অর্ধচন্দ্রাকৃতি উপত্যকার শেষমাথায় ঝুলে আছে ছ’টি পাথর। পাথর শব্দটি শোনামাত্র রেললাইনের ধারের রোগা পটকা ধূলিমলিন যে সব পাথরের কথা কল্পনায় ভেসে ওঠে, তেমন কিছু নয়। প্রাগৌতিহাসিক সময়ের ভীমাকৃতির ছ’টি পুরনো পাথর।
বয়স হাজার পেরিয়েছে তবু চামড়ায় ভাঁজ পড়েনি, কুমারী নদীটি বহুদূর হতে জল বয়ে এনে প্রতিদিন তাদের স্নান করিয়ে দেয় যে!
অগ্নিগিরি জননীকে প্রসব যন্ত্রণার চূড়ান্তটুকু দিয়ে তারা বের হয়ে এসেছিল। আগমনে ছিলনা নবজাতকের শৈশব বরং সদ্যতরুণ ঘোড়াসওয়ারের মতো টগবগিয়ে তারা কাঁপিয়ে দিয়েছিল ঘুমন্ত বসুন্ধরাকে। তারপর বহু গিরিখাত, রাজপথ, সবুজ বন আর হাঁট বাজার দুরমুশ করে দিয়ে অবশেষে ওরা থেমেছে এই উপত্যকার শেষ মাথায়।
এরপর শতশত বছর ধরে তারা স্থানু হয়ে আছে এখানটাতেই। স্থির কিন্তু প্রাণহীন নয়, যেকোন মুহূর্তেই যেন লাফিয়ে উঠবে বাইসনের ক্ষিপ্রতায়। আমি ভালো সাতার জানিনা। এসেছি উলটোপথ ধরে, একটি অর্ধমৃত পাহাড়ি নদীর ধ্বংসাবশেষ অনুসরণ করে। অরণ্যর যতো গভীরে প্রবেশ করেছি, নদীর গভীরতা ততই বেড়েছে। শেষমেশ পরিস্থিতি এমন দাঁড়ালো- পায়ে হেঁটে আর এগুনোর উপায় থাকলোনা। অতঃপর ভাসতে থাকা একটি গাছের গুঁড়ির উপর চড়ে বসে লম্বা একটি বাঁশকে বৈঠা বানিয়ে প্রবেশ করলাম অর্ধেক চাঁদ আকারের সে মঞ্চর ভেতর।
বহু উপরে উপত্যকার ধার ঘেঁষে দাড়িয়ে থাকা ছ’টি পাথর যেন ছ’টি ভাই। অর্ধচন্দ্রাকৃতি এই মঞ্চটি যেন একটি গ্রীক কলোসাম। বুনো বাঁশটি হাতে দাড়িয়ে থাকা আমি যেন একজন গ্ল্যাডিয়েটর, অপেক্ষা করছি প্রতিপক্ষের প্রবেশের জন্য।
আসার পথে নদীর জলে অসংখ্য মৃত বানরের খুলি ভাসতে দেখেছি। ভয় পাইনি, তবে একটা ব্যাপার নিশ্চিত হয়েছি- শহুরে মানুষের মত বনের প্রাণীদেরও যখন তখন যেখানে সেখানে মৃত্যু হতে পারে, স্বাভাবিক মৃত্যুর কোন গ্যারান্টি নেই কোথাও...
ভেতরে ঢুকে একপাশে বালির চর দেখতে পেয়ে আমি সেখানটাতে নেমে দাঁড়ালাম। বাঁশটা একপাশে নামিয়ে রেখে অতঃপর আমি জলে নেমে পড়লাম। জলে নামতেই অদ্ভুত একটা ব্যাপার হল। উপরের প্রাচীন গাছগুলোর ডালে হৈচৈ করতে থাকা পাখিগুলো হঠাৎ নিরব হয়ে গেল, ছ’টি পাথর যেন একই সাথে নড়ে উঠলো আলতো ভাবে। স্বচ্ছ জলে ডুব দিতেই আমি মুখোমুখি হয়ে গেলাম পাথরদলের সপ্তম ভাইটির, উন্মোচিত হল অভূতপূর্ব এক রহস্যের স্বরূপ।
ছ’টি পাথরের ঠিক মাঝখানটায় যেখান থেকে ঝর্ণা বেরিয়ে এসেছে, ঠিক সেখানটাতেই ছিল তাদের সাত নম্বর ভাইটি।
উপত্যকার শেষ মাথায় এসে ছয় ভাই যথাসময়ে ব্রেক কষে ফেললেও তাদের সবচেয়ে দুরন্ত ছোটভাইটি থামতে পারেনি। অনেক নিচের অতল গহ্বরে তাঁর সলিল সমাধি হয়ে গেছে বহুদিন হল। আর তারপর বাকি ছ ভাই আর ফিরে যায়নি, হতবুদ্ধি হয়ে দাড়িয়ে আছে সেখানটাতেই, উপত্যকার কিনারায় ...
পেছনের পাহাড় তাদের ডাকে, ফেরার জন্য। কিন্তু আদরের ছোট ভাইটিকে ফেলে তারা যায় কিভাবে! দুরন্ত সময়কে খুব গভীরে বন্দী করে তারা স্থির হয়ে আছে, যদি কখনো তাদের ছোট ভাইটি ফিরে আসে! মৌন পাহাড় দীর্ঘশ্বাস ফেলে, একবার গেলে না ফেরার দেশ থেকে কেউ কি ফিরেছে কখনো! একবার গেলে সেখান থেকে ফেরার আর কোন উপায় কি অবশিষ্ট থাকে!!
যেভাবে যাবেনঃ
ঢাকা থেকে যেতে হলে ঈগল/ শান্তি অথবা শ্যামলী পরিবহনের (কলাবাগান বাস স্টপ) খাগড়াছড়িগামী বাসে চড়ে বসুন। খাগড়াছড়িতে নেমে লোকাল বাস অথবা সিএনজি চালিত ট্যাক্সিতে চড়ে যেতে হবে পানছড়ি বাজারে।
পানছড়ি বাজার হতে চাঁদের গাড়িতে চড়ে বসলে সেটিই আপনাকে পৌঁছে দেবে ঝর্নাটিলা সংলগ্ন বিজিবি চেকপোস্টে। সেখানে প্রয়োজনীয় তথ্যাদি সরবরাহ করে অতঃপর পায়ে হেঁটেই রওনা দিতে হবে ঝর্ণাটিলা ঝর্ণার দিকে। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি অনুকূলে না থাকলে বিজিবি সদ্যসরা আপনাকে আঁটকে দিতে পারে। যেকারনে উত্তম হবে যাবার আগে সার্বিক পরিস্থিতি সম্পর্কে খোঁজ নিয়ে নিলে।
চেকপোস্টের আনুষ্ঠানিকতা শেষ হলে আপনাকে আরো দুই কিলোমিটারের মত হাঁটতে হবে, পাড়ি দিতে হবে দু দুটো পাহাড়। স্থানীয়দের মতে এ পাহাড়ে বিশাল আকৃতির একটি অজগর বাস করে, তথ্যর সত্যতা সম্পর্কে নিশ্চিত নই। তবে সতর্কতা অবলম্বন করাই স্রেয়। হঠাৎ করে একটি অজগরের সামনে পড়ে গিয়ে কি করি-কি করি করার চেয়ে আগে ভাগে চিন্তা ভাবনা করে নেওয়া ভালোনা!
দ্বিতীয় পাহাড়টি শেষ হলে সরু একটি খালের সন্ধান পাবেন, যেটি ধরে সোজা এগিয়ে গেলে দেখা পাবেন ঝর্ণাটিলার।
বিজিবি চেকপোস্ট থেকে শুরু করে বাকি পথটি বেশ দুর্গমই। সব মিলিয়ে খুব কম মানুষ ই সে পথ অতিক্রম করার সামর্থ্য রাখেন। অতএব ঝর্ণাটিলা যেতে চাইলে যথেষ্ট প্রস্তুতি নিয়ে তবেই রওনা হউন।
যেখানে থাকতে পারেনঃ
পানছড়িতে থাকার জন্য সেরকম মানের খুব বেশি হোটেল/ মোটেল নেই। পানছড়ি বাজারে শুকতারা বোর্ডিঙে কাজ চালিয়ে নিতে পারেন। দৈনিক গুনতে হবে একশ টাকা।
আরো যা কিছুঃ
অজগর সাপের ব্যাপারে একটু ধোঁয়াশা থেকেই যাচ্ছে, তবে একটা ব্যাপার নিশ্চিত করে বলতে পারি- পানছড়ি বাজার থেকে ঝর্ণাটিলা যাবার পথে আপনি একবার ডুববেনই... না নদী নয়, প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের কথা বলছি। যাবার পথে অজস্র বন, জংলী ফুল, পাহাড়ি পথ আপনার চোখে পড়বে। চাইলে পথের ধারের আদিবাসী চা দোকানীটির আতিথেয়তায় খেয়ে নিতে পারেন পাহাড়ি কলা আর চা।
আর পাহাড় তো আছেই। পার্বত্য চট্রগ্রামের অন্যান্য এলাকার মত খাগড়াছড়িতেও আপনার চোখে পড়বে অজস্র পাহাড় আর টিলা। তবে এতোগুলো নিরেট পাহাড় মিলেও কিন্তু থামাতে পারেনি চেঙ্গি নদীর প্রবাহকে। স্নিগ্ধ আর স্বচ্ছ জলের চেঙ্গি নদী পুরো খাগড়াছড়ির এমাথা থেকে শেষ পর্যন্ত ছুঁয়ে গেছে নিবিড়ভাবে। পাহাড়গুলো যতই দৃঢ়ভাবে সামনে এসে দাঁড়িয়েছে, নদী ততই তার নমনীয়তা আর তারল্যগুনে এগিয়ে গেছে, খুঁজে নিয়েছে নিজস্ব পথ।
বলা হয় শিক্ষা গ্রহণের জন্য প্রকৃতিই সর্বোত্তম স্থান। নিবিড় কুঞ্জবন আর পর্বতের মাঝ দিয়ে প্রবহমান
নদীটি কিন্তু আমাদের বিনয় আর অধ্যবসায়ের শিক্ষাই দেয়, শেখায়- জলের মত সারল্য আর একাগ্রতা দিয়েও মুখোমুখি হওয়া যায় পাহাড়ের মত ভীষণ প্রতিপক্ষের।
সর্বশেষ এডিট : ৩০ শে অক্টোবর, ২০১৪ সন্ধ্যা ৭:৩৬