পুলিশের নির্বুদ্ধিতার খেসারতে শ্রীঘরে যেতে হয়েছিলো কয়েকদিনের জন্য।
সেখানে গিয়ে মোটেও কষ্ট হয়নি। বরং বেশ আরামেই ছিলাম। আমদানি থেকে মেঘনা ৫ এ ট্রান্সফার করার হয় একদিন পর। পুরাতনদের সাথে কথা বলতে গিয়ে পরিচয় দিলাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ি।
এটা প্রথমে বিশ্বাস হলেও পরে বিশ্বাস করানো অসম্ভব হয়ে পড়ে।
যদি প্রশ্ন করেন কেন?
কয়েকটি ক্ষেত্রে তারা আমাকে সন্দেহের দৃষ্টিতে দেখা শুরু করে যে আদৌ আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের বারান্দায় পা দিয়েছি কিনা।
প্রথমত-
ঘুমানোর ক্ষেত্রে যখন আমি অন্যান্যদের চেয়ে নিশ্চিন্তে নির্বিঘ্নে বেশ আরামেই চিপার মধ্যে শুয়ে পড়তাম, এক ঘুমেই এক কাতেই ফজরের আজান পার করে দিতাম তখন ওদের মধ্যে জেগে থাকা বেচারাদের মুখের দিকে তাকাতে সাহস হতনা।
বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন ছাত্র মানে সে দেশের প্রথম শ্রেণির কিছু একটা। সে তো রাজার হালে থাকতে অভ্যস্ত থাকার কথা। কিন্তু এ ব্যাটা তো দেখছি চাষাভুষোর জাত। এই গাদাগাদির মধ্যেও দিব্বি আরামে নাক ডেকে ঘুমোচ্ছে।
দ্বিতীয়ত-
গন্ধময় ভাত, আর দুর্গেল্য (সহজে গেলা যায় না এমন) খাবার আমি চোখ বুজে খেয়ে যাচ্ছি অনায়াসেই।
সকালের নাস্তা আর গোনাগুনতির কাজ শেষ হলেই বেরিয়ে যাই এদিক-সেদিক যতদূর কেউ বাঁধা না দেয়। চোর, ডাকাত, খুনি, ধর্ষক, নিরপরাধ সকল কিসিমের মানুষের সাথে পরিচিত হই আড্ডা দিই, তাদের গাঁটের পয়সায় কেনা নাস্তা খেয়ে সময় মত ফিরে আসি ডেরায়। মনে কোনো কষ্ট নেই।
এসব দেখে একজন এক ভদ্রলোক (যিনি জালিয়াতির মামলায় ভিতরে আছেন) প্রশ্ন করেই বসলেন, প্রশ্ন কি বলবো জেরা করা শুরু করলেন আমাকে।
ভদ্রলোক: কোন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ো
লেখক: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে
ঃ কোন বিভাগে? ......বিভাগে, অমুক স্যার কে চেনো?
-চিনি।
-উনি কি পড়ান?
-উনি আমাদের এখনো ক্লাস নেননি।
- কোথায় থাকো?
-মহসীন হলে।
-কতদিন ধরে আছো?
-এই ধরেন তিন বছরের একটু বেশিই হবে।
-প্রভোস্ট কে এখন?
-আক্কাস স্যার।
-অমুককে চেনো, হাউস টিউটর ছিলেন?
-জ্বি চিনি।
-উনি আমার পরিচিত। আমি জিজ্ঞেস করলাম আংকেল এতকিছু জানেন কি করে? উনি বললেন আমি জাতীয়তে পড়েছি অনেক আগের কথা, মুহসীন হলে এক বন্ধুর সাথে থাকতাম। তখন তোমাদের জন্ম ও হয়নি বোধহয়।
আমি মাথা নেড়ে বললাম হবে হয়তো।
উনি এবার মূলকথায় এলেন " তোমাকে এতকথা জিজ্ঞেস করছি কেন জানো?"
মাথা নেড়ে বললাম উহু, জানিনা।
" এই কষ্টকর পরিবেশে তোমার স্বচ্ছন্দ চলাফেরা, খাওয়া দাওয়া দেখে আমার মনে হয়েছিলো তুমি নির্ঘাত দাগী আসামী, বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিচয় দিয়ে সুবিধা নেয়ার চেষ্টা করছ" কারণ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মত প্রতিষ্ঠানের একজন ছাত্র এই পরিবেশ, এই খাবার, এই শোয়ার জায়গা, টয়লেট দেখে তো অসুস্থ হয়ে পড়ার কথা, বাস করাতো দূরে থাক।
আমি তাকে গণরুমের কথা বলিনি, ক্যান্টিনের পচা-আধসিদ্ধ খাবারের কথা, হলের টয়লেট, কলাভবনের টয়লেটের কথা তাকে বলিনি। উনি হয়ত কষ্ট পাবেন অথবা ঢাবির প্রতি নেতিবাচক ধারণা তৈরি হবে তার এজন্য। কখনো বাড়িতেও বলতাম না তাদের সোনার টুকরা ছেলেগুলি কিভাবে ঘুমায়, কি খায় শুধু বলি ভালো আছি বেশ ভালো, রাজার হালে। দেশের সেরা জায়গায়।
এখানে মূর্তির (স্যরি ভাস্কর্য হবে) গায়ে কাদা লাগলেও চিল্লাচিল্লি শুরু হয়ে যায়, কর্তৃপক্ষের মাথা ঘামে, বাইরের লোকজনের জন্য ক্যাম্পাসের এ চত্বর সে চত্বরের পেছনে কোটি কোটি টাকা খরচ করা হয়।
অথচ এস এম হলের বারান্দা, মুহসীন হলের ১০২৭, জহু হলের টিনশেড, জিয়া হলের টিভি রুমে ঘুমানো ছাত্রদের জন্য কারো মাথা ঘামেনা।
প্রথম দু'বছর মনে হয় পড়াশুনা করার জন্য বিশ্ববিদ্যালয় না। শরণার্থীর মত দুবছর পর সিট পাবো এই আশায় কেটে যায়, কারো কারো ভাগ্যে ৫ বছরের ছাত্রজীবনে সিট পাওয়া আর হয়ে ওঠেনা। তাই তো হাফিজুরের মত ছাত্ররা নিউমোনিয়াতে মারা গেলে কার কি যায় আসে? সে কেন কই মাছের মত প্রাণ নিয়ে আসেনি এখানে?
বিশ্ববিদ্যালয়ের গেট, ভিসি চত্বর, জগন্নাথ হলের মূর্তি, সেন্ট্রাল লাইব্রেরির সামনের চত্বর এসবের সৌন্দর্য বাড়ানোর জন্য বরাদ্দ হয়, গণরুমের ছেলে/মেয়েদের জন্য বরাদ্দ হয়না যেন এটাই ওদের নিয়তি।
এই সুযোগ-সুবিধা, পরিবেশ-বঞ্চিত ছেলেরা রাস্তায় একটু উলটা দিক দিয়ে বাস চালালেই নিয়মের সংবিধান চালাচালি শুরু হয়, দুএকবার ফাউ খেলেই মাথাব্যথা শুরু হয় নীতিবাগীশদের।
আরে ভাই, আগে বড় দুর্নীতিবাজদের দিকে তাকান, গণরুমের ছেলেরা ব্যাঙ্ক লুট করতে যায়নাই, খুন মার্ডার করে নাই, বিদেশে অর্থ পাচার করে নাই। ওরা সুবিধা-বঞ্চিত, ওরা যদি লড়াই করতে মাঠেও যায় আমি অবাক হবোনা, বাঁধাও দেবোনা।
সর্বশেষ এডিট : ২৮ শে এপ্রিল, ২০১৬ রাত ৩:২৪