আত্মস্মৃতি: কাঁটালতা উঠবে ঘরের দ্বারগুলায় (পঞ্চমাংশ)
আত্মস্মৃতি: কাঁটালতা উঠবে ঘরের দ্বারগুলায় (চতুর্থাংশ)
মাধ্যমিক পরীক্ষায় জিপিএ-৫ আসার সম্ভাবনা না থাকলেও ন্যূনতম ৪.৭৫ আসার কথা ছিল। কিন্তু ফল এলো ৪.৪৪। হিসাববিজ্ঞান পরীক্ষায় চূড়ান্ত হিসাবে একটা এন্ট্রি ভুল হওয়ায় বিশ মার্কস কাটা যায়, বাংলা ব্যাকরণে নৈর্ব্যক্তিকে কিছু ভুল যায়, আরও কিছু বিষয়ে ছোটোখাটো ভুল ছিল- এসব কারণে কাঙ্ক্ষিত পয়েন্ট আসেনি।
যাহোক, মাধ্যমিক তো শেষ হলো। এবার কোনো কলেজে ভর্তি হতে হবে। কিন্তু কোথায় ভর্তি হব; এ নিয়ে দোলাচলে পড়লাম। ঢাকায় এসে খোঁজখবরও নিয়ে গেলাম কয়েকটা কলেজে। তবে শেষ পর্যন্ত এলাকায়ই থাকতে হলো। ভর্তি হলাম উথুরা কলেজে। আমাদের স্থানীয় নারাঙ্গী বাজার থেকে দুই কিলোমিটার দূরে এ বাজার। এখানেই ইউনিয়ন পরিষদ। পরিষদের পাশেই কলেজটার অবস্থান।
যখন স্কুলে পড়তাম, দেখতাম এলাকার ভাইয়েরা বেশ ভাব নিয়ে মাঞ্জা মেরে কলেজে যায়। এক-দুইজন তো মাঝেমাঝে আমাদের ক্লাসে এসে ভাষণও দিতেন। বলতেন, “ভালোভাবে পড়ালেখা করো। একদিন আমাদের মতো তোমরাও কলেজে পড়বে। জীবন আনন্দময় হবে।”
তখন থেকেই মনে মনে ভাবতাম কবে যে কলেজে উঠব, কবে যে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ব, কবে পড়ালেখা শেষ করে একটা ভালো চাকরি করব? তবে স্কুলের চাকরির ওপর একটা অনীহা চলে এসে গিয়েছিল। কারণ, আমাদের এখানে কতিপয় শিক্ষক মনমানসিকতায় অত্যন্ত নীচ ছিলেন। এ কথা বলায় হয়তো কেউ ভাববেন আমি সবসময় নেতিবাচক ভাবনা ভাবি। তাহলে কিছু ব্যাপার না বললেই নয়।
সরকারি স্কুলের পড়ালেখার মান নিয়ে সকলেই কমবেশি অবগত। আমাদের স্কুলের শিক্ষকেরাও অত বেশি দক্ষ ছিলেন না। কী পড়াতেন, সেটা নিজেরা ঠিকমতো বুঝতেন কি না আমি জানি না। মুখস্থ বিদ্যায় সব চলত। ব্যবসায় শিক্ষার তো শিক্ষকই ছিল না। বিজ্ঞান-গণিতের শিক্ষক পড়াতেন হিসাববিজ্ঞান।
স্কুল যেন একটা পারিবারিক ব্যবসা। দেখা গেছে এক পরিবারের কয়েকজন শিক্ষক। তা থাকুন, কিন্তু শিক্ষার্থীদের প্রতি তাদের আচরণ ছিল জঘন্য। ধরাকে সরা জ্ঞান করতেন। গরিব ছেলেমেয়েদের মানুষ হিসেবে গণ্য করতেন না। এরা স্কুলে যাক, পড়ালেখা করুক; এটা যেন অনেকেই চাইতেন না। ক্ষমতাবানদের ছেলেমেয়েরা অল্প পয়সায় পরীক্ষার ফর্ম পূরণ করতে পারত, অথচ গরিবের সন্তানদের জন্য এক পয়সাও ছাড় নেই। অপমান-অপদস্থ করা তো আছেই।
বর্তমান পরিস্থিতি তো আরও খারাপ। যেহেতু একজন শিক্ষার্থী থাকলেও সরকার বেতন দেয়, শিক্ষকদের গা ছাড়া ভাব। ছেলেমেয়েদের পড়ালেখার মানোন্নয়নে প্রচেষ্টা নেই। এলাকার কোনো লোক স্কুলের কমিটিতে নেই। এলাকার ছেলেমেয়েরাও তেমন সুবিধা পায় না। অন্য এলাকার লোকজন বিভিন্ন দায়িত্বে, সুবিধা পায় অন্য এলাকার ছেলেমেয়েরাই। আমাদের স্থানীয় শিক্ষকেরা অন্যদের তোষামোদি করে চলেন। কারণ আছে অবশ্য। চাকরি-পদোন্নতির ব্যবস্থা করে দিয়েছে যে, মগজ এখন বিক্রি হয়ে গেছে।
এলাকার যে এক-দুইজন জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ালেখা করতেন, তাদেরও অহঙ্কারে মাটিতে পা পড়ত না। কখনও সাহস করে কারও কাছ থেকে কোনো বুদ্ধি-পরামর্শ নেওয়ার সাহস হতো না। এসব কারণে এলাকার প্রতি, বা গ্রামে শিক্ষকতার প্রতি ঘৃণা তৈরি হয়ে গিয়েছিল। গ্রাম্য রাজনীতি আমাকে হতবিহ্বল করে তুলেছিল।
যাক সেসব কথা। কলেজে ভর্তি হওয়ার পর পাখা গজিয়ে উঠল আমার। আর সব তরুণের যেমন হয়। মনে হলো এতদিন যে বিধিনিষেধের বেড়াজালে আবদ্ধ ছিলাম; এখন থেকে একটু আলগা হলাম। নিজের মতো করে চলতে পারব।
কয়েক মাস ক্লাস করে কলেজে মোটামুটি নাম-ডাক এসে গেল আমার। বিশেষ করে ব্যবসায় শিক্ষা শাখায় বেশ পরিচিত মুখ হয়ে গেলাম। আর সব বিভাগের ছেলেমেয়েরা চিনতে লাগল, শিক্ষকরাও চিনতে লাগলেন। ইংলিশে ভালো করায় সবাই প্রশংসা করত। কলেজ এলাকায় যারা ইংলিশ পড়াতেন তারা আমাকে সরাসরি না চিনলেও আমার নাম জানতেন। সমীহ করতেন।
কিছু ঝামেলা তৈরি হয়ে গেল হঠাৎ। প্রাইভেট না পড়ায় হিসাববিজ্ঞানের মনির স্যার এবং ইংরেজির হাবিব স্যার আমাকে অপছন্দ করতে লাগলেন। দেখা গেল ছেলেদের মধ্যে আমিই সবচেয়ে ভালো করলাম, মেয়েদের মধ্যে একজন; অথচ স্যার দাঁড় করিয়ে মেয়েটার প্রশংসা করছেন। অথচ আমাকে যেন চিনেনই না। চিনবেনই বা কেন? আমি তো তার কাছে প্রাইভেট পড়ি না। হিসাববিজ্ঞানের মনির স্যার তো ইয়ার চেঞ্জ পরীক্ষায় ফেল করিয়ে দিলেন।
কয়েকবছর আগে করোনার সময় আমি যখন এলাকায় ছিলাম, বেশকিছু শিক্ষার্থীকে প্রাইভেট পড়িয়েছি। তখন শুনেছি শিক্ষকদের আগের অভ্যাস এখনও বদলায়নি। শিক্ষার্থীদের সরাসরি হুমকি দেওয়া হয় প্রাইভেট না পড়লে ফেল করিয়ে দেওয়া হবে।
প্রথম বর্ষে হিসাববিজ্ঞান প্রাইভেট না পড়লেও চলত। কারণ, এখানকার পড়া হাইস্কুলের হিসাববিজ্ঞানের চেয়ে খুব বেশি এগোনো না। তবে দ্বিতীয় বর্ষে যখন উঠলাম, তখন প্রাইভেট পড়া ছাড়া অন্য উপায় ছিল না। কারণ, অধ্যায়গুলো নতুন ছিল। স্যার ক্লাসে পড়াতেন না, বলতেন প্রাইভেটে পড়তে হবে। তখন নিরুপায় হয়ে তার কাছে প্রাইভেট পড়া শুরু করলাম। কিছুদিনের মধ্যেই মনির স্যারের প্রিয় পাত্র হয়ে ওঠলাম।
আমাদের শাখায়, মানে ব্যবসায় শিক্ষা শাখায় একমাত্র মেয়ে ছিল সুমাইয়া। তালুকদার বংশের মেয়ে সে। সহপাঠীরা অনেকে তাকে মজা করে নানি ডাকত। আর আমাকে ডাকত নানা।
একে উঠতি বয়স; এরমধ্যে সহপাঠীদের উস্কানি- মন ঠিক রাখা কঠিন হয়ে গেল। রক্ষণশীল পরিবারের ছেলে আমি, অথচ এই মেয়ের মায়ায় পড়ে গেলাম। মোবাইলে কেমনে কেমনে জানি তার সাথে এক-দুই দিন কথাও হলো।
নারাঙ্গী বাজার থেকে টেম্পোতে ওঠতাম। সে আসত বনকুয়া থেকে। বনকুয়া নারাঙ্গী থেকে কয়েক কিলোমিটার দূরে। নারাঙ্গী হয়েই উথুরা যেত।
আমি বাজারে অপেক্ষা করতাম। সে যে টেম্পোতে থাকত, আমি সে টেম্পোতেই ওঠতাম। তবে কথা বলতে পারতাম না। লজ্জায় কাঁচুমাচু হয়ে বসে থাকতাম। আমার কলেজজীবনে দমকা হাওয়া ছিল সে। সে কাছে এলে বা তার কথা ভাবলে আমি চমকিত হতাম। কোনোদিন সে কলেজে না এলে আমার জীবনে যেন অন্ধকার নেমে আসত। ক্লাসে মন বসত না। ছোটোখাটো গড়নের, অথচ মিষ্টি চেহারার মেয়েটা আমার হৃদয়ের অনেকটা জায়গাজুড়ে ছিল।
তার সাথে একই টেম্পুতে আবার নীরবে বাড়ি ফিরতাম। একদিন ক্লাস শেষে টেম্পো স্ট্যান্ডে গিয়ে চার ঘণ্টার মতো বসে আছি। সে আসে না। এরপর কলেজে গিয়ে দেখি সে নেই। আমার অগোচরে হয়তো চলে গেছে।
বৃহস্পতিবার এলে মনটা আমার খারাপ হয়ে যেত। কারণ, শুক্রবার তো তার সাথে দেখা হবে না। কী করা যায়? এক সহপাঠীকে নিয়ে তার বাড়ির পাশের মাঠে বসে থাকতাম। কিছুক্ষণ পরপর তার বাড়ির পাশের রাস্তা দিয়ে হাঁটতাম।
জীবন যখন এভাবে চলছে, হঠাৎ শকুনের নজর লাগল আমার ওপর। একজন জানাল সুমাইয়ার সাথে তার সম্পর্ক ছিল, আরেকজন জানাল তার সাথে নাকি এখন সম্পর্ক আছে। আমাকে কিছু মেসেজও দেখাল। আমি কী বলব বুঝতে পারলাম না। মনটা ভেঙে খান খান হয়ে গেল। ঘটনার সত্যতা যাচাইয়ের ইচ্ছে হলো না।
সুমাইয়ার ওপর প্রচণ্ড অভিমান হলো। ছাড়া ছাড়া ভাব নিয়ে চলা শুরু করলাম। যে সম্পর্ক হতে পারত, তা আর হওয়ার সুযোগ রইল না।
আমার এক কাজিনের সাথে সুমাইয়ার গল্প করতাম। তার আগ্রহ হয়েছিল সুমাইয়াকে দেখার। আমি যখন হৃদয় ভাঙার গল্প বললাম, সে সুমাইয়াকে দেখার আগ্রহ হারিয়ে ফেলল।
একদিন শুনি বিজ্ঞান শাখার তানিনকে প্রপোজ করেছে সুমাইয়া। তানিন জানাল সুমাইয়া নাকি আগে থেকেই তাকে পছন্দ করত। আমার এক সহপাঠী বলেছিল, আমি না এগোনোয় সুমাইয়া আমার ওপর প্রতিশোধ নিতে চেয়েছিল। আমি আসলে এই খেলের কিছুই বুঝতে পারছিলাম না।
কলেজের টেস্ট পরীক্ষা হলো। আমরা অনেকেই ভালুকা সদরে কোচিং করতে চলে গেলাম। সুমাইয়া বাড়ি থেকেই কোচিং করতে যেত। হিসাববিজ্ঞান স্যার দুইজনকে দুই কোচিংয়ে ভর্তি করালেন। উনি দুটোতেই কোচিং করাতেন। ক্লাসের দুইজন ভালো শিক্ষার্থীকে দিয়ে উনি ফায়দা লুটলেন। আমার সাথে সুমাইয়ার দেখা হওয়ার সুযোগ রইল না।
একদিন ভালুকা ডিগ্রি কলেজের পাশ দিয়ে যাচ্ছিলাম। দেখি এক ছেলের সাথে রিকশায় করে কোথায় যেন যাচ্ছে সুমাইয়া। আমাকে দেখে রিকশার হুড তুলে ফেলল। আমি বাকরুদ্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। এর আগে শুনেছিলাম রানা নামে এক ছেলের সাথে ওর সম্পর্ক আছে। বিশ্বাস হয়নি। এখন নিজের চোখকে অবিশ্বাস করি কীভাবে?
সুমাইয়ার সাথে আমার আবার দেখা হয়েছিল বোর্ড পরীক্ষার সময়। আমার সামনের সিটে বসেছিল সে। বলেছিল, আমি যেন পরীক্ষায় তাকে দেখাই। আমি মুচকি হেসেছিলাম। মনে মনে বলেছিলাম, আমার সবই তো তোমাকে দিয়ে দিয়েছিলাম অথচ...
উচ্চ মাধ্যমিকে ব্যবসায় শিক্ষা শাখা থেকে আমাদের উপজেলায় কেউ জিপিএ-৫ পায়নি। মানবিক শাখা থেকে একজনই পেয়েছিল। যার সাথে ইংলিশে আমার প্রতিযোগিতা হতো সে। আরও কয়েকজন কাছাকাছি পয়েন্ট পেয়েছিল। ব্যবসায় শিক্ষা শাখার আমি ৪.৫০ পেয়েছিলাম। আর সুমাইয়া পেয়েছিল ৪.৪০।
চলবে...
ছবি: প্রতীকী
সর্বশেষ এডিট : ০৭ ই জুলাই, ২০২৪ দুপুর ১:৩২