অলিম্পিয়ান দেবতাদের রাজা জিউস তার অনেক প্রেমের প্রণয়ের জন্য কুখ্যাত ছিল। প্রণয়ের কোন সুযোগ পেলে সে ছাড়তো না। বিশেষ করে তখন - যখন দেবতাদের রাণী তার স্ত্রী হেরা অন্য কাজে ব্যস্ত থাকতো।
ইকো নামের এক কম বয়সী সুন্দরী বনদেবীও বাস করতো তখন। গাছ এবং পর্বত এই দুই-ই ছিল তার সব। খুবই হাস্যোজ্জ্বল ও প্রাঞ্জল ছিল সে। কিন্তু তার ভয়ানক একটা বদঅভ্যাস ছিল। খুব বেশি কথা বলত। ‘বাঁচাল’ বলেই আখ্যায়িত সে। তার কাছে তার নিজের গলার সুরের চেয়ে মধুর আর কিছু ছিল না।
একদিন, ইকো রাণী হেরার সাথে তার স্বভাবসুলভ বাঁচালতা বজায় রেখে আলাপে মেতেছিল। হেরাও তার সাথে কথা বলতে বলতে আলাপে মশগুল হয়ে পড়েছিল।
এটা দেখে জিউসের মাথায় কুবুদ্ধি খেললো। সে সুযোগ কখনোই হাত ছাড়া করতো না। রাণী ব্যস্ত। সেই সুযোগে মর্ত্যের বনদেবী ও জলপরীদের সাথে প্রণয়ের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়লো। সফলও হল।
হেরা এটা জানতে পেরে ক্রুদ্ধ হল। কিন্তু অলিম্পিয়ানদের শাসক জিউসে বিরুদ্ধে কোন পদক্ষেপ নেওয়ার মত কোন শক্তি তার ছিল না। তাই কোপটা পড়লো বেচারী ইকোর উপরই।
হেরা মনে করছিল, ইকো জিউসের সাথে মিলে কাজ করছে। তার সাথে কথা বলার ছলে তাকে ব্যস্ত রেখে জিউসকে ইকোই সুযোগ করে দিয়েছে। কিন্তু সত্য এটাই যে, ইকো আসলে জিউসের কার্যকলাপ সম্পর্কে কিছুই জানতো না।
কিন্তু হেরা তা মানতে রাজি নয়। শাস্তি দেওয়ার জন্য কেড়ে নিল ইকোর সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদটাকেই। ইকো কোন কথা বলতে পারবে না আর নিজে থেকে। সে শুধু তাই বলতে পারবে যা অন্য কেউ তাকে বলবে। শুধু অন্যের কথার অনুকরণ করে যেতে হবে তাকে।
সেই সময় নার্সিসাস নামের এক দাম্ভিক যুবকও বাস করতো। সে ছিল নীলপরী লেইরিওপে ও নদ-দেবতা সেফিসাসের ছেলে।
লেইরিওপে তার ছেলের সুস্বাস্থ্য ও ভবিষ্যৎ নিয়ে খুব বেশি ভাবতো। তার সন্তানের ভবিষ্যৎ কী হবে তা জানার জন্য ছুটে গেল টেইরেসিয়াস নামের এক জ্ঞানী ব্যক্তির কাছে।
জ্ঞানী ব্যক্তিটি জানালো, নার্সিসাস অনেক বছর বেঁচে থাকবে – তবে যতদিন সে নিজেকে না চিনে থাকবে।
নার্সিসাস বাচ্চা বয়স থেকেই অনেক বেশি সুন্দর ছিল দেখতে। বড় হতে হতে সুদর্শন যুবক হয়ে উঠলো। পুরুষ ও নারী উভয়েই তাকে তার সৌন্দর্য্যের জন্য চাইতো। কিন্তু দাম্ভিক নার্সিসাস সবাইকেই ফিরিয়ে দিত। নার্সিসাসের কোন ইচ্ছাই ছিল না কোন প্রেমের সম্পর্কে জড়ানোর বা কাউকে ভালবাসার।
বনের মাঝে একদিন নার্সিসাসকে দেখে তার প্রেমে পড়ে গেল ইকো। সবসময়ই সে চাইতো নার্সিসাসের সাথে একটু কথা বলতে। কিন্তু কথা বলার ক্ষমতা তার থেকে কেড়ে নেওয়া হয়েছিল। তাই সে শুধু দেখেই যেত নার্সিসাসকে, আশায় থাকতো কখন নার্সিসাসকে দেখতে পারবে। তাকে অনুসরণ করতো।
একদিন ঝোপের আড়ালে থেকে নার্সিসাসকে অনুসরণ করছিল ইকো। নার্সিসাস তার পিছনে মৃদু পায়ের শব্দ শুনে থেমে গেল। কিন্তু কাউকে পেল না। আবার হাঁটা শুরু করলো, আবারো শব্দটা শুনতে পেল। থমকে গিয়ে চেঁচিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
‘কে এখানে?’
ইকো ঝোপের আড়াল থেকে বলল, ‘কে এখানে?’ এইটুকুই সে বলতে পারবে।
নার্সিসাস আবারো বললো, ‘এসো!’
ইকোও বলল, ‘এসো!’
‘আমাকে এড়িয়ে চলছো কেন? এসো একসাথে হই!’ নার্সিসাস বলল।
ইকো খুশি হয়ে উঠলো। নার্সিসাস তাকে তার সাথে মিলিত হওয়ার জন্য ডেকেছে। সে নার্সিসাসকে জানাতে চাইলো সে কে আর সে কতটুকু ভালবাসে নার্সিসাসকে। কিন্তু বলতে পারলো না। দৌড়ে গেলে তার দিকে এবং জড়িয়ে ধরলো।
রেগে গেল নার্সিসাস। ‘হাত সরাও! তুমি আমাকে পাবে, সেটা চিন্তা করার থেকে আমার মরে যাওয়া ভাল!’ ঝাড়া দিয়ে ফেলে দিল ইকোকে।
হৃদয় ভেঙ্গে গেল ইকোর। অপমানিত হল। লজ্জিত হয়ে ছূটে গেল পর্বতের দিকে। সেই পর্বতেই রয়ে গেল। কষ্ট পেয়ে গেল সেই ভালবাসার জন্য যেটার প্রতিদান সে কখনো পায়নি, পাবেও না। কষ্টে কষ্টেই মৃত্যু হল তার। তার শরীর পাথর হয়ে মিশে গেল পর্বতের অন্যান্য পাথরগুলোর সাথে। শুধু রয়ে গেল তার স্বরটা। যা দিয়ে শুধু অন্য কেউ কিছু বললে সেটাই বলতে পারতো।
নার্সিসাসের দম্ভ ততদিনে বাড়ছিলোই। তার প্রেমে পড়া দেবীদের সংখ্যা বাড়ছিলোই। দাম্ভিক নার্সিসাস কষ্ট দিত সবাইকেই। তার প্রেমে পড়া এক জলপরীর তার প্রতি ভালবাসা পরীক্ষার করার জন্য ছুরি দিয়ে পরীকে আত্নহননই করতে বলেছিল।
পরীও তাই করেছিল। মৃত্যুর আগে অভিশাপ দিয়েছিল নার্সিসাসের উপর।
দেবতারা তার এইরূপ আচরণ দেখে ক্ষীপ্ত হল। তাকে শিক্ষা দেওয়া পণ করলো। তাকে এটা বুঝতে হবে যে কেউ ভালবাসলে তাকে সেটার প্রতিদান না দিলে কেমন লাগে! ঠিক করলো, নার্সিসাসকে এমন একজনের প্রেমে পড়াতে – যে বাস্তব না এবং কখনোই তার ভালবাসার প্রতিদান দিতে পারবে না।
একদিন সুর্যাস্ত উপভোগ করছিল নার্সিসাস। তেষ্টা পাওয়ায় পুকুরের কাছে গেল পানি পান করতে। পানিতে নিজের অবয়ব দেখে চমকে উঠলো। সে এটাকে ভাবছিল, এটা বুঝি সুন্দর কোন পানির দেবতা। সে তার নিজেকে চিনতো না, নিজের সম্পর্ক জানতো না। তাই মুহুর্তেই তার নিজের প্রতিচ্ছবির প্রেমে পড়ে গেল। নার্সিসাস মাথা নিচু করলো, অবয়বটাও তাই করলো। এটাকে সম্মতির লক্ষণ মনে করে ছুতে গেল। পানি নড়ে যাওয়ায় প্রতিচ্ছবিটা এলোমেলো হয়ে গেল। ভয় পেয়ে গেল নার্সিসাস। কোথায় গেল তার ভালবাসা?
পানি আবার স্থির হল। প্রতিচ্ছবিটাও আবার ভেসে উঠলো। তখন নার্সিসাস বললো,
‘কেন, কেন তুমি আমাকে এড়িয়ে যাচ্ছ? নিশ্চয় আমার চেহারা তোমাকে আমার থেকে দূর করে দিচ্ছে না। পরীরা আমাকে ভালবাসে। এবং তুমিও তাদের থেকে ব্যতিক্রম নও। আমি হাত প্রসারিত করলে তুমিও করো। আমার দিকে তাকিয়ে হাসো। আমার মত করেই আমার ইশারার জবাব দাও।’
বলে আবার ছুতে গেল। এবং আবারও প্রতিচ্ছবিটা হারিয়ে গেল। নার্সিসাস পানিকে স্পর্শ করতে ভয় পেয়ে গেল। পুকুরটার পাশে বসে থেকে তার প্রতিচ্ছবিটার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো।
হতাশায় কাঁদতে শুরু করলো সে, ঠিক যেভাবে ইকো কাঁদতো। সে নড়তো না, খেত না, পানও করতো না। সে শুধু কষ্টই পেত। তার সৌন্দর্য ম্লান হতে শুরু করলো। পরীরা যারা তাকে ভালবাসতো তারা মিনতি করলো পানির কাছে থেকে সরে আসার। ইকোর আত্নাও তাই করলো। কিন্তু সে অবিচল, নার্সিসাস সেখানেই থাকতে চাইছিলো।
ইকোর মত করেই কষ্ট পেতে পেতে মরে গেল নার্সিসাস। দেহটা হারিয়ে গেল কোথায় যেন! যেখানে সে শুয়েছিল সেখানে ফুঁটে উঠলো সুন্দর কিছু ফুল।
পর্বতে থাকা ইকো, নার্সিসাসের জন্য সবসময় কেঁদেই যাচ্ছিল।
নার্সিসাসের মৃত্যুর পর জন্মানো সেই ফুল। বাংলাদেশে এইটা খুব সম্ভবত নার্গিস ফুল নামে পরিচিত। নিশ্চিত না আমি।
----
এটা আসলে গ্রীক মিথ নাকি রোমান মিথ নাকি গ্রীক-রোমান মিলিত মিথ - তা জানিনা। একেক জায়গায় একেক রকমের কথা বলা।
গল্পটাও একেক জায়গায় একেক রকম ভাবে উপস্থাপন করা। প্রায় দশ-বারোটা ভিন্নরকমের গল্প পড়ে এইটা নিজের মত করেই লিখেছি।
তবে যেহেতু রেফারেন্স হিসেবে অনেকগুলো মাধ্যমের সাহায্য নিয়েছি - তাই পুরোপুরি মৌলিক ছাপটা পাওয়া নাও যেতে পারে।
পাঠকদের যেইসব জায়গায় অসঙ্গতি লাগবে - সেই জায়গাগুলো চিহ্নিত করে দেওয়ার অনুরোধ জানালাম।
----
গল্পটায় ওভার অল - শেখার মত বেশ কয়েকটা বিষয়ই আছে।
সর্বশেষ এডিট : ১৪ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৬ ভোর ৬:৩৬