ইন্টারনেট আর হলিউডি মুভির কল্যাণে ফ্রীম্যাসনারি, ইল্যুমিনাটির মত গুপ্তসংঘ বা কাল্ট সম্পর্কে অনেকেরই জানা আছে। অবাক ব্যপার ১৮ শতকে আমাদের ভারতীয় উপমহাদেশে এমনই এক গুপ্তসংঘের অস্তিত্ব ছিল।
'ঠগী', ইংরেজীতে 'Thugee', যে শব্দ থেকে এসেছে এখনকার বাংলায় 'ঠক', 'ঠকানো' শব্দগুলো; আভিধানিক অর্থ হচ্ছে 'প্রতারক'। ঠগী গুপ্তসংঘের সদস্যরা বিচরণ করত উপমহাদেশের পথে-প্রান্তরে; রিচুয়াল বা রীতিনীতি লক্ষ্য করলে এদেরকে আদর্শ কাল্টের উদাহরণ হিসেবে বলা যাবে। অবিশ্বাস্য হলেও সত্য যে ১৭ শতক থেকে ১৯ শতক পর্যন্ত প্রায় ৩০০ বছরে গড়ে প্রতি বছর ৪০,০০০ পথিকের মৃত্যুর কারণ ঠগীরা।
ঠগীদের নিজস্ব সাংকেতিক ভাষা ছিল যাকে বলা হয় রামসী (Ramasecane)। জমাদার বা দলপতির মুখে রামসীতে 'ঝিরণী উঠাও' (গলায় ফাঁস লাগানোর সংকেত) কিংবা 'তামাকু লাও' ডাকের সাথেই হতভাগ্য শিকারের গলায় চেপে বসতো ঠগীদের অদ্ভুত মারণাস্ত্র হলুদ একটি রুমাল যার এক প্রান্তে একটি আধুলী, কখনো দুইটি তামার টাকা বাঁধা। শুধু কি হত্যা, এমন শৈল্পিক উপায়ে মৃতদেহগুলো মাটিতে কবর দিত, যার নাম-নিশানা কোন ঠগী না দেখালে কখনোই উদ্ধার করা সম্ভব হত না। ঠগী থেকে কেন আধুনিক 'ঠক' বা 'ঠকানো' শব্দগুলো আসলো? তার কারণ ঠগীদের বিশেষত্ব ছিল পথিক কিংবা পথিকদলের সাথে তারা বন্ধুত্ব করত, পথ চলত একসাথে মাইলের পর মাইল, ক্রোশের পর ক্রোশ, সহযাত্রীরা একসাথে এক পাতেই খেত, তারপর নির্দিষ্ট স্থানে যেয়ে ঠিকই ঝিরনি উঠত, এতটুকু বুক কাঁপত না, পুরো পথিক দল যত বড়ই হোক না কেন ঠিকই হা-পিত্যেশ করে দিত। নিঁখুত প্রতারণার উদাহরণ, দেবী ভবানীর অন্ধভক্ত ঠগীরা নৃশংসতা আর লোমহর্ষক খুনে যাদের জুড়ি ছিল না।
উপমহাদেশে সে-সময় আরো এমন কাল্টের অস্তিত্ব ছিল; যেমন 'ধুতুরিয়া' (ধুতুরার বিষ প্রয়োগ করে হত্যা করত), 'তুসমাবাজ ঠগ' (দড়ির খেলা দেখিয়ে বাজী ধরত, বাজী হারলে প্রতিপক্ষকে হত্যা করত), 'ম্যাকফানসা' (এরাও ফাঁস দিয়ে হত্যা করত), 'চন্ডাল' (নৌকা করে নদীতে-জলে যাত্রীদের হত্যা করত), 'ভাগিনা' (এরাও নদীতে বিচরণ করত, তবে রক্তপাত নিষিদ্ধ ছিল, রক্তপাতহীন হত্যা করত) - প্রতিটি কাল্টই নিজস্ব রীতিনীতিতে ইউনিক, তবে ঠগীর মত বৃহৎ ও চতুর গুপ্তসংঘ আর কেউই ছিলনা।
ঠগীরা দলবেঁধে বাস করত, কোন এক গ্রামে বসত গড়ে তুলত, সারা বছর সাধারণ গৃহস্থ, ঘরকন্না করত, ভিখারিকে ভিক্ষা দিত, জমিদারকে খাজনাও দিত, কিন্তু বর্ষা শেষে পথে নামলেই তারা ভিন্ন মানুষ, নির্দয়-নির্মম-নিখুঁত খুনী, পুরো দলই। ঠগীদের রিচুয়ালগুলো অদ্ভুত, তাদের সব কাজ দেবী ভবানীকে তুষ্ট করার জন্য; কোন পথিক দলের কাছে অর্থসম্পদ নেই, কিন্তু দেবীর সুলক্ষণ আছে, অতএব পুরো দলকেই খুন করা হবে, লুটের মাল থাকুক বা না থাকুক, নাহলে দেবী রুষ্ট হবেন যে! ঠগীদের মধ্যে মুসলমান ছিল, আবার হিন্দুও ছিল, ঠগী-ধর্ম এক অদ্ভুত সমন্বয়বাদ। এইযে শত শত বছরের কলঙ্কময় ইতিহাসের স্রষ্টা, নির্মম ঠগীরা নির্মূল হয় খুব অল্প সময়ের মাঝে, এক তরুণ কর্নেল উইলিয়াম হেনরী স্লীম্যানের অধ্যবসায়ে।
বাংলায় ঠগীদের নিয়ে কিছু তথ্যবহুল বই আছে। সবচেয়ে ভাল লেগেছে শ্রীপান্থের নন-ফিকশন 'ঠগী', কলকাতার দে'জ পাবলিশিং হতে ১৯৬৩ সালে প্রকাশিত। এছাড়াও সংগ্রহে আছে নাজিমুদ্দীন আহমেদের 'মৃত্যুদূত-এক দুর্ধর্ষ ঠগের আত্মকাহিনী', ইউপিএল প্রকাশিত -কর্নেল টেলরের 'Confessions of a thug' অবলম্বনে রচিত হয়েছে, যে বইটি এক দুর্ধর্ষ ঠগী জমাদার আমীর আলীর ৭০০ হত্যার চাঞ্চল্যকর স্বীকারোক্তি নিয়ে লেখা হয়েছে। এমিলিও স্যালগারির 'থাগস অব হিন্দুস্তান' বইয়ের অনুবাদ সেবা প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত, এই উপন্যাসটিও বাংলায় সহজলভ্য।
(সূত্র: ঠগী - শ্রীপান্থ)