
ফুপ্পির বাসায় কলিংবেল চাপতেই আযান শুরু হয়ে গেলো। বর্তমানে অদ্ভুত সব টিউন সেট করে কলিংবেলে। কখনো কুকুর ডাকে আবার কখনো ব্রিটনি স্পেয়ারস গান গায়। ফুপ্পির বাসায় বেলহুজুর সময়ে অসময়ে আযান দেয়। হুজুরের আযান শেষ হওয়ার আগেই দড়জা খুললেন গুলশানারা ফুপ্পি। প্রায় ছয়মাস পরে তার সাথে দেখা। এ ক’দিনে ফুলে ইয়া মোটা হয়ে গেছে। মনে হচ্ছে বিশাল কোন এক দৈত্যের সামনে দাঁড়িয়ে আছি, যেকোন সময় আমাকে তুলে আছার মারবেন। আমি এগিয়ে গিয়ে বললাম,”কেমন আছো ফুপ্পি?”
“রিক তুই? আমার তো বিশ্বাস হচ্ছে না!”
“চিমটি কাটবা?”
“আগে ভেতরে আয়, দুপুরে কিছু খেয়েছিস?”
“হুম ক্যাফেটেরিয়াতে সিঙ্গারা খেয়েছি, তোমার পুত্রধন কোথায়?”
“আছে ওর ঘরে, তুই বাবা যেয়ে দেখ তো দড়জা খুলে কি না। আর শোন আমি তোর জন্য জাপানি নুডলস করতেছি, না খেয়ে কোথাও যেতে পারবি না।“
ফুপ্পির বাসায় আসা মানেই তার নতুন নতুন রেসিপি টেস্ট করা। জাপানি, ফ্রেঞ্চ, মেক্সিকান সব রকমের রেসিপি ট্রাই করান তিনি। ভাগ্যিস আজ সোমালিয়ান কোন খাবার রেসিপিতে নেই। অনেক আগে একবার ফুপ্পির মঙ্গোলিয়ান এক রেসিপি ট্রাই করে তিনদিন ICDDRB তে ভর্তি ছিলাম। তারপর থেকে তার বাসায় খাওয়ার ব্যাপারে এক্সট্রা সচেতনতার আশ্রয় নিতে হয়। ইমনের ঘরে নক করে কোন সাড়াশব্দ পেলাম না। বাইরে দাঁড়িয়ে ওর মোবাইলে একটা মেসেজ দিলাম, Open your gate, a strange treasure waiting for you.
সাথে সাথে দড়জা খুলে আমাকে জড়িয়ে ধরলো ইমন। আমি বললাম,
“কিরে খচ্চরের বাচ্চা কেমন আছিস?”
“ভাইয়া তুমি আসছ এতদিন পরে? ভেতরে আসো তোমার সাথে অনেক কথা আছে।“
“তোর বাপ কোথায়?”
“কে সোলাইমান ভাই? সে তো ব্যাবসার কাজে ঢাকার বাইরে গেছে।”
“তোর ভাই হলো কিভাবে? যাইহোক, ছ্যাকা খাইছিস?”
“তুমি তো সবই জানো ভাইয়া, রিনা যে আমার সাথে এমন করবে কখনো ভাবি নাই।“
“এর আগের পনেরটা প্রেমের বেলাতেও ভাবিসনি, তোর গাঁজার পোটলা কোথায় রাখছিস?”
“ভাইয়া পুরা মাথা নষ্ট, এইবার বর্ডার থেকে পুরা কলির মাল ম্যানেজ করছি, তুমি টানবা?”
“বানায় ফেল দুইটা, তার আগে তোকে জাপানি নুডলস খেতে হবে।“
মনোযোগ দিয়ে গাঁজা তৈরিতে ব্যাস্ত ইমন। আগে থেকেই কেটে কুঁচি কুঁচি করে রেখেছে। গোল্ডলিফের তামাকের সাথে মিক্স করলে নাকি এক্সট্রা পিনিক হয়। সিগারেটের ছোখা খালি করে তার ভেতরে নিপুন ভঙ্গিতে গাঁজা ঢুকাচ্ছে সে। দুইদিন হয়ত ঘুমায়নি, হাত কাঁপছে। এরই মাঝে দড়জায় নক করে জাপানি নুডলস দিয়ে গেছে কাজের মেয়ে। প্রায় সন্ধ্যা হয়ে এসেছে। বাতাসে জানালার পর্দা উড়ছে। ইমন বললো, “ভাইয়া রেডি হয়ে গেছে, সাথে লিকুয়িড কিছু খাবা?”
“লিকুয়িড কি আছে?”
“বাবার এক বন্ধু জে ডি এনেছে বাইরে থেকে। একটা হাফ লিটার ইনটেক আছে।“
“আগে জাপানি নুডলস খেয়ে নে, তারপরে দুজনে ছাদে বসে খচ্চরের জিনিস খুলবো।“
বাচ্চাদের মত করে নুডলস খাচ্ছে ইমন। দেখতে মায়া লাগছে। দুইদিন এই ছেলে না খেয়ে পরে ছিল। খাওয়া শেষে সন্ধ্যায় ছাদে দুজনে লিকুয়িড আর তারপরে শুকনা টেনে ঝিম ধরে বসে রইলাম। ইমনের শেষ প্রেমের গল্পটা এমন, রিনাকে সে ভীষণ লাভ করতো, অবশ্য পূর্বের পনেরটি প্রেমের বেলাতেও একই কথা বলেছিল। ওর প্রেমের কাহিনী নিয়ে একটি মহাগল্প লেখা যাবে। কবিরা মহাকাব্য লিখে গেছেন, কিন্তু গল্পকারেরা মহাগল্প কেন লিখলেন না সেটাও একটা জ্বলন্ত প্রশ্ন মানে এ বারনিং কোশ্চেন। যাইহোক, রিনা ওকে ধোঁকা দিয়ে ওরই এক ফ্রেন্ডের সাথে রিলেশনে গেছে। আজকাল রিলেশন ব্যাপারটা ছেলেখেলা হয়ে গেছে। ফার্স্ট হ্যান্ড গার্লফ্রেন্ড, সেকেন্ড হ্যান্ড গার্লফ্রেন্ড আরও কত কি। সেই শোক ভুলতে ইমন গাঁজা সেবন কে বিকল্প পদ্ধতি ভেবে নিয়েছে। একজন মানুষকে কোন কথা বুঝাতে হলে তার পরিস্থিতিতে যেয়ে বুঝানো সবথেকে উত্তম। একজন সাহিত্যিক অন্য একজন সাহিত্যিককে বুঝতে পারে, তেমনি একজন মাতাল অন্য একজন মাতালের কথা মনে গেঁথে নেয়। ইমন কে বাস্তব কিছু কথা বুঝিয়ে দিলাম, এবার কিছুদিন ও লাইফ নিয়ে ভাববে, যদিও পরে আবার প্রেমের সন্ধানে কবুতর সার্চ শুরু করবে। ইমনকে আকাশের তারাদের সাথে যোগাযোগ করিয়ে দিয়ে আমি সোজা রাস্তায় নেমে রিকশা নিলাম। নইলে রাতে হয়ত ফুপ্পির উগান্ডা কিংবা কঙ্গোর রেসিপি টেস্ট করতে হবে।
রাতে এলকোহল খাওয়ার পরে রিকশায় চড়ার মজাই আলাদা। চোখ বন্ধ করে দুইহাত ছড়িয়ে বসে থাকলে মনে হয় এই পৃথিবী আমার রাজ্য। আমার রাজ্যের আমি রাজা আবার আমিই প্রজা। সারি সারি ল্যাম্পপোষ্ট একের পর এক পাশ কাটিয়ে যায়। নিয়ন আলোয় সমস্ত শহর নতুন সাজে সামনে আসে। রিকশার গতির সাথে বাতাসের গতি বাড়ে। সেই বাতাস শরীরে আদর ছুঁয়ে যায়। শীতল বাতাস শুরু হয়েছে। বৃষ্টি নামতে পারে। রিকশার গতি এখন আরও বেড়েছে। প্রকৃতি চিৎকার করে ডাকছে তার বুকে মিলিয়ে যাওয়ার জন্যে।
সকালে ঘুম ভেঙ্গেছে ডাইনী নীনার ফোন পেয়ে। প্রতিদিন সকালে এই মেয়ে ফোন করে ঘুম ভাঙ্গায়। মাঝে মাঝে বিরক্ত হয়ে ফোন কেটে দিলে একের পর এক ফোন করে যাবে, আর মোবাইল অফ রাখলে মেসজ দিতে থাকে, পরে মোবাইল অন করলে একের পর এক মেসেজ আসতে থাকে, মাথা পুরা আউলা হয়ে যায়। বাধ্য হয়েই ওর ফোন রিসিভ করতে হয়।
“হ্যালো!”
“মন, কেমন আছো তুমি?”
“ঢং করবি না একদম, কি জন্যে ফোন করছিস?”
“পরান পাখি আমার, তোমাকে কি আমি ফোন করতে পারি না। ঘুম কেমন হলো?”
“মন পরান এইসব কি? সুস্থভাবে কথা বলতে পারস না?”
“আহ, তুই কি আমাকে সুস্থ থাকতে দিয়েছিস? ভালো কথা শোন, যার জন্যে ফোন দিয়েছি সেইটা বলি। আজ আমার মন খুব খারাপ, তুই আমাকে নিয়ে একটু ঢাকার বাইরে যাবি। আমি প্লেস ঠিক করে রেখেছি, গাজীপুরে আমার মামার একটা বাগানবাড়ি আছে। সেখানে যাব। আমি গাড়ি নিয়ে তোদের বাসার সামনে আসছি।“
“তোর কথা শেষ হয়েছে?”
“নাহ, আমরা সেখানে লাঞ্চ করবো, আমি স্টার থেকে লাঞ্চ আনতে পাঠিয়েছি। আর রাতের খাবারে...”
“থাম, আমি যেতে পারছি না, আমার কাজ আছে।“
“কি কাজ শুনি? তোর জি এফ মিমির পাও ধরে বসে থাকবি? গাধার বাচ্চা কোথাকার। রেডি হয়ে নে, আমি আসছি।“
বুঝলাম মহা বিপদে পরেছি। এক্ষুনি নিজের ঘর বাড়ি ছেরে পালাতে হবে। অনেকদিন মামুনের মেসে যাওয়া হয় না। আজ সেখানেই দিনটা পার করতে হবে। ডাইনী নীনা গাজীপুরে যাবে এর পেছনে কোন কারন নিশ্চয়ই আছে। সূক্ষ্ম কোন কারন ছারা এই মেয়ে কিছু করে না। তারচেয়ে মামুনের সাথে আড্ডা দেয়া যাক। আজ ছুটির দিনে আড্ডার আসর বসানো যাবে। অন্যসব বন্ধুরাও চলে আসবে। রাতে সোহরাওয়ার্দিতে কবিতার আসর জমজমাট হবে। আমাদের মধ্যে অনেকেই খুব ভালো কবিতা লেখে। আমি নিজেও মাঝে মাঝে কবিতা লিখি, ফিজিক্সের ছাত্র হলেও কবিতা লেখার অভ্যেস আছে ছোটবেলা থেকে। গত ঈদসংখ্যায় একটি কবিতা এসেছিল আমার, তাও সব কবির শেষে শেষ পাতায়, আরেকটু হলে ঈদসংখ্যা থেকেই বেরিয়ে যেত। আসরে এই কবিতাটি সবাইকে কিছুটা সময়ের জন্যে স্তদ্ধ করিয়ে দেয়,
এখনো তুমি ঘুমাও?
কতটা দিন গিয়াছে কাটিয়া
দেখিনি তোমায় যতন করিয়া,
আমাতে কিছু হইবে ভাবিয়া
মরিতে শত মিছে কাঁদিয়া।
আজিকে কেন এত ভরা চাঁদ
জোনাক জ্বলা আলো ছায়া রাত,
দখিনা বাতাসে বিষাদের সূর
বেলীর সুবাস ভাসে বহুদূর।
রাতের বেলায় ঘুমের ঘোরে
পাশেই যখন হাতটি পড়ে,
জাগিয়া দেখি তুমি সেথা নাই
শুন্য এ’ঘর এই বিছানায়।
এখনো কি তুমি ঘুমাও?
মামুনের ওখানে আর যাওয়া হলো না। বাসা থেকে বেড়িয়ে চোখ ছানাবড়া। ডাইনী দাঁড়িয়ে আছে। বুক ধক ধক করছে। স্নায়ুচাপ বেড়েছে, মস্তিস্ক কোন কথা সাজাতে পারছে না। কোনমতে জিজ্ঞাসা করলাম,”তুই এখানে?”
“হ্যাঁ মনপাখি, একঘণ্টা থেকে এখানে দাঁড়িয়ে আছি। আমি জানি আমার ফোন পেয়ে তুই পালাবি, তাই এখানে দাঁড়িয়ে তোকে ফোন করেছি। চল গাড়িতে উঠ।“
“ আমি দূরে কোথাও যেতে পারবো না, আজ শরীর খারাপ, তাছারা কাজ আছে।“
“গাড়িতে উঠ গাধার বাচ্চা, আমি তোর শরীর ভালো করার ব্যাবস্থা করছি।“
ওর সাথে বৃথা তর্ক করার মানে হয় না। দেখা যাবে চিৎকার চেঁচামিচি করে রাস্তার কিছু মানুষ জরো করাবে। একজন রমণীর বিপদ ভেবে পাবলিক উৎসাহের সহিত এগিয়ে আসবে। দেখা যাবে কেউ কিছু না বুঝে আমাকে কিল ঘুষি লাথি শুরু করবে। তারপরে একমাস পিজিতে পা ঝুলিয়ে বেডে শুয়ে থাকতে হবে। তারচেয়ে এই ডাইনীর কথা মেনে নেয়াই ভালো। গম্ভীর হয়ে বসে আছে নীনা। মন খারাপের অভিনয় করার চেষ্টা করছে, কিন্তু কিছুতেই পারছে না। মানুষের মন খারাপ হলে তার চোখ এবং তার আশেপাশে তার প্রতিফলন ঘটে। নীনার চোখ চকচক করছে। আমার দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করল,”তোর কি মনে হয় মিমি তোকে সত্যিই ভালোবাসে?”
“বোকার মত প্রশ্ন করছিস কেন?”
“আমি বোকা নই তুই ভালো করেই জানিস, শোন তুই যেহেতু একটা গাধা তাই ফ্রেন্ড হিসেবে তোকে সাবধান করাটাই আমার দায়িত্ব। মিমি আসলে তোকে ভালোবাসে না। তোর মত স্মার্ট আর বোকা ছেলে সে আর একটিও পাবে না। তাই তোকে হাতে রেখেছে। যখন তোর থেকেও ভালো কাউকে পাবে তখন তোকে ছেরে যাবে, এতটুক নিশ্চিত থাক।“
“ছেরে গেলে যাবে, তখন তুই থাকবি, এত চিন্তার কি আছে?”
“তোর কি মনে হয়, ছ্যাকা খাওয়ার পরে আমি তোর সাথে রিলেশনে যাব? তুই যদি ছ্যাকা খাওয়ার আগে আসতে চাস তাহলে আমি রাজি আছি।“
“প্রেম করতে হবে এমন কোন বাধ্যবাধকতা আছে? যখন ছ্যাকা খাব তখন দেখা যাবে কি হয়। এখন বল আমরা কোথায় যাচ্ছি?
“ভয় করিস না, তোকে নিয়ে পালিয়ে যাচ্ছি না,আগের প্ল্যান বাদ, এখন শপিং করবো। তুই পছন্দ করে দিবি।“
আসলে নীনার কথাই হয়ত ঠিক। মিমিকে আমি কখনো বুঝতে পারি না। এই মেয়ে নিজেকে সবসময় একটা রহস্যের মাঝে রাখতে পছন্দ করে। সেই রহস্য ভেদ করার ইচ্ছে থাকলেও আমি কখনই পারি না। মিমি অনেকটা মেঘের মত, ইচ্ছে করলে ঝরবে, আবার ইচ্ছে করলে ভেসে বেড়াবে। ওর ঘরের দড়জায় খিল দেয়া, শুধু জানালায় জোছনার আলো পরে। আমাবস্যায় সেই আলোরও দেখা মেলে না। ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক শুনে জানালা বন্ধ করে সে, অথচ শৃগালের ডাকে আনন্দে নেচে উঠে।
(চারপর্বে ১৪ তারিখ ভ্যালেন্টাইন্স ডে -তে সমাপ্ত হবে। পরবর্তী পর্ব থাকছে আগামিকাল)
রোদের পরে মেঘ কেঁদেছে, ইচ্ছে তোমায় ছুটি।
সর্বশেষ এডিট : ১২ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১২ সকাল ৮:০৫