দুর্গাপূজা আমাদের হিন্দু সম্প্রদায়ের প্রধান ধর্মীয় উৎসব। সাধারণত প্রতিবছর বাংলাদেশের দ্বিতীয় সংখ্যাগরিষ্ঠ সম্প্রদায়ের প্রধান এই ধর্মীয় ও সামাজিক উৎসব বাংলাদেশের জাতীয় জীবনে এক অসাম্প্রদায়িক মিলনমেলায় পরিনত হয়। বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম সম্প্রদায়ের প্রধান ধর্মীয় উৎসবে বিশেষ করে ঈদুল ফিতর যেমন হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান ও অন্যান্য ধর্মের মানুষের এক অসাম্প্রদায়িক উৎসবে পরিনত হয়, তেমনি দুর্গাপূজাও বাঙালি সংস্কৃতির এক যৌথ মিলনমেলা হিসেবেই পরিচিত। ছোটবেলা থেকেই দুর্গাপূজার সময় বন্ধুদের সঙ্গে নানান কিসিমের আনন্দ করায় আমার ছিল প্রচুর আগ্রহ। আমাদের নাজিরপুর থানায় তখন সবচেয়ে বড় দুর্গাপূজার আয়োজনটি হতো ঘোষকাঠী স্কুল প্রাঙ্গনে। আমরা তখন ক্লাস সেভেনে পড়ি। সে বছর বন্ধুরা মিলে ঠিক করলাম অন্তত তিন দিন আমরা বড় বড় দুর্গাপূজার স্থানগুলো ঘুরব আর পূজা ও উৎসবে শরিক হব।
দীঘিরজান হাইস্কুলের সাথেই বড় ফুটবল খেলার মাঠ। মাঠের পাশেই মরা বলেশ্বর। হেডস্যারের ভাগ্নে নিহার আমাদের সঙ্গে পড়ত। দুষ্টামিতে আমাদের মত সেরাদের সারির অন্যতম সদস্য নিহার। তো নিহার, খোকন, গৌতম, প্রানেশ, সুবোধ, সুনীল, জীবন, তাপস, সুধর, স্বপন, রমেন, জীবেস স্যারের ছেলে খোকন, হেডস্যারের ছোট ছেলে জয়প্রকাশ, প্রকাশ আর আমি মিলে এক বিশাল নৌকায় দীঘিরজান বাজার থেকে বেশ সকালেই আমরা দুর্গাপূজা দেখতে বেড়িয়ে পড়ি।
জীবেস স্যারের ছেলে খোকন আর হেডস্যারের ছেলে জয়প্রকাশ ছাড়া আমরা তেরো জন সবাই ক্লাস সেভেনের। অন্য একটি নৌকায় জীবেস স্যারের নেতৃত্বে স্যার, স্যারের স্ত্রী (আমরা ডাকতাম কাকীমা), স্যারের মেয়ে তপু, আমাদের ক্লাসের কিছু মেয়ে আর আমাদের উপরের ক্লাসের কিছু মেয়েরা। খোকনের মা মানে জীবেস স্যারের স্ত্রী মানে আমাদের কাকীমার বাবার বাড়ি ঘোষকাঠীতে। সেই সূত্রে আমরা পূজা ও মেলা দেখার পাশাপাশি দুপুরে কাকীমার বাবার বাড়িতে খাব। সেভাবেই পরিকল্পনা করা।
নদীর সমান্তরাল যেখানে যেখানে রাস্তা আছে সেখানে আমরা দুষ্টুর দল কোনো এক পাড়ে নেমে নৌকার সাথে সাথে হাঁটি। আবার পথে সাঁকো ভাঙা থাকলে নৌকায় চড়ি। এভাবে ছোট ছোট দলে হাঁটা ও নৌকায় চড়ে আমরা এগারোটার দিকে ঘোষকাঠী পৌঁছাই। ওই সময়ে ঘোষকাঠী স্কুলে আমাদের বন্ধুদের কারো কারো দু'একজন পরিচিত ছিল। ঘোষকাঠী পৌঁছানোর পর তাদের সঙ্গে দেখা হয়। আমাদের বিচ্ছুদের একটি দল মূল দল থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাই। এই বিচ্ছিন্ন হবার পেছনে দুষ্টামি করার খায়েস যেমন ছিল, তেমনি ধরা না পরার গোয়েন্দা নজরদারিও ছিল।
আমরা ঘোষকাঠীর নতুন বন্ধুদের পেয়ে তাদের সঙ্গে মেলায় আলাদাভাবে ঘুরতে ঘুরতে এক পর্যায়ে স্কুলমাঠে ঠা ঠা রোদে ফুটবল খেলতে নেমে পড়ি। আমাদের সঙ্গে দুর্গাপূজা দেখতে আসা অন্যরা তখন গোটা মেলায় আমাদের খুঁজে খুঁজে হয়রান। জীবেস স্যার আমাদের উপর খুব ক্ষেঁপেছেন। বাঁদরের দল গেল কোথায়? অথচ সবার চোখের সামনেই আমরা তখন ফুটবল খেলছি। একসময় ওরা আমাদের ভরসা ছেড়ে দিয়ে সবাই কাকীমা'র বাবার বাড়িতে খানাপিনা করল। কাকীমা গোপনে সুবোধকে পাঠালো আমাদের আরেকবার খুঁজে দেখতে। ততক্ষণে আমাদের খেলায় তখন গোল নিয়ে কিছু একটা তর্ক-বিতর্ক বা হট্টগোল চলছিল। ওই জটলায় সুবোধ আবিস্কার করল, নিহারকে ঘিরেই জটলাটা। নিহার আমাদের সবার চেয়েই লম্বা ছিল। আর নিহার খেলায় গোলরক্ষকের দায়িত্ব পালন করছিল। অতএব গোল বিতর্কে নিহারের যোগ দেওয়াটাই স্বাভাবিক। ততক্ষণে আমরা বাকিরা আর না খেলার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। নিহারকে সবাই মাঠ থেকে উঠে আসতে অনুরোধ করছি। কিন্তু নিহার আসছে না, সে তর্ক করেই যাচ্ছে। সুবোধ গিয়ে নিহারকে উদ্ধার করল। আর তাড়া লাগাল যে ওদের খাওয়া-দাওয়া শেষ। কারণ, আমাদের খাওয়া-দাওয়া শেষ হলেই নৌকা আবার শ্রীরামকাঠীর উদ্দেশ্যে রওনা হবে।
আমরা ততক্ষণে হাত-পা ধুয়ে নেবার জন্য মাঠের এক কোনের টিউবওয়েলে লাইন দিয়েছি। কারো কারো হাত-পা ধুয়ে চলবে না। স্নান লাগবে। সুবোধ বলল, তোরা ওই বাড়িতে গিয়ে স্নান কর, স্যার খুব ক্ষেঁপে আছে। আগে তোরা স্যারের সাথে দেখা কর। নইলে স্যার আবার আমাকে বকবেন। কেউ কেউ কাকীমার বাবার বাড়িতে গিয়ে খাবার বদলে নৌকার কাছে গেল। পাছে স্যারের বকা খেতে হয় তা এড়ানোর কৌশল হিসেবে উপোষ থাকা বরং ভালো। কেউ কেউ সুবোধের প্ররোচণায় আমাদের সাথে খালে না গিয়ে কুমিরের সামনে গেল। কিন্তু নিহার কোথাও যেতে পারছে না। কারণ, নিহারের প্যান্ট-শার্ট খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। খেলতে নামার আগে আমরা সবাই ফুলপ্যান্ট-জামা খুলে রেখে হাফপ্যান্ট ও গেঞ্জি পড়ে খেলেছি। তো নিহারের খুব মেজাজ খারাপ।
আমরা খালের জলে ডুবিয়ে ভিজে হাফপ্যান্ট আর গেঞ্জি পলিথিনে রেখে প্যান্টশার্ট পড়ে ততক্ষণে আবার ফুলবাবুতে পরিনত হয়েছি। পলিথিন নৌকায় রাখা হল। তারপর নিহারের প্যান্টশার্ট খুঁজতে গিয়ে ছোকরাদের কেউ কেউ সাক্ষ্য দিল যে, ছাদে তারা কিছু প্যান্টশার্ট এলোমেলো পড়ে থাকতে দেখেছে। নিহারের প্যান্টশার্ট খুঁজতে দেরি হবার কারণে ততক্ষণে জীবেস স্যারের নির্দেশে নৌকা শ্রীরামকাঠীর উদ্দেশ্যে রওনা দিয়েছে। কিন্তু আমাদের নৌকা আমরা ঘাটে না যাওয়া পর্যন্ত ছাড়তে পারছে না। জীবন তখন ছিল নৌকায়। জীবন বলল, বান্দোরের দল ফুটবল খেলছে। এখন কিছুক্ষণ হাঁইটা তেল মরুক। নৌকা ছেড়ে দে। ঘটনাটা করল প্রায় আমাদের চোখের সামনে। আমাদের আসতে দেখেই জীবনের নেতৃত্বে নৌকা ছুটল। সুধর অবশ্য আমাদের নৌকায় তুলে নেবার পক্ষে ছিল। কিন্তু জীবনের দল ভারী হওয়ায় নৌকা নদীপথে চলছে। আর আমরা তীর দিয়ে হাঁটছি।
প্রাণেশ বলল, এটা নিহারের দোষ। তোর দেরির কারণে আমরা এখন নৌকায় উঠতে পারছি না। আবার খেলার কারণে দুপুরে খাবারও জোটেনি। তুই এখন আমাদের কিছু খাওয়াবি। জবাবে নিহার বলল, আমার কাছে যে কয়টাকা আছে সব খরচ করার জন্যই আনা। কি খাবি ক? কিন্তু আমার একটা দাবী আছে?
প্রকাশ বলল, কি দাবী? জবাবে নিহার বলল, আমরা যতক্ষণ হাঁটছি, জীবনরে তারচেয়ে বেশি পথ হাঁটানো লাগবে। তোরা রাজী থাকলে ক, কি খাবি? প্রকাশ আমারে আর প্রানেশকে চোখ মেরে বলল, ঠিকআছে। চল আগে কিছু খাই। আমরা সম্ভবত আটার-রুটি, গুড়, কুসই, মিষ্টান্ন আর সিগারেট খেয়েছিলাম নিহারের টাকায়।
ঘোষকাঠী থেকে শ্রীরামকাঠী হেঁটেও যাওয়া যায়। কিন্তু সেক্ষেত্রে অন্তত দুবার খেয়া পাড়াতে হবে। একবার যেতে হবে ঘোষকাঠী'র এপার থেকে দৈয়ারির ওপারে। কিছুদূর হাঁটার পর দৈয়ারি থেকে আবার খেয়া পাড়িয়ে শ্রীরামকাঠী নামতে হবে। আমাদের পুরোটা পথ হাঁটা লাগল না। দৈয়ারি খেয়াঘাটে পৌঁছে দেখি, আমাদের বিচ্ছুদের নৌকা আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে। তারপর আমরা নৌকায় না উঠে জীবনকে নৌকা থেকে নামালাম। আমাদের সঙ্গে তখন সুনীল, খোকন, তাপস আর সুধরও যোগ দিল। বাকিরা নৌকায় যাচ্ছে। আমরা হাঁটছি। ইতোমধ্যে জীবনকে সায়েস্থা করার মতলব নৌকা থেকে যারা নামল জীবন বাদে তারাও ইসারায় জেনে গেছে। কিছুদূর হাঁটার পর নিহার জীবনের শার্ট ধরে দিল টান। জীবনের শার্টের বোতাম সব ছিড়ে গেল। জীবন ঘটনা বুঝতে পেরে মারামারিতে যাচ্ছে না। কারণ বুঝে গেছে নিহারের দল ভারী। তাছাড়া জীবনই আমাদের এতোটা পথ হাঁটিয়েছে।
দৈয়ারির পরের খেয়াঘাটে মানে শ্রীরামকাঠীর খেয়াঘাটে পৌঁছে আমরা নৌকায় উঠব। তখন জীবনকে খেয়াঘাটে ফেলে আমরা সবাই নৌকায় উঠলাম। জীবনের প্রতি এক ধরনের মায়া হওয়ায় সুধর আর সুবোধ নৌকা থেকে নেমে গেল। কেউ কেউ বলল, তোরা এপারে দাঁড়া। খেয়ায় পাড়া নইলে আমরা ওপারে নেমে নৌকা আবার এপার পাঠাচ্ছি। কিন্তু আমরা সরাসরি ঘোষণা করলাম, না নৌকা আর ওপারে যাবে না। ওরা যেভাবে পারে আসুক।
আমরা শ্রীরামকাঠী নেমে আবার শ্রীরামকাঠী স্কুল মাঠের দুর্গাপূজা প্রাঙ্গনে যোগ দিলাম। কিন্তু ওদের দশা কি হল তা দেখার জন্য আমরা একটা ছোট দল আবার লঞ্চঘাটে আসলাম। না জীবনদের কোনো অস্তিত্ব নেই। সন্ধ্যার আগে আগে ওরা খেয়ানায় নদী পাড় হল। তখন দলের সবাই খুব খুশি, কিন্তু জীবনের মুখ খুব গম্ভীর। জীবন মনে মনে পাল্টা প্রতিশোধ নেবার পরিকল্পনা করেছে। যা আমরা বুঝতে পারলেও দলেভারী হওয়ায় একদম পাত্তা দিলাম না।
পরের ঘটনায় যাবার আগে একটু দুর্গাপূজার ঘটনাগুলো বলে নেওয়া ভালো। সাধারণত আশ্বিন ও চৈত্র মাসের শুক্লপক্ষে হয় দুর্গাপূজা। আশ্বিন মাসের দুর্গাপূজাকে বলা হয় সারদীয়া দুর্গাপূজা আর চৈত্রমাসের দুর্গাপূজাকে বলা হয় বাসন্তী দুর্গাপূজা। বাংলাদেশে সারদীয়া দুর্গাপূজাই বেশি প্রচলিত। আশ্বিন মাসের শুক্লাপক্ষের ষষ্ঠ থেকে দশম দিন পর্যন্ত সারদীয়া দুর্গাপূজা অনুষ্ঠিত হয়। এই পাঁচদিনে যথাক্রমে দুর্গাষষ্ঠী, মহাসপ্তমী, মহাষ্টমী, মহানবমী ও বিজয়দশমী পালিত হয়। হিন্দুশাস্ত্রে, আশ্বিন মাসের শুক্লপক্ষকে বলা হয় দেবীপক্ষ। দেবীপক্ষ শুরু হবার আগের সূচনার অমাবশ্যার রাতকে বলা হয় মহালয়া। এদিন হিন্দুরা তর্পণ করে পূর্বপুরুষদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। দেবীপক্ষের শেষ দিন রাতেই কোজাগরী পূর্ণিমা। এই পূর্ণিমা রাতেই হয় লক্ষীপূজা।
হিন্দুশাস্ত্রে দুর্গা নামের ব্যাখ্যাটি এমন- ‘দ’ অক্ষর দৈত্যনাশক, 'উ'-কার বিঘ্ননাশক, ‘রেফ’-কার রোগনাশক, ‘গ’ অক্ষর পাপনাশক এবং 'অ'-কার ভয়-শত্রুনাশক। মানে দৈত্য, বিঘ্ন, রোগ, পাপ ও ভয়-শত্রুর হাত থেকে যিনি রক্ষা করেন, তিনিই দুর্গা। “দুর্গং নাশয়তি যা নিত্যং সা দুর্গা বা প্রকীর্তিতা” – অর্থাৎ, দুর্গ নামক অসুরকে যিনি বধ করেন তিনিই নিত্য দুর্গা নামে অভিহিতা। দুর্গার বাহন হল সিংহ। মহিষাসুর অসুর, মানে দেবদ্রোহী। তাই দেবীপ্রতিমায় দেবীর পদতলে দলিত এই অসুর ‘সু’ এবং ‘কু’-এর মধ্যকার চিরকালীন দ্বন্দে অশুভ শক্তির উপর শুভশক্তির বিজয়ের প্রতীক হিসেবে বিবেচিত। গণেশ কার্যসিদ্ধির দেবতা। হিন্দু পুরাণের নিয়ম অনুসারে, অন্যান্য দেবতার আগে গণেশের পূজা করতে হয়। গণেশের পূজা আগে না করে অন্য কোনো দেবতার পূজা করা শাস্ত্রে নিষিদ্ধ। গণেশের বাহন হল মূষিক বা ইঁদুর। শ্রী, সমৃদ্ধি, বিকাশ ও অভ্যুদয়ের প্রতীক হল লক্ষী। লক্ষীর বাহল হল পেচক বা প্যাঁচা। বাণীরূপিণী বাগদেবী, জ্ঞানশক্তির প্রতীক হল সরস্বতী। সরস্বতীর বাহন হল হংস। দেবসেনাপতি কার্তিকেয় বা কার্তিক হল সৌন্দর্য ও শৌর্যবীর্যের প্রতীক। কার্তিকেয়ের বাহন হল ময়ূর।
সাধারণত দুর্গাষষ্ঠীতেই বিভিন্ন পূজার মাধ্যমে দুর্গাপূজা আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হয়। মহসপ্তমীর দিনে হয় মহাস্নান। মহাষ্টমীর দিন হয় কুমারী পূজা ও সন্ধিপূজা। সন্ধিপূজা হল মহাষ্টমীর ২৪ মিনিট এবং মহানবমীর ২৪ মিনিট। এই ৪৮ মিনিট ধরে হয় সন্ধিপূজা। মহানবমী পূজার পরদিন হয় বিজয়াদশমী। এদিন বিসর্জনের পরেই বিজয়া দশমী কৃত্য দিয়ে দুর্গাপূজা আনুষ্ঠানিকভাবে শেষ হয়।
অপরাজিতা পূজা দুর্গাপূজার আরেকটি অঙ্গ। দুর্গার অপর নাম হল অপরাজিতা। তবে অপরাজিতা দেবীর মূর্তি একটু অন্যরকম। ইনি চতুর্ভূজা। হাতে শঙ্খ, চক্র, বর ও অভয়মুদ্রা। গায়ের রং নীল, ত্রিনয়না এবং মাথায় চন্দ্রকলা। সাধারণত বিজয়াদশমীর দিন বিসর্জনের পর পূজামণ্ডপের ঈশানকোণে অষ্টদল পদ্ম এঁকে অপরাজিতার লতা রেখে এই দেবীর পূজা করা হয়। বৈষ্ণবী শক্তি বিষ্ণুমায়া লক্ষ্মী ও শিবশিক্তি শিবানীর মিশ্রণে কল্পিতা এই অপরাজিতা দেবী।
আমাদের পূজা দেখা শুরু হয়েছিল সম্ভবত মহাসপ্তমীর দিন। সন্ধ্যায় শ্রীরামকাঠীর স্কুল প্রাঙ্গনে পূজা যখন বেশ জমে উঠেছে, তখন সুধর-জীবনরা এসে হাজির হল। ততক্ষণে আমরা দিনের রাগারাগি ভুলে গেছি। প্রানেশ অভিমান ভাঙাতে জীবন আর সুধরকে মিষ্টান্ন এগিয়ে দিল। মিষ্টান্ন খেয়ে সুধরের নেতৃত্বে আমরা মাটির ভারে নারকেল ছোবরা আর ধূপ জ্বালিয়ে নৃত্যামোদে যোগ দিলাম। নাচের ফাঁকে ফাঁকে কেউ হাঁফিয়ে উঠলে মাটির ভার অন্য কারো হাতে তুলে দিয়ে একটু জিরিয়ে নেয়। মাটির ভারযোগে নৃত্যের চেয়ে আমার দখল বেশি ছিল ঢাক বাজানোতে। ছোটবেলা থেকেই ঢাক বাজাতে আমি ওস্তাদ। ব্যাপক নাচানাচি করে চরম ক্ষুধা লাগানোর পর আমরা কাঠের পুল পাড়িয়ে খোকনের পিসি বাড়িতে রাতের খাবার খেলাম।
শ্রীরামকাঠী গিয়ে আমাদের দল আরো ভারী হল। সেখানে আমাদের সঙ্গে যোগ দিল খোকনের দুই ভাই স্বপনদা আর বাবুল, দীনেশদা, ডাব্লিউদা, প্রানেশের ভাই প্রশান্তদা, আমাদের ক্লাসমেট বাবুলাল, সুধরের ভাই সুজিতদা এবং আমাদের মনোজ কাকা ও তার নববিবাহিতা স্ত্রী। মনোজ কাকার শ্বশুরবাড়ি শ্রীরামকাঠী। খোকন আর গৌতমের দুই পিসির বাড়িও শ্রীরামকাঠী। রাতের খাবারের পর সারা রাত আমরা শ্রীরামকাঠী পূজা দেখলাম। সকালে আমরা খোকন আর গৌতমের পিসিদের বাড়ি আর মনোজ কাকার শ্বশুরবাড়ি তিনভাগে ভাগ হয়ে ঘুমাতে গেলাম।
সেই ফাঁকে জীবন মনোজ কাকার কাছে আমাদের বিরুদ্ধে নালিশ দিল এবং বিচার চাইল। নইলে সে মহাষ্টমী ও মহানবমীর পূজায় আমাদের সঙ্গে ঘুরবে না বলে ঘোষণা দিল।
দুপুরে আমরা ঘুম থেকে উঠে স্নান করে খাবারের জন্য প্রস্তুত। ওই সময় মনোজ কাকা আমাকে আর প্রকাশকে ডাকতে আসলেন। আমরা খোকনের পিসির বাড়িতে ঘুমিয়েছিলাম। জীবনের নালিশ নিয়ে বিচার না হওয়া পর্যন্ত জীবন আমাদের সাথে আর কোনো অনুষ্ঠানে যাবে না। মনোজ কাকার সঙ্গে আমরা তার শ্বশুরবাড়িতে গিয়ে দুপুরে সেখানেই খেলাম। জীবন মনোজ কাকাকে নালিশ করার সময় আমাদের নাম আসামীর তালিকা থেকে কৌশলে বাদ দিয়ে শুধু নিহারকেই প্রধান আসামী করল। মনোজ কাকা ঘোষণা দিলেন, যদি নিহার আর জীবনের ঘটনা সত্য হয়, তাহলে সন্ধ্যার আগেই তা মিটিয়ে ফেলা তার দায়িত্ব। এই নিয়ে গোটা বিকেল স্বপনদা, দীনেশদা, প্রশান্তদা, ডাব্লিউদা আর মনোজ কাকা নানান উপায় নিয়ে অনুসন্ধান চালালেন। শেষ পর্যন্ত একটা বিচার হল বটে কিন্তু বিচারে জীবন বা নিহার কেউ মোটেও খুশি নয়।
সন্ধ্যায় আমরা নৌকায় আবার শাঁখারীকাঠী পূজা দেখার জন্য রওনা হলাম। এবার আমাদের দল থেকে হেডস্যারের ছেলে জয়প্রকাশ ও জীবেস স্যারের ছেলে খোকন শ্রীরামকাঠী থেকে গেল। জয়প্রকাশেরও পিসির বাড়ি শ্রীরামকাঠী। আমাদের সঙ্গে নতুন যোগ দিল বাবুলাল, দীনেশদা আর ডাব্লিউদা। এক বন্ধু আর দুই সিনিয়র বড়ভাই যোগ দেওয়ায় জীবন আর নিহারের দ্বন্দ্বটা কিছুটা পিছিয়ে গেল।
তখন রাত প্রায় দশটা। আমাদের নৌকা খাল দিয়ে যাচ্ছিল। আমরা কয়েকজন খালের পাশের রাস্তা ধরে হাঁটছিলাম। সাতকাছিমা পর্যন্ত আমরা হাঁটলাম। মাঝখানে জীবন আবার নৌকায় উঠেছে। সাতকাছিমা খেয়াঘাটে পৌঁছে আমাদের সবারই নৌকায় ওঠার পালা। এবার জীবন নৌকায় নিহারকে তুলতে রাজী নয়। প্রয়োজনে এবার মারামারি করবে এমন প্রস্তুতি জীবনের। ইতোমধ্যে জীবনের দলেও কয়েকজন ভিড়েছে। এই নিয়ে মহাক্যাচাল। রাত সাড়ে এগারোটা পর্যন্ত সাতকাছিমা খেয়াঘাটে জীবন আর নিহারের তর্ক-বিতর্ক সামলাতে ডাব্লিউদা আর দীনেশদা মহা ব্যস্ত। তারপর সিদ্ধান্ত হল, যদি আমাদের গণ্ডগোল শেষ না হয় তাহলে আমরা শাঁখারীকাঠী পূজা না দেখি সরাসরি দীঘিরজান যাব।
ততক্ষণে আমরা নৌকায় উঠেছি। একটু একটু করে সবার রাগ-অভিমান কমতে শুরু করল। শাঁখারীকাঠী স্কুলের ঘাটে পৌঁছে সবাই মতামত জানাল পূজা দেখার পক্ষে। নিহারের নেতৃত্বে একদল দীঘিরজান ফিরে যাবার পক্ষে। শেষ পর্যন্ত নিহার, গৌতম, তাপস, বাবুলাল আর দীনেশদা নৌকায় থেকে গেল। আমরা বাকীরা শাঁখারীকাঠী স্কুলের সামনে নেমে গেলাম।
শাঁখারীকাঠী স্কুলের পাশেই প্রকাশের আত্মীয় বিভাসদের বাড়িতে আমরা রাতের খাবার খেলাম। শাঁখারীকাঠী স্কুলে সারারাত পূজা দেখলাম। সকালে আমরা বিভাসদের বাড়িতে খেয়ে কাঠালিয়া খেয়াঘাট পার হয়ে বাইনকাঠী দিয়ে রওনা হলাম। বাইনকাঠীতে স্বপনদের বাড়ির কাছে বড়মণ্ডপে মহানবমী দেখলাম। ওই রাতের শেষের দিকে আমরা বাইনকাঠী থেকে পদব্রজে বাড়ির দিকে রওনা হলাম। দুর্গাপূজার মহাসপ্তমী থেকে মহানবমী পর্যন্ত এভাবে আমরা দ্বিধা-দ্বন্দ্ব, রাগ-অভিমান, দুষ্টামি-কৌশল, পক্ষ-প্রতিপক্ষ হাজারো ঘটনা-অঘটন, রটনা ঘটিয়ে আমাদের দুর্গাপূজা উৎসব শেষ করলাম।
দুর্গাপূজার ছুটির পর যখন স্কুল খুলল, তখন জীবন আর নিহার আবার প্রকাশ্যে মারামারি করার ঘোষণা দিল। তখন অনুপ আর নির্জন সেই ঘটনায় নিহারকে উসকে দিল। আর ছোট গৌতম আর পরিমল জীবনকে উসকে দিল। আমরা সবাই নিহার আর জীবনের মধ্যে কখন সেই কাঙ্খিত মারামারি হয়, সেই আশায় দিনাতিপাত করতে লাগলাম।
২৬ সেপ্টেম্বর ২০১৪
ঢাকা
সর্বশেষ এডিট : ২৬ শে সেপ্টেম্বর, ২০১৪ ভোর ৬:২৬