ডাঙ্গায় বাঘ, জলে কুমির আর জঙ্গলে সাপ এটাই ছিল একসময়ের বাংলার প্রাকৃতিক বৈশিষ্ঠ্য।
বর্তমানের নগর সভ্যতার অগ্রাসনে এরা প্রায় বিলুপ্ত হয়ে গেলেও আমাদের অবচেতন স্বত্তায় এই সব প্রাণীরা মূর্তিমান সবসময়েই। এই কারনেই বাঘ নিয়ে অনেক প্রবাদ প্রবচন, কথকথা, রূপকথায় ছেয়েছিল জীবন। 'বাঘে মোষে এক ঘাটে জল খায়', 'তিনি ব্যাঘ্র হয়ে বললেন' 'বাঘিনী মেয়ে', বাঘের মাসী.....বিশাল এক তলিকা। এদের নিয়েই আমাদের লোকগল্প, গাথা, টোটেম ট্যাবুর মতো আদিকাল থেকে ভক্তি, শ্রদ্ধা ও ভয়ে স্মরন করে চলেছে এদের মানব জাতি।
সেদিন বেঙ্গল গ্যালারীতে "পটের গান বাংলার বাঘ" একটা ব্যাতিক্রমী প্রদর্শনী দেখতে গিয়ে এর প্রভাবটা আরেকবারটের পেলাম। পট শিল্পের প্রতি একটা আলাদা আগ্রহ ছিল আমার বরাবরই, তাই পেপারে খবরটা দেখে আর দেরি না করে হাজির হলাম এক বৃষ্টির সন্ধ্যায়।
পটশিল্পী নাজির হোসাইনের সেই বাংলার বাঘ সংক্রান্ত আখ্যানধর্মী লোককলাসংলগ্গ চমৎকার পটশিল্পের কিছু নমুনা দেখুন.........
তার পট চিত্রগুলোতে ফ্যান্টাসির ছড়াছড়ি, লোক কাহিনী নির্ভর.........
গরুর বদলে অমায়িক চেহারার বাঘ গাড়ি টানে

আবার হাল চাষও করে


বাঘের পিঠে বসে হুকো খেতে খেতে কৃষক গল্প করে কিষানীর সাথে!

লাল বাঘ, নীল বাঘ, হাসি হাসি গন্ধ


তার ছবিতে গায়ের বধু মাছে কোটে, পাশে স্বামী বাঘের লেজ দিয়ে কান চুলকায় আর হুকো খায়!

সারসের বাঘের গলার কাঁটা বের করার গল্প আর বাঘের নৌকা বাইচ!!

জলে কুমির, ডাঙ্গায় বাঘ আর সেই পথে বেহুলার ভাসান....

বাঘের পাশে বসে কেউ কি কখনো দোতারা বাজিয়ে গান শুনে দেখেছে কেমন লাগে? আবার মৎস কুমারীর সাথে মৎস বাঘ মামা!

এইটা একটা চরম ছবি। হাস্যমুখি হেলিকপ্টার, সাথে ট্যাংক, কামান, হাতি, সাপ[ পরিবেশ্টিত অত্যাচারী জমিদার আর তার সমানে বাঘের পিঠে মনের সুখে বংশিবাদনরত নায়ক


ঘুরি ওড়ায় বাঘ মামা


দুই বেহারা পালকি চালায়, হালুম রে.....হুলুম রে


গাছের যদি সত্যিই এমন মানুষে মতো মুখ থাকতো তাহলে কেমন হতো!

অক্টোপাস মর্দিনী চতুর্ভুজা বাঘিনী !

এই ছবিটা খুবই মজার, ভাল করে খেয়াল করেন


এরকম আরো অনেক চমৎকার সব পট চিত্রের সমাবেশ ঘটেছিল সেদিন, শিল্পীর কল্পনার দৌড়, বর্ণনারিতী, অলংকরণ, শিল্পরিতী সব কিছুই ছিল চমকপ্রদ!
ভাল কথা অনেকেই হয়তো জানেন পটচিত্রটা কি, তারপরও বলছি আবার.....পটের উপর আঁকা চিত্রকে পটচিত্র (Scroll painting) বলাহয়। এটি প্রাচীন বাংলার অন্যতম সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য। প্রাচীনকালে যখন কোন রীতিসিদ্ধ শিল্পকলার অস্তিত্ব ছিলনা তখন এই পটশিল্পই বাংলার শিল্পকলার ঐতিহ্যের বাহক ছিল। যারা পটচিত্র অঙ্কন করেন তাদেরকে সে যুগে এবং এ যুগেও পটুয়া বলা হয়। পট শব্দের প্রকৃত অর্থ হল কাপড়। শব্দটি সংস্কৃত "পট্ট" থেকে এসেছে। বর্তমানে এই শব্দটিকে ছবি, ছবি আঁকার মোটা কাপড় বা কাগজের খন্ড ইত্যাদি অর্থেও ব্যবহার করা হয়। কাপড়ের উপর গোবর ও আঠার প্রলেপ দিয়ে প্রথমে একটি জমিন তৈরি করা হয়। জমিন তৈরির পরে শুরু হয় আঁকার কাজ। এক্ষেত্রে বিভিন্ন দেশজ রংয়ের ব্যবহার উল্লেকযোগ্য; যেমন: ইটের গুঁড়া, কাজল, লাল সিঁদুর, সাদা খড়ি, আলতা, কাঠ-কয়লা ইত্যাদি। পটটিকে কয়েকটি অংশে ভাগ করে কাজ করা হয় এবং রংয়ের প্রকারের মধ্যে লাল, নীল, হলুদ, গোলাপী, বাদামী, সাদা এবং কালো ব্যবহৃত হয়।
তবে আপনি যদি মনে করেন যে দেশীয় শিল্পের এমন একটি কপি আপনি আপানার বাসায় আনবেন , তাহলে আপনার গুনতে হবে মাত্র পাঁচ হাজার থেকে শুরু করে ত্রিশ হাজার টাকা পর্যন্ত /

সর্বশেষ এডিট : ২৩ শে অক্টোবর, ২০১২ রাত ১২:০৭