শীতের দিনগুলো ছিল সব থেকে মজার। সকালে উঠে উঠোন পেড়িয়ে রাস্তায় যেয়ে দাড়াতাম। মাথায় কলসি নিয়ে কোন খেজুরের রস বিক্রেতা দেখলে চিৎকার করে ডাকতাম। তারপরে বাড়ির ভেতরে নিয়ে আসতাম। দড়জার সামনের সিঁড়িতে বসে বেতের ঝুরিতে মুড়ি নিয়ে তাতে দুই টুকরো খেজুরের গুড় দিয়ে গুর গুর করে খেয়ে যেতাম। অথবা সিলভারের গ্লাসে খেজুরের রসে মুড়ি দিয়ে কিছুক্ষন অপেক্ষা করতাম। তারপরে মুড়ি ভিজে গেলে চামুচে করে তুলে খাওয়া হতো। মুডি শেষ হলে গ্লাসে আমার মুড়ি ঢেলে আবার সেই একই প্রক্রিয়া। প্রতিদিন সকালে বড় টুকরিতে নীল পলিথিনে বনরুটি এবং ক্রিম মাখানো রুটি জরিয়ে এসে উঠনে হাক দিয়ে বলতো," বনরুটি বাটারবন।" ছুটে যেতাম। দুই ভাইবোন দুটি সাদা ক্রিম মাখানো রুটি নিতাম। দুপুরে আইস্ক্রিম ওয়ালা এসে কাঠের বাক্সের ঢানিটা দুই তিনবার শদ করে " এই আইস্ক্রিম " বলে চিৎকার করতো। কাঠি আইস্ক্রিম দুইটাকা আর পাইপ আইস্ক্রিম একটাকা। পাইপ আইস্ক্রিমের আমার বিভিন্ন রং ছিল। কমলা , সবুজ, খয়েরি, সাদা। পাইপ আইস্ক্রিম খেয়ে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে জিহ্বা বের করে দেখতাম রং হয়েছে কি না। আমাদের প্রতিদিনের মেনু থেকে ঝালমুড়িওয়ালা কিংবা আচারোয়ালাও বাদ পরতো না। বড়ই আচার, আম্লকির আচার জল্পাইয়ের আচার আর চালতার আচার ছিল প্রধান। একটা বইয়ের কাগজকে ছয়টুকরা করে একটুকরায় আচার দেয়া হতো। মাঝে মাঝে ভাবতাম , আমি যদি আইস্ক্রিম কিংবা আচারওয়ালা হতে পারতাম তাহলে কত্ত ভালো হতো!
জন্মের আগের কথা কেউ বলতে পারে না, কিন্তু সকলের কাছ থেকে শোনা ঘটনায় আমার বাবা মায়ের বিয়ের একটা কল্পসৃতি আমার মস্তিষ্কে আঁকা আছে। আম্মুরা ঢাকায় থাকতেন তখন। পারিবারিক ভাবে তাদের বিয়ে ঠিক করা হয়। বিয়ের আগের দিন পর্যন্ত আমার বাবা আমার মাকে দেখেনি। দাদার মতামতকে এখনো গুরুত্ব দেন তিনি। ভেবে অবাক হই মাঝে মাঝে, আমার বাবা মা দুজন বিয়ের আগে কেউ কাউকে দেখেনি। কিন্তু তাদের সুখী সংসারে বড় হয়েছি আমি। বিয়ের দিন একটি লঞ্চ ভারা করা হয়েছিল, আমাদের বাড়ির দক্ষন পাশে ভেড়ানো ছিল নাকি, সেখান থেকে ঢাকায় বরযাত্রি নিয়ে গিয়েছিল। তখন লম্বা একপ্রকার হাত বোমা বিয়েতে ফোটান হতো, মেঝচাচার বিয়েতে আমিও সেই বোমার ব্যাবহার দেখেছি। যাইহোক, আব্বু আম্মুর বিয়ের দিন আমার বড় ফুপুর মেঝছেলের হাতে সেই বোমা ফেটে গিয়ে নাকি বিতিকিচ্ছিরি অবস্থা। এসব ঘটনা দেখা হয়নি। কিন্তু কিছু ঘটনা মানুষ শোনার পরে মস্তিষ্কে সেই ছবি আঁকে। তেমন একটি ছবি আমার মস্তিষ্কে আঁকা।
দাদু বলতেন ছেলেরা উঠোন ঝাড়ু দিলে নাকি বাড়িতে মেহমান আসে। আমি তাই প্রায়ই উঠোন ঝাড়ু দিতাম। কাকতালীয় ভাবে দেখা যেত সত্যিই মেহমান চলে এসেছে। মেহমান বলতে আমার ফুপ্পিরা। তারা আসলে আনন্দের সীমা থাকতো না। ওরা আসলে নতুন গল্প শুনতে পাবো, আমাদের বড় উঠোনে বউচি, গোল্লাছুট, কানামাছি খেলতে পারবো। একবার এমনি সবাই বেড়াতে এসেছে। সন্ধায় কানামাছি খেলছিলাম সবাই। চোর আমার ছোট বন। বাঁধা চোখে না দেখে পূবের ঘরের পাকা দেয়ালে পরে ওর চিবুকের নীচে দিয়ে গেলো কেটে। সেইবছর আব্বু বিদেশ থেকে দেশে এসেছিলেন। আব্বু আর মেঝফুপা মিলে ওকে নিয়ে বাজারের ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেলো। সেদিনের মত সবাই খেলা বন্ধ করে জরসর। সেই ছোট বোনের আজ নিজের সংসার আছে। ভাবতেই অবাক লাগে খুব। কিন্তু এখনো ও আমার কাছে সেই পুতুল খেলা ছোটবোন। একবার কি এক কারনে ওকে একটা চর মেরেছিলাম। তখন আমরা ঢাকায় থাকি। ও রাগ করে আমার ঘরে আমার যত জামাকাপড় ছিল সব কেঁচি দিয়ে কেটে রেখেছে। আমার পরনের শার্ট প্যান্ট ছারা আমার কোন জামাকাপর অবশিষ্ট নেই! আজ ও অনেক বুঝতে শিখেছে। এখন আমাকে বুঝায়। কত অদ্ভুত মানুষের জীবন, এইতো কিছুদিন আগের ফেলে আসা দিন এখন অনেক বয়স বাড়িয়ে দিয়েছে আমাদের।
আমার মেঝচাচাকে যখন বিয়ে করানো হয় তখন আমি অনেক ছোট। তখনো স্কুলে ভর্তি হইনি। মোটামুটি তিন সাড়ে তিন কিলোমিটার দূরে চাচির বাড়ি। বর্ষাকালে নৌকা আর অন্য সময়ে হেটে বিল পার করে যেতে হয়। চাচার বিয়ের সময় সে কি ধুমধাম। জীবনের এই একটি সময়ে আমাদের সমস্ত পরিবার একসাথে দেখেছিলাম। তারপরে আর কোথাও সবাই একসাথে হয়নি, কেউ না কেউ আসতে পারতো না। দাদার দশ ছেলেমেয়ের সবাই আর সব নাতিনাতনি। কি এক জমজমাট অবস্থা বলার বাইরে। বিয়ের দিনে কত আনন্দ, বাড়ির মাঝে সাজসাজ রব। একসময়ে শুরু হলো বাড়ির উঠনে কাদা ছোঁড়াছুঁড়ি খেলা। যে যার গায়ে কাঁদা লাগাতে পারে। বাড়ির ছেলেবুড়ো সবাই যোগ দেয় সেই আয়জনে। উঠোন নষ্ট করায় দাদার চিল্লাপাল্লা কেউ কানেই তুলছে না। নাতনিরা ধরে দাদাকেও মাখিয়ে দিলো কাদামাটি আর রং।
বিয়ের দিনে চাচার সাথে পালকিতে করে যাওয়ার সুযোগ হলেও আসার সময় হেটে আসতে হয়েছে। রাতের বেলায় ঝুম বৃষ্টিতে ফিরতি বরযাত্রি দলে একেকদল একেকদিকে। বিলের কাদামাটিতে আছার খেতে খেতে জান শেষ সবার। বাড়িতে এসে সেকি কি অবস্থা। পালকিতে থাকা বর কোনে ছারা সবাই কাঁদায় ডুবাডুবি করে একাকার। পূবের ঘরে জরির বাসর ঘর সাজানো হয়েছিল। পরের দিন ভালো করে খেয়াল করলাম আমার নতুন চাচিকে। ভিড়ে দেখাই হয়নি। মেহমান সব চলে যাওয়ার পরে দেখলাম আমার চাচি খুব স্বাভাবিক ভাবে মানিয়ে নিয়েছেন সব। আমাকে আর আমার ছোট বোনকে খুব রকমের আদর করতেন। মেঝচাচু কাকিকে বাড়িতে রেখে আবার বিদেশে চলেগিয়েছিলেন। চাচার বিদেশ থেকে আনা মেকাপ বক্সের মেকাপ দিয়ে কাকি ধরে সাজিয়ে দিতেন। এখন এসব মনে হলেও ভীষণ হাসি পায়। কাকি এখনো বলেন আমাকে নাকি দেখতে মেয়েদের মত লাগতো। আম্মু বলেন ছোট থাকতে যখন ঢাকায় বেরাতে আসা হতো তখন নাকি কোন স্কুলের সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় কিংবা পরিচিত মেয়েরা ধরে গালে মুখে লিপস্টিকের দাগ এঁকে দিত। আফসোস এখন আর দেয় না।
আমাদের আরবি আর আদর্শ লিপি পড়াতেন মসজিদের ইমাম। উত্তরের ঘরের বারান্দায় কিংবা গরমে উঠনে শীতল পাটি বিছিয়ে দেয়া হতো আমাদের পড়ানোর জন্য। আমপারা আর আদর্শলিপি পড়া হয়েছিল সেই হুজুরের কাছে।
তারপরে যখন স্কুলে ভর্তি হলাম তখন আমাদের পড়াতে আসতেন পাশের বাড়ির সমাপ্তি আপা। সমাপ্তি আপা কলেজে পড়তেন। দেখতে ভালই সুন্দরী, ছোট চাচ্চুর এক বন্ধু তাকে পছন্দ করে বলে সবাই জানতো। আমি আম্মুকে একদিন কি মনে করে বলে ফেলেছিলাম আমি বড় হয়ে সমাপ্তি আপুকে বিয়ে করবো। সেই থেকে আমার নাম “ সমাপ্তির জামাই” এই কথা যখন সমাপ্তি আপুর সামনে বলা হতো লজ্জায় আমি বেগুনি না হয়ে পুরাই বেগুন হয়ে যেতাম। আর সমাপ্তি আপা শুধু হাসতো। কি সুন্দর সে হাসি। গল্প উপন্যাসের ক্লাসের মিস এর মত আমার জীবনের প্রথম প্রেম হয়েছিল বোধ হয় সমাপ্তি আপার সাথে। আমাকে অনেক সময় কোলে বসিয়ে হাতে ধরে লেখা শিখাতেন, কি মিষ্টি এক ঘ্রান, আর লেখা সুন্দর করতে পারলে চুমো ফ্রি। তাই প্রানপন চেষ্টা করতাম কিভাবে সমাপ্তি আপুকে খুশি করানো যায়। আমার ইংল্যান্ডের ভিসা হওয়ার কিছুদিন আগে সমাপ্তি আপুর সাথে দেখা হয়েছিল। বয়স হলেও সেই আগের মতই সুন্দরী। এক ছেলে এক মেয়ের মা। আমাকে দেখে বলেছিলেন,”কি এখন তো অনেক বড় হয়েছে, আগের মত লজ্জা পাও নাকি? আপুকে কি মনে পরে না?” যাইহোক প্রাক্তন কিংবা প্রথম সেই প্রেমিকার ছোট ছোট বাচ্চা দেখে খারাপ লাগার চেয়ে ভালই লেগেছিল খুব। ফুটফুটে দুটি বাচ্চা।
স্কুলে পড়ার সময়ে অদ্ভুত সব ঘটনা ঘটত। আমাদের বাড়ির বাইরে আমার যাওয়া নিষেদ ছিল বলে বাইরের জগত তেমন জানা হয়নি। আমি খুব মাত্রার ভীতু ছিলাম। আমার দাদা আমার সাথে ক্লাস করতেন। আর বাবু স্যার বলতেন,” সবাই যদি তোমার মত করে একজন দাদা নিয়ে আসে তাহলে আমরা এত জায়গা দেব কিভাবে?” বলেই হো হো করে হাসতেন তিনি।
ক্লাস থ্রি তে পড়ার সময় আমি তখন একাই স্কুলে যাই। একা বললে ভুল হবে, আমি আমার ছোটবোন আর সালামা আর সালমার ছোট বোন। সালমা আর আমি একই ক্লাসে পড়তাম। দুজনে খুব ভাব ছিল। দুজন একসাথে এক বেঞ্চিতে বসে ক্লাস করতাম। ক্লাসের দুষ্ট ছেলেদের সেটা সহ্য হতো না। তারা একদিন আমাকে আর সালমাকে হুমকি দিলো যে আমাদের মাঝে নাকি প্রেম চলছে তা ওরা বুঝতে পারে। আমাদের নামে নাকি আমার দাদুর কাছে বিচার দিবে। আমি আর সালমা আগেই যেয়ে দাদুকে বলে দিলাম এসব কথা। ওরা বিকেলে স্কুল ছুটি হওয়ার পরে একটা নকল প্রেমপত্র লিখে উপরে আমার নাম আর নীচে সালমার নাম লিখে অপর পেজে একটা লাভ চিহ্ন এঁকে সেখানে আমার নাম সাথে যোগ চিহ্ন দিয়ে সালমার নাম লিখে আমার দাদুর কাছে এই প্রেমের বিচার ও প্রতিকার নিয়ে এসেছে। আমার দাদী ওদের বানানো নাটকের সারসংক্ষেপ শুনে ওদের এমন ধোলাই দিয়েছিল যে আজো সেই দলের শাহিন নামের ছেলেটি বলে সেই কথা। পরবর্তীতে ওদের সাথে ভালো বন্ধুত্ব হয়েছিল। আর ঢাকায় আসার পরে যখন আমি বিগরে গেলাম, তার অনেক পরে শাহিনের সাথে দেখা কলেজে। তখন এই বিগরে যাওয়া আমাকে দেখে অনেকটা অবাক হয়েছিল।
আর সালমা? শুনেছিলাম সালমা প্রেম করে বাড়ি থেকে পালিয়ে বিয়ে করেছিল আমার এক ক্লাস বড় এক ছেলেকে। সেই ছেলে ছিল আমার বন্ধুর মত। একবার গ্রীষ্মের ছুটিতে গ্রামে যেয়ে দেখলাম সালমাকে। প্রথমে চিনতে পারিনি। বয়স যেন অনেক বেড়ে গেছে। স্বাস্থ্য বেড়েছে। আমার সেই বন্ধু তাকে নিয়ে যাচ্ছে হাসপাতালে, ওদের নাকি সন্তান হবে। একদিন আমাকে ওদের বাড়ি যাওয়ার কথা বলে গেলো। ভীষণ অবাক লাগলো, আমার সেই ছেলেবেলার সঙ্গীরা কেউ আর আগের মত নেই। আমি সময় পেলে ছুটে যেতাম আমার গ্রামের বাড়ি। হাতরে হাতরে দেখতাম আমার আলমিরা ভরা খেলনা যা আমার দাদী আমার সন্তানদের জন্য রেখেছেন যেন তারা বুঝতে পারে কতটা আদরে বড় হয়েছে তাদের বাবা।
আমার শৈশব, কৈশোর আর তারপরের লাগামহীন দিনগুলি - ১
(পর্বভিত্তিক ভাবে চলবে)
সর্বশেষ এডিট : ৩১ শে ডিসেম্বর, ২০১১ রাত ১:০৪