বিষণ্ণতায় ভোগা রাজকন্যার মুখে হাসি ফোটাতে ভিনদেশ থেকে আসা ছদ্মবেশী রাজকুমারটি শেষ মেশ বেরিয়ে পড়লো অভিযানে। বহুপথ, বহু খোঁজাখুঁজির পর শক্ররাজ্যের এক পর্বতমালার নিচে অবশেষে পাওয়া গেল সে অত্যাশ্চার্য নীলকমল।অতঃপর সে নীলকমল হাতে পেয়ে হাসিতে উদ্ভাসিত হল রাজকুমারীর বিষণ্ণ মুখ। সে হাসি, সে রূপের বিভায় সবার চোখ ধাঁধিয়ে গেল। রূপের এমন রোশনাই যে সচরাচর চোখে পড়ে না।আর রাজকুমার? সে দাঁড়িয়ে রইলো এক কোণে, সহায্যপ্রার্থীদের কাতারে। কেউ দেখেনি তার ক্ষতবিক্ষত করতল, রক্তের ক্ষীণধারা আর ছেঁড়াফাটা পোশাক...
প্রখ্যাত অভিনেতা রবিন উইলিয়ামস (২১ জুলাই ১৯৫১-১১ আগস্ট, ২০১৪), সহজাত অভিনয় ক্ষমতা দিয়ে যিনি আলো ছড়িয়েছিলেন গোটা দুনিয়ায়। স্ট্যান্ড আপ কমেডি দিয়েই মূলত শুরু, এরপর টেলিভিশন, থিয়েটার, চলচ্চিত্রসহ অভিনয়ের প্রায় প্রতিটি মাধ্যমেই শীর্ষ স্পর্শ করেছেন।তাঁর তুখোড় রসবোধ আর অভিনয়শৈলী দেখে সবচেয়ে গোমড়ামুখো দর্শকটিকেও হার মানতে হয়েছিল। প্যাচ এডামস চলচ্চিত্রে প্যাঙ্ক্র্যাটিক ক্যান্সারে আক্রান্ত বদরাগী মিস্টার ডেভিসের হুমকি ধামকিতে পুরো হাসপাতাল যখন তটস্থ, তখন নাম ভূমিকায় অভিনয় করা রবিন উইলিয়ামসই কবিতার পঙক্তি শুনিয়ে তাঁকে শান্ত করেছিলেন।এখানেই শেষ নয়, মৃত্যুর ঠিক আগমুহূর্তটিতেও প্যাচ এডামস ডেভিস সাহেবের সঙ্গ ছাড়েননি, নীলাকাশের গান শুনিয়েই তাঁকে জানিয়েছিলেন শেষ বিদায়।শুধু নিজের শেষ মুহূর্তটিতেই কাউকে পাশে পান নি উইলিয়ামস। ক্যালিফোর্নিয়ার নিজ বাসার শয়নকক্ষে তাঁর মৃতদেহটি দীর্ঘক্ষণ পড়েছিল নিঃসঙ্গ, রাত্রির হিমে মাখামাখি হয়ে।গোটা দুনিয়ার তামাম গোমড়ামুখোদের দমফাটানো হাসির যত উপলক্ষ এনে দেওয়া কৌতুক অভিনেতাদের যেন এটাই অলঙ্ঘনীয় পরিণতি।উইলিয়ামস যাকে গুরু মানতেন, সেই হাসির রাজা জোনাথন উইন্টারসও দীর্ঘদিন ভুগেছিলেন বিষণ্ণতা রোগে। তালিকাটি বেশ সাবলীলভাবেই আরো দীর্ঘ করে দিয়েছিলেন কিংবদন্তী চার্লি চ্যাপলিন, রিচার্ড প্রায়ার আর জন বেলুশীর মত ফানিম্যানরা।মিচ হেডবার্গ, ফ্রেডি প্রিঞ্জ আর রিচার্ড জ্যানির মত ক’জনতো এর ধকল সামলাতে না পেরে বিদায়ই চেয়ে নিয়েছিলেন।কিংবদন্তী রিচার্ড প্রায়ার বড় হয়েছিলেন পতিতালয়ে, অনাহারের সাথে তাঁর ছিল নিত্য বসবাস আর পরিণত বয়সে বিবাহ বিচ্ছেদের মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছিল একাধিকবার। ভাগ্যের সাথে এমন অসম লড়াইয়ের মুখোমুখি হয়ে যাওয়া প্রায়ার অতঃপর সিদ্ধান্ত নিলেন তাঁর দুর্ভাগ্যকেই কৌতুকের উপলক্ষ বানানোর। কৌতুকই প্রকারান্তরে তাঁর নিজেকে রক্তাক্ত করার উপকরণে পরিণত হয়েছিল। রম্য, রক্ত আর পরিহাসের নিপাট সরলীকরণে যাত্রা শুরু হল অভূতপূর্ব এক ক্যাথারসিসের।
প্রায়ারের দৃষ্টিভঙ্গি আর জীবনবোধ উইলিয়ামসকেও প্রভাবিত করেছে পুরো ক্যারিয়ার জুড়ে। বিষণ্ণতা, মাদকসহ নানান সমস্যায় ভোগা উইলিয়ামসও নানান সময় নিজেকে নিয়ে পরিহাস করেছেন, অকপটে দিয়েছেন স্বীকারোক্তি আর বলেছেন প্রায়শ্চিত্তের কথা।এ যেন হাসি দিয়ে দুঃখকে ভোলার এক অক্ষম চেষ্টামাত্র। তাহলে কি রূপালি পর্দার ফানিম্যানদের হাস্যরসের জ্বালানি হিসেবে তাঁদের ব্যক্তিগত অপ্রাপ্তি, কষ্ট আর বিষাদগুলোই কাজ করে?উইলিয়ামসের এমন করুণ মৃত্যুর পর সাধারণ পাঠক আর দর্শকেরাও এ প্রসঙ্গে নড়ে চড়ে বসছেন। তাঁর মৃত্যুর চবিবশ ঘন্টার মধ্যে গুগলে প্রায় পনের লক্ষ বার ‘ঈড়সবফরধহ+উবঢ়ৎবংংরড়হহ কি ওয়ার্ডগুলো সার্চ করা হয়েছে।কৌতুক অভিনেতা সেথ হার্জোগ এক্ষেত্রে অবশ্য পৌঁছে গিয়েছিলেন বটম লাইনের প্রায় কাছাকাছি- ঈড়সবফু খড়াবং গরংবৎুহউইলিয়ামসের মতন অনেক অভিনেতাই তাঁদের হাস্যরসের উৎস প্রোথিত করেছিলেন তাঁদের ব্যক্তিগত দুর্দশার গভীরে। সেই শেকড়কে অবলম্বন করেই কমেডির শিল্পকর্মটি তাঁরা গড়ে তুলেছিলেন। অতঃপর প্রক্রিয়ার শেষাংশে স্রষ্টা যেন নিজেকে ধ্বংসের মাধ্যমেই সেই শিল্পকর্মের সমাপ্তি ঘোষণা করেন।কিংবদন্তী রবিন উইলিয়ামস নিজেও এই আত্মঘাতী প্রক্রিয়া হতে বের হয়ে আসতে পারেননি। রঙ্গমঞ্চে দাঁড়িয়ে অজস্র মানুষের মুখে হাসি ফুটিয়ে দিনশেষে নিজেই বিদায় নিয়েছেন মলিন মুখে, অনেকটা আমাদের গল্পের সেই ছদ্মবেশী রাজকুমারের মতই। নিশুতি রাতের অাঁধারে তিনি সে না- দেখা জগতের উদ্দেশে যাত্রা শুরু করলেন একা, যখন নিঃশব্দে ডুবে গিয়েছিল পঞ্চমীর চাঁদ...
রবিন উইলিয়ামস অভিনীত উল্লেখযোগ্য কিছু টিভি সিরিজ এবং চলচ্চিত্র:মর্ক এন্ড মিন্ডি (১৯৮২), গুড মর্নিং ভিয়েতনাম (১৯৮৭), ডেড পোয়েট’স সোসাইটি (১৯৮৯), আলাদীন (১৯৯২), মিসেস ডাউটফায়ার (১৯৯৩), জুমানজি (১৯৯৫), দ্যা বার্ডকেইজ (১৯৯৬), গুড উইল হান্টিং (১৯৯৭), প্যাচ এডামস (১৯৯৮), হ্যাপি ফিট (২০০৬), নাইট এট দ্যা মিউজিয়াম (২০০৬)।
পুরস্কার এবং স্বীকৃতি:
গোল্ডেন গ্লোব এ্যাওয়ার্ড, শ্রেষ্ঠ অভিনেতা- মর্ক এন্ড মিন্ডি (১৯৮২), গ্ল্যামি এ্যাওয়ার্ড, বেস্ট কমেডি এ্যালবাম- গুড মর্নিং ভিয়েতনাম (১৯৮৯), এমটিভি মুভি এ্যাওয়ার্ড, শ্রেষ্ঠ কৌতুক অভিনেতা- মিসেস ডাউটফায়ার (১৯৯৪), গোল্ডেন গ্লোব এ্যাওয়ার্ড, শ্রেষ্ঠ অভিনেতা- গুড উইল হান্টিং (১৯৯৮), একাডেমী এ্যাওয়ার্ড, শ্রেষ্ঠ অভিনেতা (সাপোর্টিং রোল)- গুড উইল হান্টিং (১৯৯৮)
Published on Daily Purbokone, Friday, 12 September, 2014
সর্বশেষ এডিট : ০৬ ই নভেম্বর, ২০১৪ রাত ৮:০৭