শফিকুল ভাইকে প্রেমের জাহাজ বলেই চিনতাম। আমাদের সিনিয়র ভাই। আমাদের ধারণা ছিল শফিকুল ভাই মাত্রই রজনীকান্তের সাথে টক্কর দেয়ার মত কেউ। তিনি ছিলেন বৃহতী গাছের মত অযত্নে বেড়ে উঠা কল্যানকর একজন। আমরা কয়েকজন ছিলাম শফিকুল ভাইয়ের “চ্যালা”, শব্দটা খারাপ শোনায়, আমরা তার কঠিন ভক্ত ছিলাম। শফিকুল ভাই দেশের রাজনীতি, অপসংস্কৃতি নিয়ে লেকচার দিতেন, আমরা অবাক হয়ে শুনতাম। এলাকায় কেউ শফিক ভাইয়ের নামে বাজে কথা বললে মোক্ষম জবাব দিতাম। কবিতায় ছিল শফিক ভাইয়ের অগাধ পন্ডিত্য। একবার কবিতার বই বের করেও ফেললেন। সেই বইয়ের উৎসর্গে লিখলেন- শ্রদ্ধেয় বাবা ও মা। আমার আকাশে সূর্য আর চাঁদ।
শফিক ভাই অতি উৎসাহের সাথে তার বাবাকে বইটা দিয়ে বললেন, “বাবা, আপনার ছেলে পাঠকনন্দিত কবি হতে যাচ্ছে। দোয়া করুন এই অধম কে।“
শফিক ভাইয়ের আব্বা ছিলেন চরম মত্রার বাস্তববাদী লোক। দুইবার এম পি ইলেকশনে হারার পরে তখন তৃতীয় বারের প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। তিনি পুত্রের কাব্য প্রতিভায় মুগ্ধ হয়ে বললেন, “শফিক! তোর এই কবিতা চলবে মানে! পাঠক এই কবিতা চাটবে।“
শফিক ভাই আনন্দে আটখানা হয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, “আব্বা কেমনে কি?”
শফিক ভাইয়ের বাপ নেতাসুলভ হাসি দিয়ে বলিলেন, ”তোর এই বই ছিঁড়া স্কুলের সামনে আচার বেচবো, আর পোলাপান চাইটা খাইব, বাইর হ বাড়ি থিক্যা কুলাঙ্গার।“
সেই কষ্টে শফিকভাই আর কখনো কবিতার বই বের করেননি। তবে আমাদের মধ্যে কেউ যখন প্রেমিকাকে দিবে বলে শফিক ভাইয়ের কাছে আবদার করতো, শফিক ভাই সানন্দে লিখে দিতেন। আমাদের প্রেম সম্পর্কিত সমস্যার সমাধানের কর্ণধার ছিলেন তিনি। একবার তো পুরাই অঘটন, হুট করেই ঠিক হয়ে গেলো আসাদের গার্লফ্রেন্ডের বিয়ে। আসাদ শফিক ভাইয়ের পায়ে এসে কান্নাকাটি শুরু করলো, “ভাই, আপ্নে আমারে বাঁচান, আমি কেমনে থাকুম পাখিরে ছারা!“ শফিক ভাই রাজ্যের বিস্ময় চোখে নিয়ে পাল্টা প্রশ্ন করলেন, “পাখির প্রেমে পড়ছিস? আগে থেকেই গাছে গাছে থাকার প্ল্যান ছিল নাকি?”
রসাত্মক কথা বললেও শফিক ভাই ছিলেন কাজের মানুষ। দলবল নিয়ে রওনা দিলেন পাখির বাড়ি। আমি দুর্বল হৃদপিন্ডের ভীতু ছেলে, তারপরেও শফিক ভাই বলে কথা। সবার পিছে আমিও রওনা দিলাম পাখি শিকারে। সে এক লঙ্কাকান্ড, কেউ কিছু বলার আগেই শফিক ভাই বরের কলার ধরে টেনে হেঁচড়ে উঠানে নিয়ে আসলেন। আসাদ উঠানে দাড়ায়া বুক ফুলায়া সিনেমার ডায়ালগ দিলো, “পাখি, পৃথিবীর কোন শক্তি নাই তোমাকে আমার কাছ থেকে আলাদা করবে।“ কন্যা পক্ষের সবাই হায়হুতাশ শুরু করে দিল। বড় পক্ষ ভাবলো কন্যা পক্ষ ইচ্ছে করেই তাদের এইভাবে অপমান করতেছে। দুই পক্ষে লাগলো হাতাহাতি। পুলিশ এসে আসামীদের সাথে শফিক ভাইকেও ধরে নিয়ে গেলো। এই ঘটনার কয়েক সপ্তাহ পরে জানতে পারলাম আসাদের কাছে ভুল ইনফরমেশন আসছিল, আসলে সেদিন ছিল পাখির বড় বোনের বিয়ে।
শফিকভাই ছিলেন বরাবরের মত সংস্কৃতিমনা। একবার তার মাথায় ভূত চাপলো নাটক মঞ্চস্থ করবেন। আমরা তখন নাটকে পার্ট পাওয়ার জন্যে শফিক ভাইয়ের পেছনে ঘুরঘুর করতাম। আমাদের বন্ধু সত্য দেব কোনকালে রামায়ন পড়েছিল কে জানে, প্রায়ই রামায়নের অযোধ্যা পর্বের রাজা দশরথের একটা ডায়ালগ মারতো, “ কৈকেয়ী, আমার বয়স হয়েছে, আর কদিন-ই বা বাঁচবো বলো? আমাকে দয়া করো কৈকেয়ী। আমার যা আছে সব নিয়ে যাও কিন্তু রামকে বনবাসে দেয়ার মত অন্যায় করতে বলো না আমায় কৈকেয়ী।“ আমরা উৎসুক হয়ে সত্যকে জিজ্ঞাসা করতাম তারপরে? সত্য করুন চেহারা করে বলতো, রাম জানে। আমরা সব হো হো করে হেসে উঠতাম।
শফিক ভাই ঠিক করলেন তার নিজের লেখা একটা নাটক মঞ্চস্থ করা হবে। নাটকের নাম, “আমি ডাকি, প্রেম ফিরে চায় না।“ নাটকের ঘটনার সারসংক্ষেপ হচ্ছে, নায়ক ছিল পরিবার থেকে বিতারিত এক কবি। কবিতা লেখার অপরাধে যে সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন। একদিন পত্রিকায় এক মেয়ে সেই বিচ্ছিন্ন কবির কবিতা পড়ে তাকে হন্যে হয়ে খুঁজতে থাকে। প্রেম হয় দুজনের। কিন্তু নায়িকার বাবা নারাজ। সে নায়িকাকে শর্ত দেয়, হয় কবির সাথে থাকবে, নয়ত বাবার মরা মুখ দেখবে। শেষে নায়িকা দৌড়ে যেয়ে বাবার বুকে ঝাপিয়ে বলবে, “বাবা, আমাকে ক্ষমা করো, আমি এই প্রেম চাইনা।“ নায়ক আকাশের দিকে তাকিয়ে কান ফাটানো চিৎকার দিয়ে বলবে, “আমি ডাকি, প্রেম ফিরে চায় না।“ এই করুন মুহূর্তে পর্দা পড়বে নাটকের। দর্শকের হাত তালিতে চারিদিক মুখর। কারো কারো চোখে কবির জন্য আবেগি জল। নাটকের এইসব দৃশ্য কল্পনা করতেই পুলকিত হইতাম আমরা।
এরই মধ্যে শফিকভাই ঘোষণা দিলেন নাটকের জন্যে সুন্দরী অভিনেত্রী আনা হচ্ছে। সুন্দরী অভিনেত্রীর কথা শুনেই আমাদের চোখ চক চক করতে লাগলো। নাটকের আনন্দ বেড়ে গেলো কয়েকগুণ। বিধিবাম, আমার চরিত্র ছিল নায়িকার বাবার। তবে এইটুক ভেবেই সুখ, শেষ সিনে সুন্দরী নায়িকা বাবার কোলে ঝাপিয়ে পড়বে।
সবাই যার যার ডায়ালগ অতি উৎসাহে মুখস্ত শুরু করে দিল। একমাত্র হাসানের লাগতো প্যাচ। ও একটু পর পর ডায়ালগ ভুলে যেত। হাসানের চরিত্র ছিল এলাকার গুন্ডা। নাটকের এক পর্যায়ে একটা সিনে থাকবে, নায়িকাকে একলা পেয়ে হাসান বলবে, “এবার কে তোমাকে রক্ষা করবে সুন্দরী?” আরেকটা সিনে থাকবে হাসান একদিন কবিকে থ্রেট করে বলবে, “সাপের গর্তে পা দিয়েছিস, ছোবল তোকে খেতেই হবে। মু হা হা।“
হাসান এই দুই ডায়ালগে প্যাচ লাগায়া কবিকে বলতো, “এবার কে তোমাকে রক্ষা করবে সুন্দরী?”
দেখতে দেখতে চলে এলো নাটক মঞ্চস্থের দিন। আমরা শেষ বারের মত ঝালাই করে নিচ্ছিলাম ডায়ালগ। কিন্তু কপাল, নাটকের ট্র্যাজেডি পাবলিক কি দেখবে, বাস্তব ট্র্যাজেডিতেই আমরা কাইত। নাটক শুরু হওয়ার আগ মুহূর্তে খবর আসলো নায়িকার বাবার হার্ট এট্যাক হয়েছে, এক্ষুনি তাকে যেতে হবে। নায়িকা কাঁদতে কাঁদতে চলে গেলো। সবার আক্ষেপ নাটক বুঝি গোল্লায় গেলো, আমার আক্ষেপ, শেষ সিনে নায়িকা আর বাবার বুকে আসবে না।
এই কলিকালে আমাদের জন্যে মাদার তেরেসার হাত বাড়িয়ে দিলে শফিক ভাইয়ের প্রাক্তন প্রেমিকা লায়লা আপা। তিনি বললেন যে তিনি পারবেন নায়িকার রোল করতে। আমাদের মাঝে আবার প্রান ফিরে এলো। শুরু হলো নাটক। সবকিছুই ঠিকঠাক চলছিলো। নাটকের এক সিনে কবি তথা শফিক ভাই লায়লা আপাকে উদ্দেশ্য করে বললেন,
“তুমি যদি একটি বার বলো ভালোবাসি
ছেড়ে দিতে রাজি আমি এই কবিতার বুনিয়াদ
লক্ষ্য শব্দ থেকে একটি শব্দ বেছে নিয়ে
শুধু একবার বলো ভালোবাসি।“
ঠিক এই মুহূর্তে মঞ্চে উঠে এলেন লায়লা আপার বাবা। যাচ্ছে তাই অশ্লীল গালি ছুড়ে দিলেন শফিক ভাইয়ের উদ্দেশ্যে। শেষে লায়লা আপাকে হাত ধরে টেনে নিয়ে গেলেন মঞ্চের বাইরে। শফিক ভাইয়ের হিউমারে আমরা সেদিন অবাক। সে ঐ মুহূর্তে চিৎকার দিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে বললেন, “আমি ডাকি, প্রেম ফিরে চায় না।“ বলেই কাঁদতে কাঁদতে মাটিতে লুটিয়ে পড়লেন। আমরা কি করবো বুঝতে পারছিলাম না। এমন সময় শফিক ভাই চিল্লায়া বললেন, “ঐ পর্দা নামা, আর কতক্ষন কান্দাইবি?” চারিদিকে জয়জয়কার শফিক ভাইয়ের অভিনয়ে। দর্শক সবাই হাততালি দিচ্ছে সজোরে। আমি আক্ষেপ নিয়ে বলিলাম, “অন্তত লায়লা আপা তো বাবার বুকে ঝাপিয়ে পড়তে পাড়তো!”
সেদিন নাটক শেষে বোতল খোলা হলো খুশিতে। শফিক ভাই লাল পানি পান করায় অদ্বিতীয়। সেদিন হয়ত একটু বেশিই পড়েছিল পেটে। একসময় জিজ্ঞাসা করলাম, “শফিক ভাই বিয়ে করেন না কেন?”
এই প্রশ্নে শফিক ভাইয়ের কোন ভাবান্তর দেখা গেলো না। বেশ কিছুক্ষন নীরবতা বয়ে গেলো চারপাশে। হঠাত করেই শফিক ভাই নীরবতা ভেঙ্গে বলতে লাগলেন,
তোরা আমাকে যা ভাবিস আমি আসলে তা নই। আমি জীবনে একটাই প্রেম করছিলাম। শায়লা ছিল মেয়েটির নাম। আজ হয়ত আমার মৃত্যুই পারতো পৃথিবীর ইতিহাসে রোমিও-জুলিয়েট, লাইলি-মজনুর পাশে আরও একজোড়া নাম “শফিক-শায়লা” লেখাতে। আমরা দুজন প্রচুর ভালবাসতাম দুজনকে। শায়লা নাকি আমার চোখ দেখে আমার প্রেমে পড়েছিল। ছেলেদের চোখ দেখে কোন মেয়ে প্রেমে পড়েছে এইটা কখনো শুনেছিস? হা হা। খুব অদ্ভুত মেয়ে ছিল। সেজেগুজে আমার সামনে এসে বলতো “কবিতা লেখো আমাকে নিয়ে।“ ওকে সামনে রেখে আমি কবিতা লেখতে পারতাম না, আমার কলম চলতো না। ও ঠাট্টা করে বলতো আমি নাকি নকলবাজ কবি। বড় করে একটা দীর্ঘশ্বাস নিলেন শফিক ভাই। খেয়াল করলাম চারিদিকের নীরবতাটা আরও বেড়ে গেছে। অতিদুর সমুদ্র থেকে শোঁ শোঁ বাতাসের শব্দ ভেসে আসছিল কানে। রাতটা মায়ার চাঁদরে যেন জড়িয়ে রেখেছে আমাদের কজনকে। রেলিং ছারা এই উঁচু ছাদ থেকে দেখা যাচ্ছিল শহরের আলোর মিছিল। হাসান ধীর স্বরে জিজ্ঞাসা করলো, “তারপরে কি হলো শফিক ভাই?” চমকে উঠে আবার শুরু করলেন শফিক ভাই,
একদিন আমাদের প্রেমের খবরটা কিভাবে কিভাবে যেন সমস্ত এলাকায় ছড়িয়ে গেলো। তোরা তখন অনেক ছোট। বখাটে পোলাপান এলাকার দেয়ালে পোস্টারে লিখলো,
“শফিক মিয়া করলো প্রেম শায়লা বানুর সনে,
তারা দুজন আঁধার রাতে আসমানে তারা গুনে।“
শায়লার বাবা শায়লার বিয়ে ঠিক করলো তার বোনের ছেলের সাথে। দিনতারিখ পাকা করলো। শায়লা একটা চিঠিতে আমাকে লেখল ১৪ তারিখ আমাবস্যায় আত্মহত্যা করবে। তখন তোদের মত উড়নচণ্ডী মন। আমিও ঠিক করলাম একই রাতে আমিও আত্মহত্যা করবো। কিন্তু আমি সেই রাতে আর পারি নাই। আত্মহত্যা করতে সাহস লাগে, আমার সেই সাহস ছিলোনা। আমি আসলে একটা কালপ্রিট।
উঠে দাড়ালেন শফিক ভাই। আমাদের সবার চোখে চাঁদের আলো ধরিয়ে দিচ্ছিল জলের ফোটা। এই কালপ্রিট শফিক ভাইয়ের জন্যে কেন যেন মমতা অনেকগুন বেড়ে গেলো। শফিক ভাই উদাস হাটতে লাগলেন রেলিং ছারা ছাদটার শেষ মাথার দিকে। আমরা মন্ত্রমুগ্ধের মত তাকিয়ে রইলাম চাঁদর দুহাতে ছড়িয়ে দেয়া শফিক ভাইয়ের দিকে। হঠাত করেই চাঁদের আলো থেকে মুছে গেলো শফিক ভাইয়ের ছায়া।