সবাইকে ইংরেজি নতুন বর্ষ ২০১৪ সালের শুভেচ্ছা। মজার ব্যাপার হল ২০১৪ সালের ২০ আর ১৪ কে জায়গা বদল করলে হয় ১৪২০। এখন বাংলা বছরে চলছে ১৪২০ সাল। ২০১৪ বা ১৪২০ এই দুইটি সালের গানিতিক যোগফল ২+০+১+৫ (অথবা ১+৪+২+০) = ৭। নতুন বছরে এই লাকি সেভেন যেনো সবার জীবনে বিশেষ করে বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের শান্তি ও নিরাপত্তা ফিরিয়ে দেয়, সেই কামনা করছি। নতুন বছরে অন্য সবার মত আমারও কিছু প্রত্যাশা রয়েছে। সেই ন্যূনতম প্রত্যাশাগুলো যাতে পূরণ হয়, সেই কামনাও করছি। চলুন সেই প্রত্যাশাগুলো একটি সংক্ষেপে আলোচনা করি।
১. দেশের আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতি যাতে শান্তিপূর্ণ হয় সেই প্রত্যাশা থাকবে সবার আগে। সাধারণ মানুষ নিজ নিজ কর্মক্ষেত্রে নির্বিঘ্নে যেতে পারবে, নিজের কাজ করতে পারবে, নিরাপদে আবার বাসায় ফিরে আসতে পারবে, এটাই প্রথম চাওয়া। রাজনৈতিক কর্মসূচির নামে বা ভোটের নামে বা নির্বাচনকালীণ সহিংসতার নামে বা যুদ্ধাপরাধের বিচারের নামে আমরা কোনো আর নাশকতা দেখতে চাই না। দেশের সকল মানুষ নিরাপদে শান্তিতে বসবাস করুক এটাই প্রথম প্রত্যাশা।
২. রাজনৈতিক দলগুলোর নেতানেত্রীদের মধ্যে শুভ বুদ্ধির উদয় হোক। দেশের সাধারণ মানুষকে জিম্মি করে চলমান রাজনৈতিক কর্মসূচি কোনো মতেই সাধারণ মানুষের কাছে গ্রহনযোগ্য নয়। যদি আমাদের রাজনৈতিক দলগুলোর নেতানেত্রীদের শুভ বুদ্ধির উদয় না হয়, তাহলে সাধারণ মানুষকে জিম্মি করে দুষ্টু রাজনৈতিক বলয় থেকে সাধারণ মানুষ এমনিতেই বেড়িয়ে আসবে। সাধারণ মানুষ দেশের চলমান অসুস্থ রাজনীতি প্রত্যাখ্যান করেছে। রাজনৈতিক দলগুলো সাধারণ মানুষের সেই হার্টবিট যদি বুঝতে না পারে, তাহলে ভবিষ্যতে বাংলাদেশে রাজনীতি একটি অসুস্থ সংস্কৃতি হিসেবে স্বীকৃতি পাবে। সাধারণ মানুষের কল্যানের কথা বলে রাজনৈতিক সহিংসতা কোনো ভাবেই মেনে নেওয়া যায় না।
৩. আগামী ৫ জানুয়ারির নির্বাচন নৈতিকভাবেই গ্রহনযোগ্যতা হারিয়েছে। দেশের সাধারণ ভোটারদের ভোটদানের সুযোগকে বঞ্চিত করে ১৫৪ টি আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বীতায় নির্বাচিত সাংসদের নিয়ে যে সরকার আগামী ২৭শে জানুয়ারি গঠিত হবে, সেই সরকার হবে নৈতিকভাবে দুর্বল একটি সরকার। সেই সরকার জনগণের আস্থা নিয়ে দেশ পরিচালনার ক্ষেত্রে আস্থাসংকটে ভুগবে। তাই যতো দ্রুত সম্ভব একাদশ সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা করা, যেখানে সকল রাজনৈতিক দলের অংশগ্রহনে একটি শান্তিপূর্ণ অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন হয় তার ব্যবস্থা করা। সেটি করতে নির্চাচন কমিশন শক্তিশালী করা সহ প্রশাসনকে একটি গ্রহনযোগ্য লেবেলপ্লেয়িং করে সবার কাছে গ্রহনযোগ্য একটি সরকারের অধীনে সেই নির্বাচনের ব্যবস্থা করা। নতুবা নৈতিক আস্থাহীনতার কারণে নতুন সরকার যেমন মানসিক দুর্বলতা কাটিয়ে উঠতে পারবে না, তেমনি সেই দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে বিরোধী রজনৈতিক শক্তি দেশে আরো নাশকতা করা সহ রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি করতে পারে। তাই দেশের সকল রাজনৈতিক দলগুলো শান্তিপূর্ণ আলোচনার মাধ্যমে একটি গ্রহনযোগ্য নির্বাচনের উপায় বের করা। যাতে দেশ বাঁচে, দেশের জনগণ বাঁচে। বাঁচে গণতন্ত্র।
৪. নতুন সরকার যারাই গঠন করুক একাত্তরের মানবতা বিরোধী যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ২০১৪ সালের মধ্যেই শেষ করতে হবে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রক্রিয়া বন্ধ করা বা এটি নিয়ে হীন রাজনৈতিক স্বার্থ আদায় করা বা এটাকে দীর্ঘায়িত করা কোনো মতেই দেশের সাধারণ মানুষের কাছে গ্রহনযোগ্য হবে না। যুদ্ধাপরাধী যে দলেরই হোক, সবাইকে বিচারের কাঠগড়ায় এনে যথাযথ বিচার করতে হবে।
৫. ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় দেশ গড়ার শপথ নিতে হবে। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় যারা বিশ্বাস করে না, তাদের বাংলার মাটিতে বসবাস করা রাজনীতি করার অধিকার থাকতে পারে না। এটি শক্ত হাতে দমন করতে হবে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পরিপন্থী কোনো রাজনৈতিক শক্তিকে বাংলার মাটিতে শেকড় গাড়তে দেওয়া হবে না। সেই প্রচেষ্টা যারা করবে বা যারা সেই প্রচেষ্টাকে সহায়তা করবে, দেশের মানুষই তাদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবে। সরকারের উচিত হবে সবাইকে এটি যথাযথভাবে স্মরণ করিয়ে দেওয়া। জামায়াতে ইসলামী যদি মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় শপথ নিয়ে একাত্তরের কর্মকাণ্ডের জন্য আনুষ্ঠানিকভাবে ক্ষমা চেয়ে, মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় নতুন করে কোনো রাজনৈতিক দল হিসেবে পরিচয় নিয়ে রাজনীতি করতে চায়, তাহলে তাদের সেই সুযোগ সাময়িকভাবে দেওয়া যেতে পারে। অন্তত তিন বছরের জন্য তাদের একটি সুযোগ দিয়ে তাদের চারিত্রিক আচরণ কেমন থাকে তা পরীক্ষা করে দেখা যেতে পারে। যদি সেই তিন বছরে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পরিপন্থী কোনো কাজ জামায়াত করে, তাহলে তাদের চিরতরে নিষিদ্ধ করা যেতে পারে। কিন্তু সুযোগ পেয়ে তারা যদি একই আচরণ করে, তাহলে তাদের সকল অধিকার কেড়ে নেওয়ার ক্ষমতা সরকারের থাকবে, এমন নীতিমালা করা যেতে পারে।
৬. দেশের সকল দুর্নীতির বিচার করতে হবে। স্বাধীনতার পর থেকে এ পর্যন্ত যতো দুর্নীতি হয়েছে সবগুলো দুর্নীতির যথাযথ বিচার করতে হবে। ক্ষমতায় গেলেই মবাই টাকা বানানোর আলাদিনের মেশিন পেয়ে যায়। এটি একটি স্বাধীন দেশে কোনোভাবেই গ্রহনযোগ্য হতে পারে না। দুর্নীতি যারাই করেছে সবার বিচার করতে হবে। রাজনৈতিক প্রশ্রয়ে দুর্নীতিবাজদের ক্ষমা করলে শস্যের ভেতরের ভূত কোনো দিনই যাবে না। দেশের রাষ্ট্রীয় সম্পদ লুটপাট করে আইনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে এসব দুর্নীতিবাজরা পার পেয়ে যেতে পারে না। সন্ত্রাসের মত দুর্নীতিও বাংলাদেশের এই সময়ের সব চেয়ে বড় শত্রু। এদের থেকে দেশকে মুক্ত করতে হবে। নইলে কথিত গণতন্ত্রের সুফল কেবল দুর্নীতিবাজরাই ভোগ করবে। তা দিয়ে দেশের সাধারণ মানুষের কোনো কল্যান হবে না।
৭. বঙ্গবন্ধু হত্যার সঙ্গে জড়িত অবশিষ্টদের দেশে ফিরিয়ে এনে বিচার প্রক্রিয়া শেষ করতে হবে। জেল হত্যার বিচার শেষ করতে হবে। ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ হত্যাকাণ্ড, কর্নেল তাহের হত্যাকাণ্ড, প্রেসিডেন্ট জিয়া হত্যাকাণ্ড, নূর হোসেন হত্যাকাণ্ড, ডাক্তার মিলন হত্যাকাণ্ড সহ স্বাধীনতার পর থেকে বাংলাদেশে রাজনৈতিক সহিংসতার নামে যতো হত্যা, খুন, গুম হয়েছে, সবগুলোর বিচার করতে হবে। দেশে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করতে হলে এসব হত্যাকাণ্ডের বিচার যতোদিন ঝুলে থাকবে ততোদিন দেশে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা পাবে না। রাজনৈতিক বিবেচনায় এসব হত্যাকাণ্ডের বিচার না করে, একটি সকলের কাছে গ্রহনযোগ্য নিরপেক্ষ তদন্ত কমিশন গঠন করে এসব যাবতীয় হত্যাকাণ্ডের বিচার করতে হবে। নইলে বিচারের বাণী কেবল নিভৃতে কাঁদবে। তা কোনো দিন আলোর মুখ দেখবে না।
৮. রাজধানী ঢাকায় রাজনৈতিক সভা সমাবেশ করার জন্য জাতীয় প্যারেড গ্রাউন্ড বা ঢাকা স্টেডিয়াম বা মিরপুর শেরে বাংলা স্টেডিয়াম বা সোহরাওয়ার্দী উদ্যানকেই কেবল ব্যবহার করা যাবে, এই মর্মে আইন পাশ করা হোক। সভা সমাবেশের নামে রাস্তা বন্ধ করে নয়া পল্টন বা বঙ্গবন্ধু এভ্যিনিউ কোনো সভা সমাবেশের স্থান হিসেবে একুৃশ শতকের দ্বিতীয় দশকে এসে মেনে নেওয়া যায় না। এসব রাস্তায় রাজনৈতিক কর্মসূচির নামে যানজটে লাখ লাখ মানুষের হাজার হাজার শ্রমঘণ্টা নষ্ট হয়। যানজটে আটকা পড়ে বছরেরর পর বছর সাধারণ মানুষ অসহ্য এক নির্যাতন ও দুর্ভোগ মোকাবেলঅ করে। যা আর কোনো মতেই কারো কাছে কাম্য হতে পারে না।
৯. প্রশাসনকে দলীয়করণ বন্ধ করতে হবে। আইন শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনী রাষ্ট্রীয় সম্পদ। তাদেরকে নিজেদের মত স্বাধীন ও নিরপেক্ষভাবে কাজ করার সুযোগ দিতে হবে। প্রশাসনের যারা কর্মকর্তা কর্মচারী, তারা সবাই প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব কর্তব্য পালন করবে, এটাকে দলীয় হীন স্বার্থে ব্যবহার করার সংস্কৃতি থেকে বেড়িয়ে আসতে হবে।
১০. স্বাধীন ন্যায়পাল নিয়োগ করতে হবে। রাষ্ট্রের যে কোনো নাগরিকেরই আইন মেনে যথাযথ কর্তৃপক্ষের কাছে কর দিতে হবে। সেই করের টাকা সরকার যাতে স্বচ্ছভাবে খরচ করে, সেটাতেও সবাইকে সচেতন ও সজাগ থাকতে হবে। পাশাপাশি আইনের প্রতি সবার শ্রদ্ধা দেখানোর সংস্কৃতি চালু করতে হবে।
১১. স্থানীয় সরকারকে আরো শক্তিশালী করতে হবে। ক্ষমতার বিকেন্দ্রীভূত ছাড়া বা মানুষের রাজধানীমুখী হবার প্রবণতা বন্ধ করতে হলে প্রয়োজনে গুরুত্বপূর্ণ সাত থেকে দশটি মন্ত্রণালয় ঢাকায় রেখে অবশিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলো ঢাকার বাইরে স্থানান্তর করতে হবে। নইলে মানুষের ঢাকামুখী চাপ ভবিষ্যতে রাজধানী ঢাকাকে এমনিতেই একটি অচল নগরিতে পরিনত করবে। সে বিষয়ে এখনই সরকারি সিদ্ধান্ত না আসলে আর তা যথাযথ বাস্তবায়ন না হলে, রাজধানী ঢাকাকে বাঁচিয়ে রাখা যাবে না।
১২. শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে দলীয় রাজনৈতিক চর্চা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করতে হবে। ছাত্র রাজনীতি হতে পারে ছাত্রছাত্রীদের কল্যানের জন্য। বিভিন্ন প্রতিযোগিতা বা কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে। রাজনৈতিক দলগুলোর লেজুরবৃত্তির ছাত্ররাজনীতি কেবল টেন্ডারবাজী, চাঁদাবাজী, ছিনতাই আর ক্ষমতার দাপটের সঙ্গেই সম্পৃক্ত। যা মোটেও ছাত্ররাজনীতি হতে পারে না। দেশের শিক্ষা অঙ্গনকে বাঁচাতে হলে, ভবিষ্যত প্রজন্মকে শিক্ষিত করে কর্মমুখী মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে হলে, চলমান দুষ্টু ছাত্ররাজনীতি বন্ধ করতে হবে।
১৩. দেশের স্বাস্থ্যসেবা শুধু রাজধানী কেন্দ্রীক উন্নত না করে সারা দেশে আধুনিক স্বাস্থ্যসেবা ছড়িয়ে দিতে হবে। নইলে লোক দেখানো স্বাস্থ্যসেবা সাধারণ মানুষের চিকিৎসা দিতে বরাবরের মত ব্যর্থ হবে। আমাদের রাজনৈতিক নেতারা সর্দি-কাঁশি হলেও বিদেশে চিকিৎসা সেবা নিতে যান। আর দেশের মানুষের জন্য গরু ছাগলের খামার সর্বস্ব স্বাস্থ্যসেবা দিয়ে গাল ফুলিয়ে জনসেবায় বক্তৃতা করেন। স্বাস্থ্যসেবার মান বাড়ানোর পাশাপাশি সারা দেশে আধুনিক স্বাস্থ্যসেবা ছড়িয়ে দিতে হবে। পাশাপাশি ডাক্তারদের নৈতিকতা বাড়াতে কঠোর আইন করতে হবে। ঔষুধ কোম্পানির রিপ্রেজেনটেটিভদের পরামর্শ নিয়ে যারা প্রেসক্রিপশান করেন, তারা ডাক্তার নামের কলংক। এমনও দেখা গেছে সামান্য প্যারাসিটামল কোনো কোনো ডাক্তার সকাল দুপুর রাতে তিন বেলার জন্য তিন কোম্পানির ওষুধের নাম লেখেন। এই সংস্কৃতি বন্ধ করতে হবে। নইলে নেতাদের দেশের বাইরে চিকিৎসা নিতে যাবার সংস্কৃতির পাশাপাশি দেশে ঔষুধ কোম্পানির পরামর্শের প্রেসক্রিপশানের চিকিৎসা বেশি দিন টিকবে না। আর হাসপাতালে বিদ্যমান রাজনীতি সম্পূর্ণরূপে নিষিদ্ধ করতে হবে।
১৪. কৃষকদের উৎপাদিত ফসলের ন্যায়্যমূল্য যাতে কৃষকের হাতে পৌঁছায় সেই সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে। কৃষক সারা বছর কষ্ট করেন আর সুফল ভোগ করে কৃষকের উৎপাদিত পন্য নিয়ে যারা দালালি কর তারা। এটা একটি স্বাধীন দেশে মেনে যায় না। কৃষকের অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে সারা দেশের সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে।
২০১৪ বছরে এই ১৪টি প্রত্যাশা যদি কোনো সরকার পূরণ করার জন্য ন্যূনতম সচেষ্ট হয়, তাহলে বাংলাদেশের মানুষ শান্তিতে নিজ নিজ কাজে অনেক উন্নয়ন করবে, এটা আমি হলফ করেই বলতে পারি। সবাই ভালো থাকবেন। শান্তিতে থাকবেন। নিরাপদে থাকবেন। এই কামনা করছি। জয় বংলা।