ম্যানচেষ্টার সিটি শপিংয়ে ঘুরছিলাম। ভালো একটা শার্ট কিনতে হবে। সাথে আছে বন্ধু স্যাম। সাদা চামড়ার বিদেশি নাম হলেও সে আমার ছোট বেলার বন্ধু। বাইরে এসে সামিউল থেকে স্যাম হয়েছে। দেশের পড়ালেখা শেষ করে দুজন একসাথেই বাইরে পারি জমিয়েছিলাম ইংল্যান্ডে। একটা কোম্পানীতে ফিন্যান্সে কাজ করছি। সপ্তাহে ছুটির দিন রবিবার। সুতরাং বাকি ছয়দিন যে যেখানেই থাকিনা কেন, এই দিনটা দুজনে একসাথে কাটাই। আজকেও বেরিয়েছি দুজনে। নেটে দেখেছিলাম রিভার আইল্যান্ডে আমার প্রিয় চেকে একটা শার্ট। সেটাই নিতে এসেছি মূলত। সেল উইক চলছে, তাই শোরুমে একটু ভিড় ছিল। ঠেলেঠুলে পেছন দিকটায় যেয়ে খুঁজছিলাম কমলা আর কালো চেকের শার্টটা। হঠাৎ করেই চোখ পরলো সাদা স্যালোয়ার কামিজের একটি মেয়ের দিকে। পেছন থেকে দেখতে বাঙালি মেয়ের মত লাগছে। কিন্তু মেয়েটার চুলগুল কেমন যেন চেনা। আগে কোথাও দেখেছি মনে হচ্ছে।
মেয়েটি আমার দিকে ঘুরতেই অবাক হয়ে গেলাম। মেয়েটির হাতে আমার পছন্দের সেই শার্ট। আসলে অবাক হওয়ার কারন শার্ট নয়। চুলগুল আমি ঠিকই চিনেছি। নিতি ! নিতি আর আমি একসাথেই পড়তাম। আমি ছিলাম ভার্সিটির সুপারম্যান আর নিতি সাধারন কালো ফ্রেমের চশমা পরা চুপচাপ একটা মেয়ে। গায়ের বর্ন হলদে সাদা আর ছিপছিপে শরীর। চেহারার মাঝে অন্যরকম একটা মাধুর্য। আমি কোনদিনই ওর কাছে বিশেষ পাত্তা পাইনি। দুইবার প্রপোজ করেছি, দুইবারই ভয়ে কেঁদে দিয়েছে। সে কি কান্ড। বাংলা সিনেমার ভিলেনের সামনেও নায়িকা ইজ্জত ভিক্ষা চেয়ে এতখানি কাঁদে না। নিরহ এই মেয়েটাকে জ্বালাতন করতেই আমার কেমন যেন ভালো লাগতো।
আমি সবসময় ওর ঠিক পেছনের চেয়ারের ডানপাশে বসতাম। এতে করে ওকে দেখতে আমার ভালোই সুবিধা হতো। মাঝে মাঝে চিরকুটে প্রেম প্রেম মার্কা কথাবার্তা লিখে ওর টেবিলে রাখতাম। এই মেয়ে আমার সব জ্বালাতন চোখবুজে সহ্য করতো বলেই ওকে আমার অনেক বেশী ভালো লাগতো। আমি যখন ওর দিকে রোমান্টিক দৃষ্টিতে তাকাতাম, আর ভুলে যদি ওর চোখ আমার চোখের দিকে পরতো তাহলে বেচারী ভয়ে পাংশু বর্ণ ধারন করতো। আমার সব রোমান্টিকতা বৃথা, ফেইল্যুর রোমিও।
একবার ওর চুলে চুইংগাম লাগিয়ে দিলাম। সেই গাম ছুটাতে যেয়ে সমস্ত চুল জট পাকিয়ে ফেললো। ভাবলাম এবার নির্ঘাত বিচার যাবে গডফাদার খ্যাত আমাদের ক্লাস মনিটর টিচারের কাছে। নাহ, অবলা মেয়েদের আদর্শ এই মেয়েটি সেবারও চুপচাপ কেঁদে গেলো। আরেকদিন আমি পেছনে বসে আছি। ওর পানির বোতল এসে পরলো আমার পায়ের কাছে। ও যখন বোতল তুলতে হাত দিলো, আমি বলে উঠলাম, " থাক সালাম করতে হবে না, আজকাল হাসব্যান্ডকে ক'জন মেয়ে সালাম করে! আমি এমনিতেই তোমার উপরে সন্তুষ্ট আছি। " লজ্জা ভরা চোখে সেদিন ভয় ছিল না। ঠোঁটের কোনে চাপা হাসির ঝিলিক ছিল।
এসব কারনে আমার মনে হতো এই মেয়ে আমাকে ভালোবাসে বলেই চুপচাপ সব সয়ে যায়। কিন্তু প্রপোজ করলেই বিপদ। এমন এক সমস্যা যে এর প্রতিকার চেয়ে বন্ধুদের কাছে সার্কুলার দিলেও সবগুলা হাসাহাসি করবে। বলবে," মোটা ফ্রেমের চশমা, চশমা খুললে রাতে তোকে চোখে দেখবে তো?" কিন্তু এই সহজ সরল আধাদৃষ্টির মেয়েটিকে যে আমার কত ভালো লাগে সেটা কিভাবে বুঝাবো ওদের?
একদিন ক্লাস থেকে যাওয়ার সময় পেছন থেকে ওর স্যান্ডেলে পা দিয়ে চেপে ধরলাম। বেচারী উস্টা খেয়ে বসে পরলো তারপর ছেঁরা স্যান্ডেল হাতে নিয়ে চুপচাপ খালি পায়ে হাঁটতে লাগলো। ওর এমন সয়ে যাওয়াটাই এক সময় আমার অপরাধবোধ জাগিয়ে তুলতে শুরু করেছিল। সেদিন খালি পায়ে শহরের পিচঢালা পথে ওকে হেঁটে যেতে দেখে নিজের মাঝেই কষ্ট লাগছিলো। আমি ওর পিছু হাটতে লাগলাম। পেছন ফিরে যখন দেখলো আমি ওর পেছন পেছন আসছি ও হাটার গতি বাড়িয়ে দিলো। আমি যখন ২ কিমি/আওয়ারে হাটা শুরু করলাম ও তখন ৪.৫ কিমি/ আওয়ারে দৌড় দিলো। আশেপাশের মানুষ দেখলাম তাকিয়ে আছে, সবার সন্দেহজনক দৃষ্টি। গনধোলাই থেকে বাঁচতে সেদিনের মত ক্ষান্ত দিলাম।
সেদিন ক্লাস শেষে বৃষ্টিতে একা রাস্তায় দাড়িয়েছিলো ও। আমি মোটসাইকেল ঘুরিয়ে যখন ওর সামনে গেলাম তখন মনে হচ্ছিলো আড়াই ইন্চির মোটা ফ্রেম ভেদ করে ওর চোখ বেরিয়ে আসবে।
- তুমি আমাকে এত ভয় পাও কেন ?
আমার প্রশ্নের পরে দেখি এবার চোখ ছলছল করছে। বুঝলাম এই মেয়ের চোখে ঐ মেঘের চেয়ে বেশি জল লোড দেয়া আছে। এমন মেয়ে নিয়ে তো বিশাল বিপদ।
- নিতি! একেবারে কাঁদবে না বলছি। এদিকে তাকাও। স্নেহা বললো তুমি নাকি আমাকে বিড়িখোর গুন্ডা পোলা বলো?
- স্যরি, আমি আর কোনদিন বলবো না।
- বাইকে উঠো।
- না, আমি রিক্সায় যাবো। বাইকে চড়ার অভ্যেস নেই। আমি পরে যাব বাইক থেকে।
এইবার ধমক না দিয়ে পারলাম না। সাদাসিধে বোকা মেয়েদের ধমক দিলে দারুন সুফল পাওয়া যায়। নিতু চুপচাপ উঠে বসলো। এবার সুযগ বুঝে বললাম, " আমাকে ধরে বসো, নইলে সত্যি পরে যাবে কিন্তু।"
গুড়িগুড়ি বৃষ্টিতে নিতি পেছেন থেকে জড়িয়ে আর শহরের পথ চিরে চলতে থাকা দুজন, অন্যরকম একটা অনুভূতির দিন ছিলো সেদিন। ইচ্ছে হচ্ছিলো এই পথে চলতে থাকি অবিরাম। ওকে চিরদিনের জন্য এভাবে কাছে রাখি। ও শুধু আমার হয়ে থাকুক। কিন্তু সব আশা সবার জন্য নয়। আমার জন্যও হয়ত ছিলো না, কারন আধাঘন্টার মাথায় ওদের বাসার কাছাকাছি চলে এসেছি।
এরপর হঠাৎ করেই ওর ক্লাসে আসা বন্ধ হয়ে গেলো। কেউ ঠিক ভাবে কিছু বলতে পারছিলো না। ওর সবথেকে কাছের বান্ধবী স্নেহাও আসছে না যে কিছু একটা খবর নেবে।
একসপ্তাহ পরে স্নেহা ক্লাসে এসে আমাকে খুঁজে বের করলো। আমার হাতে একটা চিরকুট ধরিয়ে দিলো। বললো নিতি নাকি আমাকে দিতে বলেছিলো। খুলে দেখলাম ছোট ছোট অক্ষরে লেখা, " আমিও তোমাকে ভালোবাসি, কিন্তু আমার তোমার সামনে গেলে ভয়ে হাত পা কাঁপে। তাই বলতে পারি না। আমি বাইরে চলে যাচ্ছি। হয়তো আর কোনদিন দেখা হবে না।"
নিতির মামা ওকে নিয়ে গিয়েছিলো তার পছন্দ করা ছেলের সাথে বিয়ে দেয়ার জন্য। স্নেহার কাছে জেনেছিলাম। তারপর কি হয়েছে জানি না, কিন্তু আমার ভেতরে ভেতরে একটা পরিবর্তন এসেছিলো। আমি জ্বালাতন করার মানুষটিকে হারিয়ে একা হয়ে পরি। সব কিছুতে আনন্দ হারিয়ে ফেলি। একসময় " কি জ্বালা দিয়ে গেলা মোরে...... " টাইপের গান শোনা শুরু করি। জীবন চলছিলো। প্রতিরাতে নিতির কথা মনে পরলেও এখন অনেকটা ভুলে গিয়েছিলাম।
ঠিক এই সময়ে নিতি আবার আমার সামনে। তাও আবার আগের থেকে সুন্দর হয়ে গেছে। চোখে সেই কালো ফ্রেমের চশমা নেই, ল্যাসিক করিয়েছে। গালদুটো ভরে গেছে, ছুঁয়ে দিতে ইচ্ছে করে। আর আপাত দৃষ্টিতে দেখতে ইন্ডিয়ান নায়িকাদের ছারিয়ে গেছে। শুনেছি বিয়ের পরে নাকি মেয়েরা সুন্দর হয় বেশি।
- রিক তুমি এখানে ?
- জ্বি, আপনি নিতি না?
- হ্যাঁ আমি নিতি কিন্তু তুমি আমাকে আপনি করে বলছো কেন?
- না মানে শার্টটা কি তোমার হাসব্যান্ডের জন্য নিচ্ছো? ভদ্রলোক কেমন আছেন?
- মানে কি? আমিতো এখনো বিয়ে করিনি। স্নেহাকে বলেছিলাম তোমাকে এটা বলতে। যেন তুমি আমার জন্য অপেক্ষা না করো।যাইহোক, কোন এক গাধার জন্য অপেক্ষা করছিলাম। কিন্তু গাধা পেলেও সেই মনের মত গাধাটাকে পাচ্ছিলাম না। তাই এখনো কুমারী আছি। আর তারজন্যে মাঝে মাঝে ছেলেদের পোষাক দেখি। তাকে কল্পনা করি আরকি।
- তুমি আগে থেকে অনেক স্মার্ট হয়ে গেছো।
- আর তুমি সত্যি সত্যি গাধা হয়ে গেছো।
__________
এর পর থেকে নিতির সাথে নিয়মিত দেখা হতো। আমি অবাক হয়ে ওকে দেখতাম। আমার অত্যাচারে চুপ করে থাকা মেয়েটি এতটা স্মার্ট হয়ে গেছে! এখন আমার ক্ষেত্রে উল্টোটা হয়েছে। নিতির সামনে গেলে আমার কেমন যেন লজ্জা লাগে। কথা বলতে গেলে খেই হারিয়ে ফেলি। কিন্তু নিতি ঠিকই সব বুঝে নেয়।
আমার এই লজ্জায় অতিষ্ট হয়ে একদিন নিতিই আমাকে প্রোপোজ করে ফেললো। আমার চোখ গড়িয়ে অশ্রু আসছিলো। কিন্তু সেটা সেই পুরনো নিতির মতো ভয়ে নয়। আনন্দাশ্রু। আমি সত্যিই আমার ভালোবাসাকে পেলাম।
নিতি আমাকে অনেক বেশি ভালোবাসতো। সেটা বুঝেছি যখন দেখলাম
আমার দেয়া প্রতিটা চিরকুট ও সযত্নে রেখে দিয়েছে। একদিন ও আমাকে জিজ্ঞাসা করেই ফেললো যে, ওর দেয়া সেই চিরকুট কোথায়। আমি কি আর বলতে পারি যে মিমির সাথে রিলেশন হওয়ার পরে সেই চিরকুট ফেলে দিয়েছিলাম! তাছারা আমি দ্বিতীয়বার আর নিতিকে হারাতে চাই না। ওকে ভোলার জন্য মিমির সাথে রিলেশনে গিয়েছিলাম। দুধের স্বাধ কি আর ঘোলে মিটে?
যাইহোক, নিতিকে শুধু এতটুকই বললাম,
" পাঁচ বছর পেরিয়ে গেছে, চিরকুট হারিয়ে গেছে।"
সর্বশেষ এডিট : ২০ শে আগস্ট, ২০১১ রাত ১২:১৯