আত্মস্মৃতি: কাঁটালতা উঠবে ঘরের দ্বারগুলায় (তৃতীয়াংশ)
আত্মস্মৃতি: কাঁটালতা উঠবে ঘরের দ্বারগুলায় (দ্বিতীয়াংশ)
আত্মস্মৃতি: কাঁটালতা উঠবে ঘরের দ্বারগুলায় (প্রথমাংশ)
আমার ছয় কাকার কোনো কাকা আমাদের কখনও একটা লজেন্স বা একটা বিস্কুট কিনে দিয়েছেন বলে মনে পড়ে না। আমাদের দুর্দিনে তারা কখনও এগিয়ে আসেননি। আমরা কী খেয়ে আছি, আদৌ খেয়েছি কি না; সে ব্যাপারেও কখনও জানতে চাননি। কেন চাননি কে জানে! মাকে এ ব্যাপারে জিগ্যেস করে কখনও কোনো সদুত্তর পাইনি। মা একা হাতে পুরো সংসার সামলেছেন। ঝড়-ঝঞ্চায় বাড়ির চারপাশের বেড়া ভেঙে গেলে মা আমাদের নিয়ে ঠিক করতেন।
মায়ের কাছ থেকে এটা-ওটা আবদার করে আমাদের সবসময়ই হতাশ হতে হতো। কারণ, মায়ের হাতে খুব কম সময়ই টাকা-পয়সা থাকত। বাবা তেমন টাকা পাঠাতে পারতেন না। মা আমাদের এটা-ওটা বলে বুঝ দিতেন। আর বলতেন, “তোদের বাবা দেশে এলে সব হবে।”
ছোটো আমি মাঝেমধ্যে কাউকে না বলে ঘর থেকে চাল চুরি করে নিয়ে যেতাম। তারপর স্থানীয় নারাঙ্গী বাজারে সেটা বিক্রি করে ‘মজা’ খেতাম। বৃহস্পতিবার ছিল এখানকার হাটবার। বড়ো পরিসরে বাজার বসত। সেদিন আমাদের আনন্দের সীমা থাকত না। আমার সাথে আমার ছোটো কাকাতো ভাইবোনেরাও যেত। অনেকসময় এমন হয়েছে যে, ওদের কিছু খাওয়াতে গিয়ে আমি নিজে কিছুই খেতে পারিনি।
আমাদের ঘরের পেছনে একটা পেয়ারা গাছ ছিল। সে গাছে অনেক পেয়ারা ধরত। অনেকদিন পেয়ারা পেড়ে বড়ো বুলে করে হাটে নিয়ে যেতাম। দুই টাকা হালি বিক্রি করতাম। আর আসার সময় পাঁচ টাকা ভাগা গুড়া মাছ নিয়ে আসতাম, সাথে কচু। মা মজা করে রান্না করতেন।
কয়েকটা হাঁস ছিল আমাদের। ডিম পাড়লে সেগুলো বাজারে নিয়ে বিক্রি করতাম। এছাড়া মায়ের লাগানো গাছ থেকে কলা, লাউ তুলে বিক্রি করে দৈনন্দিন খরচ মেটাতাম।
শৈশবের ইদের দিনগুলোর কথা খুব মনে পড়ে আমার। বোনেরা ইদের সময় নতুন জামা-কাপড়ের বায়না ধরত। এক ইদে না পেলে অন্য ইদে ঠিকই পেত। আমি কখনও কোনো ইদে জামা-কাপড় পাইনি। বোনদের দেওয়ার পর আমার জন্য বরাদ্দ থাকত না। দেখা যেত স্কুলে পরার যে জামা ছিল, সেটা পরে ইদ কাটত।
মায়ের অসহায়ত্ব আমি বুঝতাম। তাই একটু বড়ো হওয়ার পর দাবি-দাওয়া কমতে থাকে আমার। মা গর্ব করে বলতেন, “আমার ছেলেটা সংসারের দুঃখ-কষ্ট বুঝতে শিখে গেছে।”
কোনো কোনো ইদে মামার বাড়ি পাঠিয়ে দেওয়া হতো আমাদের। তখন না বুঝলেও এখন বুঝি কেন পাঠিয়ে দেওয়া হতো। মায়ের সাধ্য ছিল না নতুন জামাকাপড় কিনে দেওয়ার। মামারা যদি তাদের ছেলেমেয়েদের সাথে আমাদেরও জামা কিনে দেন, মা সে ইচ্ছে পোষণ করতেন।
মামারা আমাদের যথেষ্ট আদর-যত্ন করতেন। তাদের ছেলেমেয়েদের জন্য যেসব জামা-কাপড় কিনতেন, আমাদের জন্যও একই রকম জামা কিনতেন। শৈশবে যেসব জিন্স বা গেঞ্জি পরতাম, সবই মামাদের কিনে দেওয়া। আমার ছয় মামা আরব দেশে থাকতেন। সেখান থেকে জিনিসপত্র পাঠাতেন।
যখন একটু বড়ো হলাম, তখন কিছু কিছু বৈষম্য চোখে পড়ত। যেমন ইদের সময় মামাত ভাইবোনেরা ২০০-৩০০ টাকা করে সালামি পেলেও আমি পেতাম ৫-১০ টাকা। মনে মনে জেদ চাপত; ভাবতাম, আমার বাবা বিদেশ থেকে এলে আমিও নিশ্চয়ই বেশি করে টাকা পাব।
মামাত ভাইয়েরা সেসময়ই নতুন মোবাইল ফোন পেয়েছিল। আমি ওদের কাছ থেকে মোবাইল নিয়ে সেসময়কার হিন্দি গানের ভিডিও দেখতাম। ওরা মাঝেমধ্যে বিরক্ত হয়ে যেত। যদিও কিছু বলত না।
আমি প্রথম মোবাইল পেয়েছিলাম কলেজে উঠার পর, তাও সেটায় ছবি তোলা যেত না, গান শোনা যেত না।
এক ইদে মামার বাড়ি গেলাম। মামাত ভাইদের সাথে ঘোরাঘুরি করতে করতে হঠাৎ মায়ের কথা মনে পড়ল। আমি প্রথমবারের মতো উপলব্ধি করলাম কেন মা আমাকে মামার বাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছেন। আমার মা ইদের দিন ভালো কিছু খেতে পারবেন না, পরতে পারবেন না আর আমি মামার বাড়ি থেকে ভালো খাব, ভালো পরব- এসব ভেবে জন্মের কান্না পেল। আমি দৌড়ে গিয়ে আমার জামা-কাপড় গোছাতে লাগলাম। এক মামি জিগ্যেস করলেন, “কী হয়েছে?” আমি কাঁদতে কাঁদতে শুধু একটা কথাই বললাম, “মায়ের কাছে যাব।”
এর পর বাড়ি চলে আসি। আর কখনও কোনো ইদে মামার বাড়ি যাইনি।
চলবে...
ছবি: প্রতীকী
সর্বশেষ এডিট : ০৭ ই জুলাই, ২০২৪ দুপুর ১:৩৫