আজ গিয়েছিলাম ব্র্যাক ব্যাংক-সমকাল সাহিত্য পুরস্কার ২০১৫ সালের পুরস্কার বিতরনী অনুষ্ঠানে। অনুষ্ঠানটি হয়েছে শেরে বাংলা নগরের চিন-বাংলাদেশ মৈত্রী সম্মেলন কক্ষে। অনুষ্ঠানে অনেক কবি-সাহিত্যিক-লেখক-শিল্পী বন্ধুদের সঙ্গে দেখা হয়েছে, আড্ডা হয়েছে। এটাই বোনাস! ব্র্যাক ব্যাংক-সমকাল সাহিত্য পুরস্কারের তিনটি ক্যাটাগরি। একটি হলো কবিতা ও কথাসাহিত্য শাখা। এই শাখায় ২০১৫ সালের পুরস্কার পেলেন কবি নির্মলেন্দু গুণ। কবিতার বই 'রক্ষা করো হে ভৈরব'। একটি হলো প্রবন্ধ, আত্মজীবনী, ভ্রমণ ও অনুবাদ শাখা। এই শাখায় ২০১৫ সালের পুরস্কার পেলেন লেখক রাজকুমার সিংহ। বইয়ের নাম ' মৈত্রেয়ী নেই মৈত্রেয়ী আছে'। আর তৃতীয় শাখাটি হলো অনূর্ধ্ব ৪০ বয়সি তরুণ লেখকদের জন্য হূমায়ূন আহমেদ তরুণ সাহিত্যিক পুরস্কার। এই শাখায় ২০১৫ সালের পুরস্কার পেলেন কথাসাহিত্যিক স্বকৃত নোমান। বইয়ের নাম 'কালকেউটের সুখ'। 'রক্ষা করো হে ভৈরব' বিভাস, 'মৈত্রেয়ী নেই, মৈত্রেয়ী আছে' পলক এবং 'কালকেউটের সুখ' জাগৃতি প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত হয়েছে। তিন পুরস্কারপ্রাপ্ত কবি ও লেখককে অভিনন্দন ও শুভেচ্ছা।
অনুষ্ঠান শুরু হবার কথা ছিল বিকাল পাঁচটায়। আমন্ত্রিত অতিথিরা সবাই পাঁচটার মধ্যে মূল ভেন্যুতে হাজির। কিন্তু আয়োজকরা অনুষ্ঠান শুরু করছেন না। খোঁজ নিয়ে জানা গেল অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি মাননীয় অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত আসতে দেরি করছেন, তাই এই অনাকাঙ্খিত বিলম্ব! তো কী আর করা। কবি-সাহিত্যিকরা ছোট ছোট গ্রুপে এখানে সেখানে আড্ডা মারা শুরু করলেন। স্বকৃত নোমানকে জিজ্ঞেস করলাম, চেক কখন ভাঙানো যাবে? নোমান বলল, রবিবার ছাড়া তো ব্যাংক খোলা নাই!
কবি ফরিদ কবির শোনালেন কীভাবে ৩২ বছর পর তার বাবা ও হারিয়ে যাওয়া ফুফু'র একটি অনুষ্ঠানে গিয়ে পুনরায় দেখা হয়েছিল, সেই গল্প। ১৯৪০ সালে হারিয়ে যাবার পর ১৯৭২ সালে পুনরায় দুই ভাইবোনের সেই মিলনের গল্পটি সত্যিই এক জীবনের অনেক গল্পের চেয়েও আকর্ষনীয়। লেখক-নির্মাতা শাকুর মজিদ একটি বিশাল বাহিনী নিয়ে আড্ডা দিচ্ছিলেন। সঙ্গে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী'র পিএস কবি মাহবুবুল হক শাকিল। শাকিল ভাইকে পরিচয় দিতেই তিনি বললেন, আমাকে চেনেন। শাকিল ভাইয়ের দেওয়া সিগারেট ফুঁকলাম। ফরিদ ভাই বললেন, আজকে তার গুলশান ইন্টারন্যাশন্যাল ক্লাবে আরো একটি অনুষ্ঠান আছে। ভাবী নাকি এই অনুষ্ঠানে ৭টা পর্যন্ত থাকার পারমিশান দিছেন। এরপর অনুষ্ঠান শুরু হোক বা না হোক ফরিদ ভাই ভাগবেন! ভাগলেনও!
ফাইনালি আমাদের আড্ডার এক ফাঁকে জানা গেল মাননীয় অর্থমন্ত্রী মহোদয় এসেছেন। অনুষ্ঠান এবার শুরু হবে। কিন্তু আয়োজকদের অনুষ্ঠান বিষয়ক ন্যূনতম কমোন সেন্সের ঘাটতির কারণে আগত অনেকেই পুরো অনুষ্ঠান না দেখে যার যার অন্যান্য সিডিউল কাজের কারণে চলে যেতে বাধ্য হয়েছেন। অনুষ্ঠানে পুরস্কারপ্রাপ্ত কবি ও লেখকদের উপর কিছু ভিডিওচিত্র প্রদর্শন করা হয়। লেখক রাজকুমার সিংহের উপর নির্মিত ভিডিও চিত্রটি মাত্র ৫৬ মিনিট প্রদর্শন করেছেন আয়োজকরা। ততক্ষণে অনেকেই চলে গেছেন। আমি বিরক্ত হয়ে সিগারেট ফুঁকতে বাইরে এসে আবার শাকুর ভাইকে পেলাম। শাকুর ভাইও আমার মত বিরক্ত হয়ে বাইরে গিয়ে বসে ছিলেন। পরে আমাদের চা-সিগারেট খাইয়ে শাকুর ভাইও বাসায় চলে গেলেন।
এর আগে অনুষ্ঠান শুরু করতে দেরি করায় বন্ধু কবি আলফ্রেড খোকন আমাদের সঙ্গে কিছুক্ষণ আড্ডা মেরে জরুরি কাজে চলে গেছে। অনুষ্ঠানের ফাঁকে বিরক্ত হয়ে ও জরুরি কাজ থাকায় চলে গেছেন কথাসাহিত্যিক জাকির তালুকদার। আয়োজকরা দীর্ঘ ভিডিওচিত্র প্রদর্শনের পর দর্শকদের বিরক্তি না বুঝে উল্টো জানান দিলেন যে, রাজকুমার সিংহ জীবনের অভিজ্ঞতায় যা বলছিলেন, আমরা তার কোনো অংশই বাদ দিতে পারিনি। যে কথাগুলো এক মিনিটের ভিডিও ফুটেজে বলা সম্ভব, তাই বলার জন্য আয়োজকদের মাত্র ৫৬ মিনিট লেগেছে। তারপর আবার দাবি করছে এর কোনো অংশই বাদ দেওয়ার মত ছিল না! আহা তথাস্তু!
পুরস্কার বিতরনী অনুষ্ঠানের দৈর্ঘ্য কতটুকু হওয়া প্রয়োজন, এই বিষয়ে বাংলাদেশের আয়োজক ও পুরস্কার প্রদান কর্তৃপক্ষের শুভবুদ্ধির উদয় যতদিন না হবে, ততদিন এ ধরনের লোকদেখানো অনুষ্ঠান করার কোনো মানে নেই। পুরস্কার বিতরনী অনুষ্ঠান শেষে আমন্ত্রিত অতিথিদের জন্য ডিনারের সুব্যবস্থা ছিল বটে। পুরস্কার বিতরন অনুষ্ঠান আয়োজনের যে খরচ এরা করলেন, তার যদি সিকি অংশও পুরস্কারপ্রাপ্ত কবি লেখকদের ভাগ্যে জুটতো, তাহলে এনিয়ে কোনো কথা বলতাম না। পুরস্কারের মান মাত্র এক লাখ টাকা। আর পুরস্কার বিতরনে খরচ সম্ভবত কোটি টাকার কাছাকাছি বা উপরে। চিন-বাংলাদেশ মৈত্রী হলের ভাড়া, ডিনার খরচ, অনুষ্ঠানের ভিডিও সাপোর্ট খরচ ইত্যাদি মিলে এটি একটি লোকদেখানো পুরস্কার। সম্ভবত বাংলাদেশে সাহিত্য পুরস্কারের নামে আয়োজকরা এভাবে কালো টাকা সাদা করার একটি কৌশল আবিস্কার করেছেন! নইলে পুরস্কারের অর্থমান এত কম হয় কী করে? এক লাখ টাকা তো পুরস্কারপ্রাপ্ত লেখকের তার বন্ধুদের জন্য সৌজন্য খাবারের পয়সাও হয় না। অথচ অনুষ্ঠানের আড়ম্বরের পেছনে আয়োজকদের যে খরচের বহর তা দেখে টাসকি খাবার যোগাড়!
অনুষ্ঠান শেষে ডিনার পর্যায়ে খাবার পরিবেশন করা হলো। কাঁটা চামচ দিয়ে সেই খাবার খাওয়ার নিয়ম। আমরা যারা চাষার পুত, আমরা যে কষ্ট করে মাংস ও কাঁটাযুক্ত মাছ কাঁটাচামচ দিয়ে খেলাম, সেজন্যই তো সবার পুরস্কার পাওয়া উচিত! কথাসাহিত্যিক পারভেজ হোসেনের গলায় রুই মাছের কাঁটা আটকে গেছে। এখন এই কাঁটা অপসারণ হবে কীভাবে? তবে অনুষ্ঠানে পুরস্কারপ্রাপ্ত লেখক স্বকৃত নোমান হাতেই সেই খাবার খেয়েছেন এমনটি দাবি করেছেন। গুড বয়। অনুষ্ঠানে সবাই বললেন বঙ্গীয় সাহিত্যের আরো উন্নতি করার জন্য যা যা প্রয়োজন, ভবিষ্যতে ওনারা সেই সব করবেন। কবি-লেখকদের জন্য আরো বড় আয়োজন করবেন। সমকাল প্রকাশক ও এফবিসিসিআই-এর সাবেক সভাপতি একে আজাদ অনেক প্রতিশ্রুতি দিলেন। খুব ভালো লাগলো শুনে। কিন্তু বঙ্গীয় কথাবার্তা বলার পর সেই অনুষ্ঠানে যখন কাঁটা চামচের পাশ্চাত্য ব্যবহারের নিদর্শন পাওয়া গেল, তখন স্পষ্ট হলো, এটা আসলে বঙ্গীয় কবি-সাহিত্যিকদের পুরস্কৃত করার আয়োজন নয়, বরং পাশ্চাত্য ভাবধারায় আড়ম্বরপূর্ণ কিছু একটা করে দেখানোর অভিপ্রায় এই আয়োজনের উদ্দেশ্যের ভেতরে লুকায়িত! হয়তো কালো টাকা সাদা করার এটি একটি সহজ মাধ্যম! মাননীয় অর্থমন্ত্রী নতুন অর্থবছরের বাজেটে এই বিষয়টির একটি ওপেন সুযোগ দিয়ে দেখতে পারেন, রাজস্ব আয় বাড়ানোর এটিও একটি মস্তবড় সুযোগ হতে পারে বটে!
অনুষ্ঠানের আয়োজনের আড়ম্বরের মধ্যে সবচেয়ে ছোট ছিল পুরস্কারের মান। মাত্র এক লাখ টাকা। অথচ এই পুরস্কারের মান যদি আরো বড় হতো, তাহলে এই পুরস্কার পেয়ে একজন কবি বা লেখকের জীবনের অনেক কষ্টকে হজম করার একটা উপায় হতে পারতো। বাংলাদেশে বছর বছর অনেক সাহিত্য পুরস্কারের জন্ম হচ্ছে। এসব পুরস্কার সেরা কবি-লেখকদের দেওয়া হয়, না বলে বলা উচিত কাউকে কাউকে দেওয়া হয়। সেই কেউ কেউকে আবার অনেক ঘাটে নাকখপতা দিয়ে, অনেকের পেছনে অনুনয় বিনয় করে, লাইনঘাট ঠিকঠাক করে, অবশেষে সেই পুরস্কার জোটে। আমি চ্যালেঞ্জ দিয়ে বলতে পারি, বাংলাদেশের সাহিত্যে যে সকল পুরস্কার দেওয়া হয়, সেই সকল পুরস্কার প্রাপ্ত কবি-লেখকদের আলোচ্য বইটি ওই পুরস্কারের জুরি বোর্ডের সদস্যরা পুরোটা পড়েন না। আয়োজকরা একটা শর্ট লিস্ট করে দেন। সেই লিস্ট থেকে আয়োজকদের পছন্দের কবি-লেখককে সেই পুরস্কারটি দেওয়া হয়। আর সেজন্য পুরস্কারপ্রাপ্ত কবি-লেখককে অনেক ঘাটের জল খাওয়ানো হয়। আয়োজকদের অপছন্দের কোনো কবি-লেখক লেখার কারণে কোনো পুরস্কার পেয়েছেন ইতিহাসে সেই খবর বিরল!
পুরস্কার বিতরনী অনুষ্ঠানের চেহারা দেখেই এই বিষয়টি আরো সুস্পষ্ট হয়। জুরি বোর্ডের বিচারক হিসাবে দেশের যে সকল স্বনামধন্য কবি-লেখকদের নাম শুনি, ওনারাও বুকে হাত দিয়ে বলতে পারবেন না যে, অমুক পুরস্কারপ্রাপ্ত কবি-লেখকদের পুরস্কার পাওয়া অমুক বইটি তিনি পাঠ করেছেন! তবুও বছর বছর পুরস্কার দেওয়া হয়। আমাদের কবি-সাহিত্যিক বন্ধুরা কেউ কেউ সেই পুরস্কার পান। বন্ধুদের পুরস্কার প্রাপ্তিতে আমরা খুশি হই। আহা মাভৈ মাভৈ!
অনুষ্ঠান থেকে আগে আগে একা বেড়িয়ে ছিনতাইকারীর কবলে পড়লেন নির্মাতা পান্থ প্রসাদ। পান্থ'র মোবাইলটি ছিনতাইকারীরা নিয়ে নিয়েছে। অনুষ্ঠানে গিয়ে যেটুকু লাভ হয়েছে তা হলো কবি-লেখক বন্ধুদের সঙ্গে অনেকদিন পর এক জমজমাট আড্ডা। অনুষ্ঠানে এসেছিলেন কবি আল মাহমুদ, কবি নির্মলেন্দু গুণ, কবি আসাদ চৌধুরী, কবি অসীম সাহা, কবি কামাল চৌধুরী, কথাসাহিত্যিক হরিশংকর জলদাশ, কথাসাহিত্যিক বুলবুল চৌধুরী, কবি হেলাল হাফিজ, কথাসাহিত্যিক ইমদাদুল হক মিলন, কবি নাসির আহমেদ, লেখক নির্মাতা শাকুর মজিদ, প্রকাশক মাজহারুল ইসলাম, কবি ফরিদ কবির, কবি তুষার দাশ, কথাসাহিত্যিক জাকির তালুকদার, লেখক মোহিত কামাল, কথাসাহিত্যিক ইমতিয়ার শামিম, কবি মাহবুবুল হক শাকিল,কবি আহমেদ স্বপন মাহমুদ, কথাসাহিত্যিক আহমাদ মোস্তফা কামাল, কবি আলফ্রেড খোকন, গল্পকার ও সাংবাদিক রাজীব নূর, প্রবন্ধকার অনু হোসেন, কবি ওবায়েদ আকাশ, কবি ও নির্মাতা মাসুদ পথিক, কথাসাহিত্যিক স্বকৃত নোমান, কবি শাখাওয়াত টিপু, কবি শামীম রেজা, কথাসাহিত্যিক পারভেজ হোসেন, কবি আলতাফ শাহনেওয়াজ, লেখক কুমার চক্রবর্তী, লেখক মণিকা চক্রবর্তী, গল্পকার জেসমীন মুননী, কবি আফরোজা সোমা, লেখক সালেক খোকন, লেখক ফেরদৌস হাসান, অভিনেতা জয়ন্ত চট্টোপাধ্যায়, আবৃত্তিকার ভাস্বর বন্দ্যোপাধ্যায়, কবি বদরুল হায়দার, বিজ্ঞানলেখক ফারসিম মান্নান মোহাম্মেদী, কবি তুষার কবির, লেখক-সাংবাদিক রাজীব নূর খান, সাংবাদিক ফাতেমা আবেদীন নাজলা প্রমুখ।
........................................
২৮ মে ২০১৬
সর্বশেষ এডিট : ২৮ শে মে, ২০১৬ রাত ২:৪০