মাত্র আট বছর বয়সে কবি নজরুলের পিতৃবিয়োগ ঘটে। ওনার মা দ্বিতীয় বিবাহ করেন। এটা কবি মেনে নিতে পারেননি। মায়ের সাথে তার দূরত্ব তৈরি হয়ে যায়। শুরু হয় কঠিন এক জীবন। লেটো দলের গান গাওয়া থেকে শুরু করে মসজিদে মুয়াজ্জিনগিরিসহ রুটির দোকানে কাজ করা- হেন কোনো কাজ নেই ওনি করেননি। আসানসোলে রুটির দোকানে কাজ করার সময় রফিজউল্লাহ নামের জনৈক পুলিশের নজরে পড়েন নজরুল। ওনি মাঝেমধ্যেই দেখতেন ছেলেটা রুটির দোকানে অবসরে কী সব পড়ে। প্রসঙ্গত, ভদ্রলোকের এক ভাই সেখানকার এক স্কুলে নজরুলের সহপাঠী ছিলেন। তার কাছ থেকে জানলেন ছেলেটা মেধাবী।
ময়মনসিংহের ত্রিশালে বদলি হওয়ার পর ভদ্রলোক নজরুলকে সাথে করে নিয়ে আসেন। এটা ১৯১৪ সালের ঘটনা। ভর্তি করিয়ে দেন দরিরামপুর হাইস্কুলে (বর্তমান নাম নজরুল একাডেমি)। উল্লেখ্য, ইন্সপেক্টর সাহেবের বাড়ি ছিল ত্রিশালের কাজিরসিমলায়। কাজিরসিমলা থেকে দরিরামপুর বেশ দূরে। কাদামাটি মাড়িয়ে অনেক পথ হেঁটে আসতে হতো। নজরুলকে জায়গির দেওয়া হয় স্থানীয় বিচুতিয়া বেপারির বাড়ি। এখানে থেকে ওনি এক বছর পড়ালেখা করেন সপ্তম শ্রেণিতে। এরপর পুনরায় আসানসোলে চলে আসেন।
আবারও শুরু হয় দুর্বিষহ জীবন। ১৯১৭ সালে বাঙালি পল্টন গঠিত হলে বৃটিশদের হয়ে যোগ দেন বাঙালি পল্টনে। যদিও ওনাদের প্লাটুনটা রিজার্ভ রাখা হয়েছিল। নজরুলকে কোনো যুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে হয়নি। তবে একটা ব্যাপার খুব অবাক লাগে না যাকে ব্রিটিশবিরোধী কবি হিসেবে আমরা জানি, যিনি ব্রিটিশবিরোধী কবিতা লিখে জেল-জুলুম সহ্য করেছেন; তিনিই একসময় বৃটিশদের পক্ষে লড়তে চেয়েছিলেন? দারিদ্র্য মানুষের মধ্যে কতটা বৈপরীত্য আনতে পারে!
নজরুলের দারিদ্র্য ছিল অসীম। শিশুপুত্র বুলবুলের দাফনকার্য সম্পন্ন করার পয়সাও ওনার ছিল না। প্রকাশকের কাছে গান লেখার বিনিময়ে ওনি অল্প কিছু টাকা পেয়েছিলেন। অভাবে পড়ে একসময় অনুরোধে গজল, শ্যামা সঙ্গীত লেখা শুরু করেন। তখন বেশ টাকা-পয়সা আসে। কিন্তু ওনি ছিলেন বেহিসেবি। টাকা-পয়সা কেমনে খরচ করতেন নিজেও জানতেন না। স্ত্রী প্রমিলা দেবীকে পোহাতে হতো দুর্ভোগ। একসময় তো ওনিও পক্ষাঘাতগ্রস্থ হয়ে গেলেন। কী যে দুর্ভোগ নেমে এল জীবনে! কবি নিজেও বাকশক্তি হারান। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ তখন। কে রাখে কার খোঁজ! খুব একটা সহযোগিতা পাননি তখন। ভারত ভাগ হলে ভারত সরকার ওনাকে একটা ব্যবস্থা করে দেন থাকা-খাওয়ার।
’৬২ সালের দিকে স্ত্রীবিয়োগ হলে নজরুলের মানসিক অবস্থা আরও খারাপ হয়ে যায়।
বাংলাদেশ স্বাধীন হলে বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ওনাকে ঢাকায় নিয়ে আসেন। নাগরিকত্ব দেন এবং বহুবিধ সম্মানে ভূষিত করেন। এই সময়টাই ছিল নজরুলের মোটামুটি সুখের। নিজ মাতৃভূমি রেখে অন্য দেশের নাগরিকত্ব ওনি জ্ঞানকালে নিতেন কি না সেটাও একটা প্রশ্ন। তারচেয়ে বেদনার বিষয় হলো, স্বামী-স্ত্রী দু’জনের কবর দুই দেশে।
নজরুলকে শুধু দারিদ্র্য সহ্য করতে হয়নি, কাঠমোল্লাদের নিপীড়নও সহ্য করতে হয়েছে। ওনাকে কাফের-মুরতাদ ঘোষণা করা হয়েছে। হিন্দু মেয়ে বিয়ে করায় কট্টরপন্থী মুসলিমরা তাকে ভালোভাবে নেয়নি। কট্টর হিন্দুরাও তাকে ঘৃণার চোখে দেখত। ওনার সাহিত্যকে অবমূল্যায়ন করত। একটা শ্রেণি তো শনিবারের চিঠিতে ওনার সমালোচনা করে জেরবার করেছিল।
সর্বশেষ এডিট : ১৮ ই জুন, ২০২৪ দুপুর ১:০৯