বিভূতিভূষণ বন্দোপাধ্যায়ের কাহিনী অবলম্বনে
বাক্স বদল
সৌমিত্র চট্টপাধ্যায়
অপর্ণা দাশগুপ্ত
অভিনীত।
আবহ সংগীত অলাক দে
চিত্রনাট্য ও সংগীত সত্যজিৎ রায়
পরিচালনা নিত্যানন্দ দত্ত
১।সিনেমাটির শুরুতেই ট্রেন ছুটে চলার দৃশ্য। জীবনের চলার পথ আর অবিরাম গতিই যেন নাটকীয়ভাবে শুরুতে আনা হয়।
২।নায়িকার মামার বাড়িতে ছুটি কাটাতে ট্রেনে নায়িকা ও তার মা চড়েছেন। একই ট্রেনে ভাইয়ের বাড়িতে পৌছুতে চড়েছেন নায়ক মহাশয়।
৩। ট্রেন থেকে নেমে স্বাভাবিক ব্যস্ততায় ডুবে যান তারা। নায়ক তার সুটকেসটি মাটিতে রেখে ভাইয়ের পা ছুয়ে সালাম করছেন।
৪। নায়িকা তার সুটকেসটি মাটিতে রেখে এদিক ওদিক তার মামাকে খুজে বেড়াচ্ছেন।
৫। নায়ক তার ভাইকে নিয়ে চলেছেন ভাইয়ের বাড়িতে।
৬। অন্যদিকে নায়িকার মামাও তার পরিজনদের নিয়ে চলেছেন নিজ বাড়িতে।
৭। নায়ক ভাইয়ের বাড়িতে এসে পৌছুলেন। কী এনেছো আমার জন্য? বইদির পীড়াপিড়িতে সুটকেসটি খুলেন নায়ক। ওতে বউদির জন্য সন্দেশ আর শাড়ি আনা হয়েছে। কিন্তু সুটকেস বদল হয়ে গেছে। বলাই বাহুল্য, সুটকেস থেকে নায়িকার কাপড়-চোপড় আর মেয়েলী প্রসাধনী বের হচ্ছে!
৮। ওদিকে মামার বাড়ি পৌছে নায়িকাও তার বদলে যাওয়া সুটকেস খুলে হতভম্ব হয়ে গেছেন। সুটকেস থেকে সব ছুড়ে ফেলে জুড়ে দিয়েছে কান্না, ছুটিটাই যে নষ্ট হল বলে!
৯। সুটকেস বদলে নায়ক যতটাই বিরক্ত বউদি ততটাই মজা পেয়েছে। নায়কের বউদি সুটকেস ঘেঁটে পেয়েছে একটি ডায়রী। নায়িকার মনের কথামালা ওতে সাঁজানো আছে। বউদি সেসব কথা জোরে জোরে পড়ে শোনাতে থাকেন নায়ককে। নায়ক ডুবতে বসেন অপরিচিত নায়িকার প্রেমে।
১০। নায়িকা ধীরে ধীরে সুটকেস বদলের ব্যাপারটা সামলে নিয়েছে। নায়কের সুটকেসে পাওয়া গেল সন্দেশ। সেই সন্দেশ দিব্যি পেটে চালান করে চলেছে সে।
১১। ওদিকে অবশেষে নায়ক তার কাছে থাকা সুটকেসে নায়িকার নাম, ঠিকানা খুজে পেয়েছে। এটাকে নায়িকার কাছে ফেরত পাঠানোর প্রস্ততি নেন। সুটকেস বদলের ব্যাপাটায় তিনি যে ভীষণ বিরক্ত হয়েছেন এটা বোঝাতে নায়িকার সুটকেসে থাকা একটি ছবিতে (যেটাতে নায়িকা ও তার ভাই রয়েছে) দাড়ানো ছেলের নাকে গোঁফ এঁকে দেন।
১২। সুটকেস ফেরত পেয়ে নায়িকা দারুণ খুশি হয় কিন্তু ছবিটা দেখে তার মেজাজ গরম হয়ে যায়। নায়কের সুটকেসও এখন ফেরত পাঠাতে হয় অবশ্য নায়কের সুটকেসের সাথে সে একটি কড়া ভাষায় চিঠিও পাঠিয়ে দেয় এই বলে যে- যিনি কারও ছবিতে এমন বিশ্রি আঁক কাটতে পারে তার রুচি নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ আছে!
১৩। নায়ক পেশায় একজন মানসিক রোগের চিকিৎসক। অদ্ভুত আর মজারসব রোগি তার চেম্বারে আসে। নায়িকার কড়া চিঠি পেয়ে সে তাল হারিয়ে ফেলে। সবচেয়ে আসল কথা নায়িকার পাঠানো চিঠিতে স্পষ্ট করা আছে পুরুষের গোঁফ জিনিসটা তার কতটা বিচ্ছিরি লাগে ও অপছন্দের। নায়কের নায়কীয় গোঁফের বিরুদ্ধে এ এক অস্বস্তিকর ব্যাপার বটে!
১৪। পুরুষের গোঁফ কেমন? এটা জানতে সে নানাজনের মতামত নিতে শুরু করে। নিজের বোনের মতামত পেয়ে বুঝতে বাকি থাকে না গোঁফ জিনিসটা অনেক মেয়ের কাছেই অপছন্দের।
১৫। গোঁফ নিয়ে নায়িকার মনেও খেলা চলছে খুব। সুটকেসে থাকা ছবিতে আঁকা গোফের বাস্তব ছবিটাও দেখা চাই তাই নিজ ভাইয়ের মুখেও একখান গোঁফ এঁকে দেখাই যাক না! তলে তলে গোঁফ বিষয়ক প্রেমের সমীকরণ চলছে মনে আরকি!
১৬। নায়িকার বিয়ের কথাবার্তা চলছে। পাত্র প্রায় ঠিক। তবে এই ঠিক ঠিক নয়। পাত্র ভদ্র, নম্র এবং বিশেষভাবে ও উল্লেখযোগ্যভাবে বোকা। সে নায়িকাকে নিয়ে সিনেমা দেখতে বের হতে চলেছে।
১৭। গাড়িতে কথোপকথন। পাত্র হিসেবে লোকটি নেহায়েতই সহজ-সরল অন্যদিকে নায়িকা পাত্রী হিসেবে তার কাছে বেশ অবিশ্লেষণযোগ্য।
১৮। নায়িকার সম্ভাব্য পাত্রটি সিনেমা দেখেতে এসেছে টিকেট ছাড়া। টিকেট আনতে ভুলে গেছে বেচারা। এই ভুলে যাওয়া আর অন্যমনষ্কতা নিয়ে নায়িকা বিশেষ পেরেশান। এটা রোগের পর্যায়ে চলে গেছে। মনের ডাক্তার দেখানো দরকার।
১৯। পাত্র ছুটলেন নায়ক মহাশয়ের কাছে। এই ভুলে যাওয়া ও অন্যমনষ্কতার চিকিৎসা চলুক তবে।
২০। ডাক্তারি শেষে ঘরে ফিরেছে নায়ক। নায়কের বোন একটি নাচ-গানের স্কুলের সাথে যুক্ত। সেই স্কুলের একটি বিনোদন অনুষ্ঠান হবে কিছুদিন পর। অনুষ্ঠানের টিকেট বিক্রি করে কিছু টাকা হাতিয়ে নেয়ার চেষ্টা চলছে নায়কের বোনের । হঠাৎই স্কুল ম্যাগাজিনে নায়িকার ছবিতে চোখ আটকে যায় নায়কের। সুটকেসে পাওয়া ছবি আর নামের মিলটা ধরতে সময় লাগে না মোটেও।
২১। নায়কের বোন আর নায়িকা একই গানের স্কুলের সহপাঠী। নাচের অনুষ্ঠানের টিকেট আর বোনের হাতখরচের যোগান দেয়া হচ্ছে, বিনিময়ে নায়িকার খোঁজখবর চাই- টাটকা!
২২। নাচের অনুষ্ঠানে নায়িকা নৃত্যশৈলী দিয়ে নায়কসহ অনেক দর্শককেই ধরাশায়ী করে চেলছে। নায়ক মহাশয়ও চুপি চুপি গিয়ে নায়িকা দর্শন দিয়ে আসলেন।
২৩। খবর পাওয়া গেল, নায়িকা আবারও বেড়াতে গেছেন মামার বাড়িতে। এবার গোঁফ ছেটে নায়িকার পিছু নেন নায়ক (নায়িকাকে বিশেষ মনে ধরেছে তো- তাই!)। নায়িকার মামা একজন উদ্ভিদ বিশেষঙ্গ। মামার লেখা একটি বইয়ে অটোগ্রাফের বাহানা ধরে তাদের সাথে বেশ খাতির জমিয়ে ফেলে নায়ক।
২৪। কপাল আর কাকে বলে। নায়িকার সম্ভাব্য বিয়ের পাত্রও সেখানে সারপ্রাইজ ভিজিট দিয়ে বসেন। ছুটি কাটাতে নায়িকার কাছে ভিড় জমানো আর কি। পাত্রের বেশ খটকা লাগছে নায়ক মহাশয়কে দেখে, একবার মনে হচ্ছে তাকে দেখেছেন আবার ভাবছেন তার অন্যমনষ্কতা রোগটা হয়ত প্রকট হচ্ছে। তিনি কি সেই মানসিক রোগের চিকিৎসক না? নাহ, অন্য কেউ। গোঁফ নেই যখন হয়ত, সেই ডাক্তার নন।
২৫। নায়িকাকে পটিয়ে ফেলতে আবডালে বেশ মেহনত করেন নায়ক। এবং মোটামুটি সফল হচ্ছেন বলে মনে হল।
২৬। বেড়ানো শেষে আবার শহরে ফিরে আসেন নায়ক, নায়িকা। তাদের কোন যোগাযোগ নেই। হঠাৎ করেই নায়ক ফোন পান তার রোগি (নায়িকার সম্ভাব্য বিয়ের পাত্র) তার সাথে দেখা করতে চান। তিনি এপয়নমেন্ট দেন।
২৭। নিজের গোঁফ নেই। রোগি আসছে যিনি তাকে গোফ ছাড়া দেখে ফেলেছে নায়িকার মামার বাড়িতে। পরিচয় গোপন রাখা চাই। কি করা যায়, যদি তাকে চিনে ফেলে- এই ভয়ে ঘরে আলো নিভিয়ে দিয়ে, একটি টেবিল ল্যাম্প রোগির চোখ বরাবর রেখে কথাবার্তা শুরু হয়।
২৮। ডাক্তার নিজেই নায়িকার প্রেমে মশগুল। তাছাড়া মন বিশ্লেষণে নায়িকা তার (নায়িকার সম্ভাব্য বিয়ের পাত্রের) ঠিক মাননসই নয় এমন ঞ্জান ঝেড়ে নিজের রাস্তা পরিষ্কার করে চলেছেন ডাক্তার ওরফে নায়ক বাবাজি। ফাঁকে নিজের বোনকে ডাকেন, কৌশলে নিজের বোন আর ওই পাত্রের একটা রোমান্সের সূচনা ঘটিয়ে দেন।
২৯। নায়িকার সম্ভাব্য পাত্র, তার ডাক্তার ওরফে নায়ক মহাশয়কে বিষেশভাবে ধরেন নায়িকার সাথে একটু কথা বলতে- এতে যদি তার সম্ভাব্য বিয়ের পাত্রীর সাথে তার মানসিক দ্বন্দ্বের একটা চিত্র পাওয়া যায়। নায়ক গোঁফ লাগিয়ে, ডাক্তার সেঁজে নায়িকার বাড়িতে যান এবং দুর্ঘটনা বলে তারই আরেক পুরোনো রোগির সাথে নায়িকার সামনেই ধরা খেয়ে যান। পুরোনো রোগিটি সুন্দর করে নায়ক মহাশয়ের পূর্ণ পরিচয় নায়িকাকে শুনিয়ে দেন- নায়িকা বুঝতে পারে, ইনিই সেই লোক যে যার সাথে তার সুটেকস বদল হয়ে গিয়েছিল এবং তার ভাইয়ের ছবিতে ইনিই গোঁফ এঁকে দিয়েছিলেন। ব্যাটা ছদ্মবেশে ঘরে ঢুকেছে- বের হ!
৩০। দাবড়ানি টাইপের ঘটনার পরেই নায়ক ও তার রোগি কেটে পড়েন।
৩১। এরই মাঝে একদিন মনটা কেমন কেমন করতে থাকে নায়কের। নায়িকার মামার লেখার ভক্ত সেঁজে, গোঁফবিহীন রুপে চলে যান নায়িকার বাড়িতে। নায়িকার মামার নতুন বই বেরুচ্ছে, সেই উপলক্ষকে কাজে লাগিয়ে নায়িকা দর্শন কার্যক্রম।
৩২। মামার লেখার ভক্ত ছদ্মবেশি নায়ককে প্রসঙ্গক্রমে নায়িকা ডাক্তারকে দাবড়ানির ঘটনাটা বলেন। নায়ক নিজেই সেই ডাক্তার আজও ছদ্মবেশে আছেন- সবমিলিয়ে মনে মনে খিঁচুড়ি খাচ্ছেন। আসার পথে নায়িকাকে ঞ্জান দিয়ে আসেন। ‘ওই ডাক্তারের যতটা দোষ, আপনারও ততটা দোষ। ডাক্তার আপনার ভাইয়ের ছবিতে গোফ একেঁ দিয়েছিলেন আর আপনি ডাক্তারের সুটকেসের সন্দেশ খেয়ে ফেলেছিলেন’। পরোক্ষভাবে নিজের সাফাই গেয়ে নায়িকাকে বিরহে ভাসিয়ে বিদায় নেন। নায়িকা ভাবেন- নাহ, ডাক্তার ব্যাটার কাছে ক্ষমা চাওয়া দরকার।
৩৩। নায়িকা ডাক্তারের চেম্বারে যান। দু’জনের ক্ষমা সুলভ মিষ্টি মিষ্টি আলাপ চলে।
৩৪। নায়ক ছলেবলে কৌশলে, কথার মারপ্যাঁচে নায়িকার মনের কাছে চলে আসেন। এক পর্যায়ে বেশ নাটকীয়ভাবে নিজের ছদ্মবেশ খুলে দেন। সুটকেস বদলের ডাক্তার এবং তার মামার লেখার ভক্তজন- দু’জনই এক, ইনিই সে! নায়িকা সাময়িক মূর্ছা যান।
৩৫। নায়িকা চেতনা ফিরে পান তখ্খুনি। আগে থেকেই একটা রেকর্ডারে রেকর্ড করে রাখা নায়কের মনের কথামালা বাজতে থাকে। নায়িকার সলজ্জ অভিমান রুপ নেয় প্রণয়ে। শুরু হয় ভালোবাসার গল্পটি।
সর্বশেষ এডিট : ১৯ শে জানুয়ারি, ২০১৩ রাত ১১:৩৯