১৯৯৪ সালে আব্বুর পোস্টিং হল নীলফামারীতে। ফেব্রুয়ারী নাগাদ চট্টগ্রাম হতে চলে এলাম নীলফামারী। এদিকের অঞ্চলে আমাদের পরিবারের কেউ কখনো আসেনি। বিভাগীয় শহর হতে জেলা শহরে আসায় স্বাভাবিকভাবেই নতুন জায়গা এতটুকু পছন্দ হয়নি। ঢাকা হতে নীলফামারী- পথিমধ্যে যমুনা নদী, বিখ্যাত আরিচা ঘাট পার হয়ে যেতে হত। মনে পড়ে ভোর পাঁচটায় বাসে উঠে রাত প্রায় আটটা নাগাদ ঢাকা পৌঁছাতাম। এত দূরত্ব ও কষ্টের জন্য বছরে একবারের বেশী ঢাকা আসতাম না।
যাবার কিছুদিনের মধ্যেই আমার ৫ বছর ৩ মাস বয়সের মাথায় আব্বু প্রথম শ্রেণীতে ভর্তি করিয়ে দিলেন। নীলফামারী পি,টি,আই, সংলগ্ন প্রাথমিক বিদ্যালয়। সে যুগে তো আর প্লে, কেজি, নার্সারী-র বালাই ছিলনা। বয়স যতই হোক স্কুলে ভর্তি হতে চাইলে প্রথম শ্রেণী হতেই শুরু করতে হত। এখনো মনে পড়ে দুরুদুরু বুকে আব্বুর সাথে প্রথম দিন স্কুল যাচ্ছি। আমাকে প্রধান শিক্ষকের কক্ষে বসিয়ে স্যারেরা দেয়ালে একটা বাঘের ছবি দেখিয়ে এটা কি জিজ্ঞেস করলেন। তারপর প্রাথমিক শিক্ষার লোগো দেখিয়ে ছেলে-মেয়ের ছবিটা আঁকতে দিলেন। ব্যস, ভর্তি পরীক্ষা শেষ-তারপর ক্লাশে ঢুকে গেলাম।
শান্ত স্বভাবের জন্য স্যার-ম্যাডামরা অনেক আদর করতেন। শিক্ষকদের মাঝে জাহিদ স্যার আর হক স্যারের চেহারা মনে আছে। চতুর্থ শ্রেণীতে ক্লাশ টিচার ছিলেন জাহিদ স্যার। আমাকে খুব আদর করতেন। এক ম্যাডামের কথা মনে আছে ক্লাশে সবসময় পোস্টার নিয়ে আসতেন। পোস্টারের ছবি দেখে পড়াতেন। খুব সুন্দর গল্প বলে বলে আমাদের মন জয় করে নিয়েছিলেন। ওনার নামটা এখন আর মনে পড়েনা। বাকিদের নাম-চেহারা দুই-ই ভুলে গেছি।
১৯৯৮ সালে পঞ্চম শ্রেণিতে উঠলাম। মোটামুটি ভাল ছাত্র হিসেবে একটি অবস্থান গড়ে উঠেছে। পঞ্চম শ্রেণির বৃত্তি পরীক্ষাতে অংশ নিতে প্রস্তুতি শুরু করলাম। তখন ক্লাশে ভাল রেজাল্ট করা প্রথম দিকের কিছু ছাত্র শুধুমাত্র বৃত্তি দেবার সুযোগ পেত। আমাদেরকে নিয়ে ক্লাশ শেষে আলাদা করে কোচিং শুরু হল।
ষান্মাসিক পরীক্ষায় অংকে খারাপ করার পর ক্লাশ টীচার হক স্যার দায়িত্ব নিলেন আমাকে বিকালবেলা বাসায় অংক দেখিয়ে দিবেন। বাবুপাড়ায় আমাদের বাসা হতে ১০ মিনিটের রাস্তা। স্যারের কাছে যাওয়া শুরু করলাম। আমি একাই- সপ্তাহের ছয়দিন- কখনো কখনো শুক্রবারও যেতে হত। প্রথম মাস শেষে আব্বু স্যারকে কিছু সম্মানী দিতে চাইলেন-স্যার তো নিবেনই না। আব্বুর অনেক জোরাজুরীতে দ্বিতীয় মাস হতে কিছু টাকা নিলেন। স্যারের এই ত্যাগ আর নির্লোভ রূপটা আমাকে এখনো অনেক ভাবায়। স্যার যে এখন কই আছেন জানিনা। ২০০০ সালে নীলফামারী ছেড়ে চলে আসার পর স্যারকে স্কুলের ঠিকানায় দুইটি চিঠিও দিয়েছিলাম। স্যার হয়তো অন্য কোথাও চলে গিয়েছেন, চিঠির জবাব আর পাইনি। যাই হোক,অনেক চেষ্টার পর বার্ষিক পরীক্ষায় প্রথম হলাম। তবে দুর্ভাগ্যজনক ভাবে প্রাইমারী বৃত্তিটি পাইনি। আমি কিংবা ক্লাশের অন্য কারো ভাগ্যেই শিকে জুটলো না। রেজাল্টটা বহুদিন অনেক কষ্ট দিয়েছিল।
৫ বছর স্কুলে কোন টাকা দিতে হয়নি। ভর্তি হতে শুরু করে একদম বের হবার দিন পর্যন্ত পুরো ফ্রীতে পড়েছি। প্রতি ক্লাশের সব বই বিনামূল্যে পেয়েছি। আবার জাতিসংঘ হতে প্রতি বছর খাতা-কাঠপেন্সিল-রংপেন্সিলের বাক্স দিত। এখনকার ছাত্র-ছাত্রীরা শুনলে তো চোখ কপালে তুলবে। আমার দ্বিতীয় শ্রেণীতে পড়ুয়া মামাত ভাইয়ের শধু মাসিক বেতন ৮৫০ টাকা। তারপর পরীক্ষা ফী, ইউনিফর্ম ফী, বই খাতা ফী, প্রাইভেট আরো কত কী!
৫ বছরে ক্লাশে অনেক বন্ধু পেয়েছি। সবচেয়ে কাছের বন্ধু ছিল সনি। একেবারে জিগরি যাকে বলে। ক্লাশে একসাথে বসতাম, একত্রে খেলতাম, ক্লাশের মাঝে বিরতিতে ওর বাসায় দৌড়ে চলে যেতাম। ওর মা অনেক আদর করতেন। সনি ক্লাশের ফার্স্ট বয় ছিল। মিশুক আর নেতা গোছের। কিভাবে এত বন্ধুত্ব হয়েছে এখন মনে পড়ে না। এখনো ওর বিদায়টা আমার চোখে ভাসে। চতুর্থ শ্রেণীর বার্ষিক অংকন পরীক্ষা দিচ্ছি। স্কুলের বারান্দায় মেঝেতে বসে মনোযোগ দিয়ে ছবি আঁকছি। সনি গল্প করছে। হঠাৎ ওর বাবা এসে ডাক দিলেন। সনি উঠে যেতে যেতে বললো বন্ধু কালকে নীলফামারী ছেড়ে চলে যাচ্ছি। তারপর বিদায় নিয়ে চলে গেল। ভাবলাম মজা করেছে। বার্ষিক পরীক্ষার পর এক মাসের জন্য স্কুল বন্ধ হয়ে গেল। নতুন বছর স্কুল খোলার পর আর ওকে দেখিনি।
স্কুলের পেছনে বাসায় সানি নামে আরেক বন্ধু থাকতো। ক্লাশ ফাইভে আমার প্রধান প্রতিদন্দ্বী ছিল আলভী। ক্লাশের প্রথম স্থানের জন্য ওর সাথেই আমার প্রতিযোগিতা হত। ক্লাশের মাঝে কত যে ওর সাথে হাতাহাতি-মারামারি করেছি। আরেক বন্ধু ছিল(ওর নামটা ভুলে গেছি) আমাদের এক অঙ্ক স্যারের ছেলে। স্যার খুব মেজাজী ছিলেন। অবসর সময়ে হোমিওপ্যাথী করতেন। প্রত্যেকদিন ক্লাশে কাউকে না কাউকে মারতেন আর সে কি পিটুনি। আমরা ভয়ে-আতংকে থাকতাম আর ভাবতাম স্যারের ছেলে হলে কত যে সুবিধা হত। একদিন হঠাৎ দেখি স্যার নিজের ছেলেকেই সামনে ডাকছেন। তারপর স্যারের টেবিলের নিচে মাথা ঢুকিয়ে পশ্চাৎদেশে বেত দিয়ে বেদম প্রহার।
এছাড়াও মোশাররফ, নিশাত, শাকিলা, ফোরকান, ডিনা-র কথা মনে পড়ে। মোশাররফ আমার সাথে হাই স্কুলে ভর্তি হয়েছিল। মিষ্টি চেহারার নিশাত অনেক ভাল ছবি আঁকতো, তৃতীয় শ্রেণী শেষে চলে যায়। শাকিলা ভাল নাচতে পারতো, স্যারেরা ক্লাশের মাঝে ওকে সামনে ডেকে নাচতে বলতেন। মোশাররফ ছাড়া পঞ্চম শ্রেণীর পর ক্লাশ ফাইভের আর কারো সাথে আমার দেখা হয়নি।
ড্রইংয়ে খুব ভাল ছিলাম। পঞ্চম শ্রেণীতে বাংলাদেশ শিশু একাডেমীর অংকন প্রতিযোগিতায় শহরের দৃশ্য এঁকে দ্বিতীয় পুরষ্কার পেয়েছিলাম। মজার ব্যাপার হল ছবি এঁকে জমা দিয়ে ফলাফল ঘোষণার আগেই বাসায় চলে গেছি। পুরষ্কার পাবো কল্পনারও অতীত ছিল। পরদিন স্কুলে যেয়ে ফল শুনে বিশ্বাস করতেই কষ্ট হয়ে গেছে।
স্যারদের ডরমিটরি ছিল আমাদের জন্য রহস্যের জায়গা। সবার মাঝে একটা বিশ্বাস ছিল বিল্ডিং-এর ছাদে ভূত আছে। একবার ভরদুপুরে ক্লাশের ফাঁকে তিনবন্ধু মিলে ছাদে গেছি। হঠাৎ-ই একজন ভূত-ভূত বলে চিৎকার করতে করতে দৌড় দিল। আমার কাছেও মনে হল কালো ভূতের শুকনো মাথা-হাত-পা দেখলাম। উর্ধ্বশ্বাসে বন্ধুর পিছন পিছন বাকি দুইজন দিলাম দৌড়। এখন মনে হয় হয়তো মনের ভুলে কোন ছবি এঁকে নিয়েছিলাম। হয়তো সত্যি কিছু দেখেছিলাম, জানি না কি হয়েছিল।
স্কুলের পেছনে একটা বিশাল জায়গায় পুরো এশিয়া ও বাংলাদেশের আদলে স্থাপনা ছিল। ক্লাশের ফাঁকে ওটাই ছিল আমাদের খেলার জায়গা। এভারেস্ট-এর মডেলে উঠে পাহাড় জয়ের ভাব নিতাম আবার ম্যাপে শ্রীলংকার মডেল হতে লাফ দিয়ে ভারতের মডেলে চলে যেতাম আর বলতাম এক দেশ থেকে আরেক দেশে চলে এসেছি। গরমকালে স্কুলের পেছনে আম-কাঁঠাল গাছ হতে ছেলেরা ফল চুরি করে ডরমিটরির নির্জন এক কোণে রেখে দিত। পরে সবাই মিলে ভাগাভাগি করে খেতাম। আব্বু মাঝে মাঝে দুই টাকা দিতেন, আর কখনো পাঁচ টাকা দিলে সে কি উল্লাস করতাম। এমন এক সময়ের আর এমন এক জায়গার কথা বলছি যেখানে বাসা হতে দেড় কিলোমিটার দূরে স্কুলে যেতে ভাড়া লাগতো তিন টাকা।
তৃতীয় বা চতুর্থ শ্রেণীতে পড়ার সময় সত্য ঘটনা অবলম্বনে তৈরী “ছুটীর ঘন্টা” চলচ্চিত্রটি অনেক জনপ্রিয় হয়েছিল। ছবির গল্প তখন সবার মুখে মুখে ঘুরে ফিরে। ঐ গল্প শুনে আমার এমন অবস্থা হল যে স্কুলের টয়লেটে সহজে যেতাম না। একদম না পারতে গেলেও ছুটী হবার অনেক আগে যেতাম।
প্রথম বা দ্বিতীয় শ্রেণীতে পড়ার সময় বড় ক্লাশের পাশ দিয়ে যেতাম আর ভাবতাম কবে এই ক্লাশে উঠবো। অত বড় ক্লাশে উঠতে জানি আরো কত দিন লাগবে! অনেক দুঃখ হত। তারপর কিভাবে যে চোখের পলকে সব ক্লাশ পেরিয়ে গেলাম। স্কুলের দিনগুলোকে অনেক মনে পড়ে। মাঝে মাঝে ভাবি সেদিনের প্রিয় বন্ধুরা যাদের অনেকের চেহারা তো দূরের কথা নামটাও মনে নেই সবাই কে কোথায় আছে? সবাইকি বেঁচে আছে? সনি এখন কি করে? হয়তো রাস্তায় ওর সাথে আমার কখনো দেখাও হয়েছে। আমি বা ও কেউ কাউকে চিনিনি। আমার এত প্রিয় হক স্যারও জানি কোথায়?
আব্বুর সরকারী চাকরীর জন্য এক জেলা হতে অন্য জেলা ঘুরে বেড়িয়েছি। তার মাঝে আমার সবচেয়ে বেশী হাহাকার প্রাইমারী স্কুলের স্মৃতি আর বন্ধুদের নিয়ে। হয়তোবা ঐ স্মৃতিগুলো আর বন্ধুত্বগুলো অনেক নিষ্পাপ ছিল এজন্যেই। খুব ইচ্ছে আছে সময় করে একবার নীলফামারী যেয়ে আমার ছোটবেলার প্রাণপ্রিয় স্কুলটাকে আর শহরটাকে দেখে আসবো।
সর্বশেষ এডিট : ০২ রা সেপ্টেম্বর, ২০১৪ রাত ১১:২৮