সকালে ঘুম থেকে উঠে চোখ পড়েছে তিনটি ভাঁজ করা কাগজের উপর। একটি বালিশের পাশে অন্য দুটো প্রায় পায়ের পাশেই ছড়িয়ে। বালিশের পাশে রাখা কাগজটি খুলে দেখতেই বুঝতে বাকী রইলো না যে লিখাগুলো পরীর। জগতে সে আর কারো লিখা এত সহজেই বুঝতে পারে না। কথাটি ভাবতে ভাবতেই লক্ষ্য করেছে বাচ্চা ছেলের মত কাঁদছে সে। আশপাশ জনমানব শূন্য। সে একা। একাকী, মানুষকে আরো একাকী করে দেয়। চোখ মুছতে মুছতে মাথার কাছেই রাখা কাগজটি হাতে তোলে নিল। লিখাটা পড়তে চেষ্টা করছে। চোখ দুটো টকটকে লাল হয়ে আছে। জগতে লাল অনেক কিছুই সুন্দর। কাঁদতে কাঁদতে টকটকে লাল হয়ে যাওয়া চোখ কখনোই সুন্দর হয় না বরং পৃথিবীর সবচেয়ে জঘন্য বিশ্রী জিনিসের একটি হয়। পড়তে কষ্ট হচ্ছে। চেষ্টায় সব হয়- আনমনে কথাটি ভাবতে ভাবতেই পড়া শুরু করে দিয়েছে।
প্রিয় শাকিল,
প্রথমেই ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি। জানি আমি ক্ষমা পাওয়ার যোগ্য না। এরপরেও চাইছি। আগামী ২০১৯ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারী আমার বিয়ে ঠিক হয়েছে।
বাকী লিখাগুলো পড়তে পারছে না আর। দলবল নিয়ে চোখে নোনা পানি জমতে শুরু করেছে। ডান হাতে চোখ দুটো মুছে আবার পড়ার চেষ্টা করছে। উহু, আর পারছে না সে। মাথা ধরে এসেছে।
- শাকিল ঘুম থেকে উঠ এবার। অনেক বেলা হয়েছে। আর কত ঘুমাবি ?
কেউ যেন ডাকছে। শুনে হঠাৎ রক্ত হীম হয়ে এল। খুব পরিচিত একটি ডাক। যুগ যুগ ধরে এ আওয়াজ শুনে আসছে। এরপরেও ঠিক বুঝে উঠতে পারছে না আওয়াজটি কার। রুবী খালার ? না। শাহীন খালার হবে হয়তো।
- কই ? আসবি না ? নাস্তা হাতে আর কতক্ষণ দাড় করিয়ে রাখবি বাবা ?
কান একটু উঁচু করে শুনতে গিয়ে বুঝতে বাকী রইল না; মা ডাকছে।
- আসছি মা।
: আজ আর আসিস না। কাল আসিস একেবারে।
কাগজ তিনটি তুষকের নিচে লুকিয়ে রেখে উঠতে গিয়ে লক্ষ্য করলো ফুঁফিয়ে ফুঁফিয়ে সে কাঁদছে। জোর পূর্বক মাথা ব্যাথাও তার নিষ্ঠুরতা দেখাতে শুরু করেছে। সে বসতে গিয়েও বসতে পারছে না। চুলগুলো ছিড়ে ফেলতে লেগে পড়েছে। অসহ্য যন্ত্রনা সহ্য করা সবার পক্ষে সম্ভব নয়। আজ-ই হয়তো তার শেষ দিন। ইচ্ছে করলেও ২৭ আগষ্ট (পরীর জন্মদিন) পর্যন্ত সে বেঁচে থাকতে পারবে না।
পরীর লিখা অন্য চিঠি দুটো পড়া হল না, মায়ের সাথে রাগ দেখিয়ে- ভাত খাব নাও বলা হবে না, ছোট বোন স্কুল থেকে ফিরতেই কোলে তোলে মুখে চুমু খেতে খেতে মাথার চুল শুকে দেখতে পারবে না, প্রছন্ড ইচ্ছে থাকা স্বত্তেও বাবাকে কখনোই আর হয়তো দেখতে পাবে না- আনমনে কথাগুলো ভাবতে ভাবতেই মাথা ভারী হয়ে এসেছে। ভয়ংকর কষ্ট ঘিরে রেখেছে। আবার শুয়ে পড়েছে। বর্ষা না, এরপরেও তার চোখে বর্ষা নেমেছে।
___ঘুম ভেঙ্গেছে। চোখের জলে বালিশ ভিজে আছে। চোখ মুছতে গিয়ে লক্ষ্য করলো চোখে দুটো ফোঁড়ার মত ব্যাথা হয়ে আছে। চোখ খুলতেও ভারী কষ্ট হচ্ছে। তুষকের নিচে হাত দিয়েও পরীর লিখা কাগছ তিনটি পাওয়া গেল না। খুব যত্নে রেখেছিল কাগজ তিনটি। এবার অনিচ্ছা স্বত্তেও উঠে বসেছে। ভ্রু কুঁচকে সব কিছু উল্টিয়ে পাল্টিয়ে অনেক খোঁজার পরেও কাগজ তিনটি আর পাওয়া গেল না।
শাকিল এবার কেঁদে কেঁদে ঠোঁট একটু বাকিয়ে হাসছে। রাতে ঘুমের বড়ি খেয়ে ঘুমিয়েছে বলে সে উল্টা পাল্টা ভয়ংকর স্বপ্নে দেখেছে পরীকে নিয়ে।
জানালা দিয়ে সূর্যের ঝলঝলে আলো ঢুকছে। মৃদু হাওয়াতে পর্দা নড়ছে। মাঝে মাঝে মন ছুঁয়ে যাওয়া হাওয়াও তার শরীর ছুঁইয়ে দিচ্ছে। চারপাশ নিস্তব্ধ। সে একা। আশে পাশেও কেউ নেই। শাকিল ঠোঁট বাকিয়ে এখনো হাসছে। এমন কান্না জড়ানো ঠোঁট বাকিয়ে হাসি বোঝার ক্ষমতা পৃথিবীর কারো নেই। পরীদেরও না। স্বর্গীয় ভালবাসার ভাবনা এবার তাকে একটু ছুঁয়ে গেল। পৃথিবীর সব ভালবাসা শরীরের নয়, কিছু ভালবাসা হৃদয়ের- সে বুঝতে পেরেছে।
এই ভালবাসা পরীদের বুঝার ক্ষমতা নেয়।
ভাল থাকুক ভালবাসা
সর্বশেষ এডিট : ২৮ শে এপ্রিল, ২০১৬ দুপুর ২:৪০