বিশিষ্ট চলচ্চিত্রকার ও লেখক আমজাদ হোসেনের ‘ভাত দে’ নামে একটা চলচ্চিত্র আছে। খিদে যে কতটা নির্মম হতে পারে; এটা প্রথম উপলব্ধি করি এই চলচ্চিত্রটা দেখেই। চলচ্চিত্রটাতে দেখানো হয়, বাউল শিল্পী আনোয়ার হোসেন স্ত্রী-কন্যার ভরণপোষণ দিতে পারেন না। স্ত্রী আনোয়ারা শুধুমাত্র দু’মুঠো ভাতের আশায় এক লোকের সাথে ভেগে যান। ছোট্ট কন্যা শাবানা মানুষের বাড়িতে চেয়েচিন্তে খায়। মাঝেমধ্যে ভাত চুরি করে।
মায়ের সাথে রাগ করে ভাত না খাওয়ার ইতিহাস অনেক আছে আমার। ছোটোকালে তো করেছিই, কলেজে থাকতেও এমন প্রায়ই করতাম। মা অবশ্য আদর করে রাগ ভাঙাতেন, ভাত খাওয়াতেন। ভাত না খেতে চাইলে চিড়ে-মুড়ি খেতে দিতেন।
অনার্সে যখন পড়ি, মাঝেমধ্যে ভাত খাওয়ার টাকা থাকত না আমার কাছে। একটা-দুটো শিঙাড়া খেয়ে দিন পার করতাম। একদিন-দু’দিন নয়, অনেকদিনই এমন হয়েছে। তখন বাড়ির সময়টা খুব মিস করতাম। মায়ের অনুপস্থিতিটা আমাকে পীড়া দিত। মনে মনে আশা করতাম কেউ যদি একবেলা আমাকে পেটপুরে ভাত খাওয়াত!
অনার্সের শেষদিকে আরও অভাবে পড়লাম। অবশ্য এটা স্বাভাবিক ব্যাপার আমার কাছে। কারণ, জীবনে খুব কম সময়ই আরামে কাটিয়েছি। পেছনের ইতিহাস ঘেঁটে আনন্দের তেমন কিছু পাই না।
যাহোক, মাস্টার্স করার অবস্থা রইল না আমার। কোনোমতে অনার্স শেষ করে গাজীপুর চলে এলাম একটা চাকরির খুঁজে। ছোটোখাটো যেকোনো চাকরি। নিদেনপক্ষে গার্মেন্টসের একটা চাকরি। দরকার পড়লে কারও গুদামঘরেও কাজ করতে রাজি ছিলাম। কিন্তু হলো না কিছুই। রিক্তহস্তে ভগ্নহৃদয়ে বাড়িতে ফিরে যেতে হলো।
নয় মাস কাটল শুয়ে-বসে। পাড়াপড়শি তো বটেই, নিজের মা-বাপও বিরক্ত হয়ে গেল। হবেই বা না কেন? জোয়ান ছেলে বাড়িতে বসে আছে। নিজের চলার মতো ব্যবস্থাও করতে পারছে না; এরচেয়ে নিন্দনীয় ব্যাপার আর কি আছে?
মায়ের সাথে রাগ করে একদিন ময়মনসিংহ শহরে চলে গেলাম। লুৎফর নামে এক বন্ধুর সাথে আনন্দমোহন কলেজের তরুণ হলে রইলাম টানা পনেরো দিন। একজনের কাছে এতদিন থাকা যায়? তাছাড়া তারও টানাটানি চলছে। বাধ্য হয়ে একসময় নিজের বাড়িতেই ফিরলাম।
আমি দিন গুনছিলাম কবে এই দুর্দশা কাটবে, কবে থেকে মানুষের কথা শুনতে হবে না আর। নয় মাস পর ভালুকায় একটা কোচিংয়ে ক্লাশ করানোর সুযোগ পেলাম। মাস শেষে হাতে পেলাম এক হাজার পাঁচশো টাকা। এই টাকায় বাসা ভাড়াই হয় না। খাব কী?
রান্না করার জন্য একজন মহিলা রেখেছিলাম। তাকে বাদ দিতে হলো। জীবনের চরম একটা অধ্যায় শুরু হলো, যা মনে পড়লে এখনও গা শিউরে ওঠে। কেউ এ কথা বিশ্বাস করবেন কি না জানি না আমি টানা ছয় মাস একবেলা করে ভাত খেয়েছি। এই একবেলা ভাত খাওয়ারও টাকা ছিল না আমার কাছে। এক দু’জন বন্ধুর কাছ থেকে চেয়েচিন্তে নিতাম।
খাবারটা খেতাম বিকেলের দিকে। যেন সকাল-দুপুর-রাত একসাথে হয়ে যায়। কোচিং করে যখন রাত দশটায় বাসায় ফিরতাম, খিদের যন্ত্রণায় চোখে ঘুম আসত না। বুঝতে পারতাম, খিদের যন্ত্রণার চেয়ে বড়ো কোনো যন্ত্রণা আর হতে পারে না। তবু সহ্য করে থাকতাম। বাড়িতে কখনও জানাতাম না। মায়ের ওপর চাপা অভিমান ছিল। যদিও এখন বুঝি অভিমানটা অহেতুক ছিল।
না খেয়ে থাকতে থাকতে শরীর-স্বাস্থ্য একেবারে ভেঙে পড়েছিল। মনে পড়ে একবার এক শিক্ষার্থীর বাসায় দাওয়াত দিয়েছিল। মাংস যখন মুখে নিচ্ছিলাম, গলা দিয়ে নামছিল না। গলার ছিদ্র ছোটো হয়ে গিয়েছিল আমার।
একবেলা যে হোটেলে ভাত খেতাম, হোটেলওয়ালা আমার দিকে তাচ্ছিল্যের দৃষ্টিতে তাকাতেন। মনে করতেন কোন ফকির-মিসকিন এলো এখানে! অন্যদের খাবার সময় মতো দিলেও আমার খাবার দেরিতে দিতেন। প্রতি শনিবার হোটেলের বিল দিতাম। আসলে হোটেলওয়ালা ফারুক ভাই চাচ্ছিলেন যেন কোনো বাকি না রাখি। টাকা যে দেব, আমি টাকা পাব কোথায়?
হোটেলটা থেকে খাওয়া বাদ দিলাম। গেলাম দুয়েক মিনিটের দূরত্বে অন্য এক হোটেলে। সেখানেও একই অবস্থা। টাকা সময় মতো দিতে না পারায় হোটেলওয়ালা খাবার দিতে অনাগ্রহ প্রকাশ করলেন।
কোচিংয়ের পাশাপাশি মাসিক দুই হাজার টাকা বেতনে ‘রোজবাড’ নামে একটা কিন্ডারগার্টেনে ঢুকলাম। দুঃখজনক ব্যাপার হলো, এই টাকাটাও সময় মতো পাইনি। পেটে জন্মের খিদে নিয়ে বিকেল পর্যন্ত ক্লাস করাতাম।
আশপাশের দুটো হোটেলে খাওয়া বাদ দেওয়ার পর খাওয়ার মতো জায়গা রইল না আর। একদিন নজর পড়ল ফুটপাতের ভাতের হোটেলগুলোর দিকে। কিন্তু এখানে বসে খাওয়ার মতো অবস্থা ছিল না। কারণ, যে স্কুলটায় পড়াতাম, স্কুলটা এর পাশাপাশি ছিল। অভিভাবক-শিক্ষার্থীদের চোখে পড়ার সমূহ সম্ভাবনা ছিল।
চলবে...