আমাদের সময়ে চয়নিকা বলে একটা বই ছিল ক্লাস থ্রি ফোরে। সেখানে রিকশা চালকদের সম্পর্কে একটা গল্প ছিল। ৩০ বছর আগের পড়া সেই গল্পটির হয়তো অনেক কিছুই ভুলে গেছি। যতটুকু মনে আছে তাই লিখছি।
বেশ কয়েকজন রিকশাওয়ালা সারাদিন রিকশা চালিয়ে সন্ধ্যা বেলায় একটা চায়ের দোকানে বসে চা খেত এবং সুখ দুঃখের গল্প করতো। ঘুরে ফিরে একই ধরনের কথা প্রায় সবাই বলতো। তারা রিকশা চালায় এবং সামান্য তাদের আয়। সেই আয় থেকে আবার একটা ভাল অংশ রিকশার মালিককে দিতে হতো এবং এরপর যা হাতে থাকতো তাই দিয়ে অনেক কষ্টে সংসার চালাতে হতো। এই দুরাবস্থা থেকে মুক্তি সবাই পেতে চায় কিন্তু এজন্য তো অনেক টাকা লাগবে। এমনকি নিজের রিকশা কিনতে পারলেই বোধহয় সবাই খুশি।
এক সময় তারা নিজেরাই স্থির করে যে প্রতিদিন ১ কাপ চা কম খাবে এবং এভাবে ১ টাকা করে জমাবেন। ৩০-৪০ জন মনে হয় সংখ্যায় ছিলেন। এভাবে প্রতিদিন টাকা জমিয়ে কয়েক সপ্তাহের মধ্যে একটি রিকশা কিনে ফেলে তারা। এখন তাদের একজন ওই রিকশা ভাড়া নেয়। এভাবে তাদের আয় এবার আরও দ্রুত গতিতে জমতে থাকলো এবং পরের রিকশাটি আরও দ্রুত কেনা সম্ভব হল। কারণ এখন তাদের একদিকে ৩০ জনের এক টাকা এবং একটি রিকশা ভাড়া ১৫ টাকা আসা শুরু হল। আর দ্বিতীয় রিকশা আসার পর আয় হল ৬০ টাকা (সবাই এক টাকা করে ৩০ টাকা এবং দুটি রিকশার ভাড়া থেকে ১৫+১৫=৩০ টাকা)। ফলে বুঝতেই পারছেন যে তৃতীয় রিকশা আরও অল্প সময়ের মধ্যে চলে এল।
এভাবে এক বছরের মধ্যে সবার জন্য রিকশা হয়ে গেল। সমিতির জন্য জমি সহ অনেক কিছুই কেনা হল। বড় লোক না হলেও সবার জীবনেই স্বাচ্ছন্দ্য এল। সবার ছেলেমেয়ে এখন স্কুলে যায়। প্রত্যেকের নিজের রিকশা থেকে আয় আসে এবং কাউকে দৈনিক ভাড়া দিতে হয়না। তাই আয় আগের থেকে দিগুন বা তিনগুন হয়ে গেল। নিজের রিকশা থেকে আয়, ভাড়া দিতে হয়না সেই আয়, আবার সমিতির সম্পদ থেকে আয়। আয় বেড়েছে, শান্তি এসেছে এবং কিছুটা সুখও এসেছেন মনে।
এ গল্পটি আমার মনে অনেক দাগ কেটেছিল। তাই ক্লাস ফাইভ-সিক্স থেকেই এমন দল গড়ার স্বপ্ন ছিল কিন্তু কখনোই পারিনি। ই-ক্যাব কোন লাভজনক প্রতিষ্ঠান নয় তাই এখানে ঠিক এ ধরনের সমিতি হবার কথা নয়। তবে গতকাল বেশ কয়েকজন যেভাবে তাদের সমস্যার কথা নিজেদের মধ্যে আলোচনা করেছেন তাতে আমার সেই গল্পের কথা মনে পড়েছে।
আড্ডা শেষে সবাই মিলে ঠিক করা হল যে সবাই আবার সারাদিনের জন্য বসবেন এবং নিজেদের মধ্যে আরও ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তুলে কি করে সবাই উপকৃত হতে পারেন সেই উপায় বের করবেন। ই-ক্যাব সভাপতি হিসেবে আমি কেবল তাদের আলোচনায় সঞ্চালকের ভূমিকা পালন করছি। আজকে জানলাম আমাদের সদস্যদের কেউ কেউ নিজেদের মধ্যে পার্টনারশিপ গড়ে তুলছেন। এটা শুনে আরও ভাল লাগলো।
রিকশা চালকদের গল্প থেকে আমার মনে একটাই শিক্ষা নেবার আছে। একা একা কিছু করা যায় না। কিন্তু ১০০ জন মিললে অনেক কিছুই করা যায় অনেক সহজে। ঘুরে ফিরে আমরাও একই ধরনের গল্প করি নিজেদের মধ্যে- বেশিরভাগ মানুষ অনলাইনে কেনাকাটা বুঝেনা তাই বাজার খুব ছোট, কুরিয়ার নিয়ে সমস্যা, পেমেন্ট নিয়ে সমস্যা, ই-কমার্স নিয়ে প্রচারণা নেই। বিদেশী বিলিয়ন ডলার কোম্পানিগুলো ঘাড়ের কাছে এসে নিঃশ্বাস ফেলছে ইত্যাদি। ১০০ জন এক হলে অনেক বোঝাই হালকা হয়ে যাবে।
লেখাটি ই-ক্যাব গ্রুপে ফেইসবুকে আগে প্রকাশিতঃ Click This Link