ছোট বেলা থেকেই দেখে আসছি কুরবানীর ঈদ বাঙালীর জন্য আরেকটি বৈচিত্র্যময় উৎসব হিসেবেই আসে। বাঙালী যেকোন উপলক্ষকেই উৎসবে পরিনত করে (আমিও ব্যতিক্রম না!)। একুশে ফেব্রুয়ারী যেখানে গাম্ভীর্য আর শ্রদ্ধার সাথে পালন করার কথা, সেটাও উৎসব হয়ে যায়! কুরবানী হওয়ার কথা ত্যগের চেতনায়, হয় উৎসবের আমেজে! অবশ্য ঈদ মানেই উৎসব। এক্ষেত্রে ত্যগের উৎসব। তা সে যাই হোক ছোটবেলার মত আনন্দ এখন আর ঈদে পাই না।
কোরবানীর ঈদ শুরু হয় গরু কেনা দিয়ে। ঢাকায় গরু কিনে বাসা পর্যন্ত যেতে যেতে ১৪ জনকে ফিরিস্তি দিতে হয় কত দিয়ে গরু কেনা হল! গরু কেনার পর থেকে ঈদের দিন পর্যন্ত আগে খুব ভাল লাগত। শহরের শিশুরা জ্যন্ত গৃহপালিত পশুপাখি খুব একটা দেখে না ত! এখন এসব বেশ ঝামেলা মনে হয়।
ছোটবেলায় গরু জবাইয়ের সময় সামনেই থাকতাম। কোন অনুভূতি ছিল না। আর এখন বিষয়টা বেশ নিষ্ঠুর মনে হয়। আসলে জবাই করা কোন সুখকর দৃশ্য হতে পারে না। তাই বলে মাংস খাওয়া বাদ দিলে চলবে কেন! বাজারের মাংস কেনার সময় আমরা কিন্তু জবাইয়ের দৃশ্যটা দেখি না! এমনকি আগে মুরগিও বাসায় এনে জবাই করা লাগত। এখন আর লাগে না। উন্নত বিশ্বে স্লটারিং হাউজ ছাড়া জবাই করা যায় না। অবশ্য একদিনের জন্য কোরবানীর এতগুলো পশু, বাংলাদেশের মত গরীব দেশে স্লটারিং হাউজে করা সম্ভব না। তবে অন্তত একটু ঢেকে ঢুকে করতে পারলে ভাল হত। অবশ্য যাদের দৃশ্যটা পছন্দ না, তারা সামনে না থাকলেই হয়!
জবাই দেখি না মানে কিন্তু মাংস কাটাকুটি বাদ থাকে না! কাটাকাটি, ভাগাভাগি, রান্না সবকিছুতেই অংশগ্রহন করি! বিচ্ছিরি লাগে ফুসফুস আর কলিজা কাটতে (কারন ফুসফুসে কিছু পরজীবি থাকে...ইয়াক!)। আবার সবার আগে খাওয়া হয় কলিজাটাই! অনেকে আবার ভূড়ি খেতে খুব পছন্দ করে। আমি আগে খেতাম এবং এখনও খেতে ইচ্ছে করে। কিন্তু সেই একই সমস্যা, ব্যপারটা অরুচিকর!
কোরবানীর ঈদে সবচেয়ে অরুচিকর ব্যপারটা হয় অন্য জায়গায়। মাংস কাটার ঠিক পর পরই। গরীব মানুষ গেইটে এসে ভিড় করে। তাদের হাহাকার দেখলে নিজেই লজ্জা পাই। এই ঘটনা অবশ্য কোরবানী ছাড়াও অন্য সময়ও হয়। যেমন- ঈদুল ফিতরে যাকাতের শাড়ি নিয়ে কামড়া কামড়ি। এসব দেখলে মনে হয় আমরা এখনও সেই তলাবিহীন ঝুড়িই রয়ে গেলাম। পরার্থপরতার অর্থনীতি থেকে আমরা এখনও বের হতে পারলাম না। কেউ লক্ষ্য করেছেন কিনা জানি না, ঢাকায় কিছু গরু কোরবানী হয় পরের দিন। এগুলো লাখ টাকা দামের গরু এবং বেশ বড় সাইজের কিন্তু খাওয়ার জন্য তেমন ভাল না। অর্থাৎ মাংসের পরিমান হিসেবে সস্তা। এগুলো কেনা হয় শুধুমাত্র গরীবদের মধ্যে বিলিয়ে দেয়ার জন্য। এটা অবশ্যই ভাল কাজ। কিন্তু বাঁকা চোখে দেখলে এর মধ্যেও একটা হতাশা লুকিয়ে আছে। মনে পড়ে যায়, আমাদের অর্থনীতির অবস্থা এখনও নাজুক। তাছাড়া গরীবদের জন্য এই ধরনের সস্তা মাংস কেনাটা কেমন যেন নিজেকে আলাদা করে ফেলার মত। মানে ধনী-গরীব আলাদা মানের গরু। তবে প্রোটিনের হিসেবের বিচারে ব্যপারটা ঠিকই আছে। আবার এই মাংস কতটা তারা (গরীব মানুষ) নিজেরা খায় কতটা বিক্রি করে দেয় এটাও চিন্তার বিষয়।
কোরবানীর ঈদে আরও কিছু ছোট খাট ব্যপার খুবই খারাপ লাগে। কার গরু কত বড়, কে জিতল কে ঠকল, কার গরুতে মাংস বেশি হইল, কারটা স্বাদ বেশি হবে, কে কয়টা গরু কোরবানী দিল এই ধরনের আলোচনা মোটামুটি সারাদিনই চলতে থাকে। আর সামনে নির্বাচন থাকলে ত কথাই নাই! আসলে এই ব্যপারগুলো বোধহয় আগের প্রজন্মের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে।
খুজে খুজে খারাপ ব্যপারগুলিই বললাম! ভাবলাম সবাইকে একটা ঈদ মোবারক জানাব, তা আর হল না! খুজে খুজে হতাশার দিকগুলিই দেখছি। সময়টাই বোধহয় এরকম। কম সম্পদ সমৃদ্ধ অনগ্রসর একটা রাষ্ট্রে সম্পদ নিয়ে বৈষম্য থাকবেই। মানুষের মধ্যে হিংসা-বিদ্বেষ, পরশ্রীকাতরতা, সম্পদ নিয়ে কাড়াকাড়ি, মারামারি এসব থাকবেই। বন্টন ঠিকমত হচ্ছে না, হবে না এটাই স্বাভাবিক। তাই বলে অন্যের ভালকে হিংসার চোখে না দেখে নিজের উন্নতির চিন্তা করা উচিৎ। অন্যের খুত না ধরে নিজের খুতগুলো খুজে বের করা উচিৎ। সেটাই ত কোরবানীর আসল লক্ষ্য!
অবশেষে এই বয়সে ঈদের অন্তত চারটা ভাল দিক বলি..
১. ঢাকায় লোডশেডিং হয় না
২. ট্রাফিক জ্যম থাকে না
৩. চাকরি নিয়ে ব্যস্ততা কাটিয়ে পুরানো সব বন্ধুদের সাথে দেখা হয়
৪. নন-স্টপ ভূড়ি ভোজ (যদিও ত্যগের চেতনার সাথে এটার মনে হয় সামন্জস্য নাই! আবার আগামী দেড়-দুই মাস সকাল-বিকাল গরুর মাংস খাইতে হবে ভাবতেই বিরক্ত লাগতেছে!!)
সবাইকে ঈদের শুভেচ্ছা!
ঈদ মোবারক!!
সর্বশেষ এডিট : ১৫ ই নভেম্বর, ২০১০ সকাল ১১:০৯