: দোস্ত, চল একদিন লালনের আসর বসাই। অনেকদিন লালন খাওয়া হয় না।
: কিন্তু দোস্ত, আমিতো ওগুলো খাইনা।
: আরে একদিন টেস্ট নিয়ে দেখলি আরকি। জীবনে সবকিছুর টেস্ট নেওয়া দরকার আছে।
লালনের (গাজা) আসর বসানোর প্রস্তাবকারী আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের এক বন্ধু। আমার ডিপার্টমেন্টেরই ছাত্র। তবে সবচেয়ে বড় পরিচয় সে ইসলামী ছাত্রশিবিরের ক্যাম্পাস কাপানো এক নেতা। একটি আবাসিক হলের সভাপতিও বটে। একদিন রাতে আমার সামনেই অন্য এক বন্ধুকে এভাবেই লালন খাওয়ার প্রস্তাব করে বসে সভাপতি সাহেব। যদিও অন্য বন্ধুটির অপারগতায় সভাপতি সাহেবের প্রস্তাবটি অকালেই ভেস্তে যায়।
আরেক বন্ধু শিবিরের সচল কর্মী। নামাজ-কালামে তার বিন্দুমাত্র আলস্য নেই। ছেলে হিসেবে একবারে সুনসান। শিরক-বেদআত করেছে বলে মনে হয়না। এমনকি আমাদের ব্যাচের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানগুলোতেও সে অংশ নিত না। ব্যাচের পক্ষ থেকে চাদা চাইলে অপারগতা প্রকাশ করত উচুগলায়। বেদআত বলে কথা। কিন্তু এ কি! হঠাত আর দশটা ছেলের মতোই রাত বারোটা বাজলে হন্তদন্ত হয়ে মোবাইল নিয়ে ছুটে সে। ব্যক্তিগতভাবে সু-সম্পর্ক থাকায় জিজ্ঞেস করতেই আমাকে বিস্তারিত জানায়। ঢাকার লালমাটিয়া কলেজের এক মেয়ের প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছে সে। ব্যাপারটা এখন চূড়ান্ত পর্যায়ে।
একদিন হঠাত করেই উধাও হয়ে যায় ছেলেটা। তার রুমমেটেদের কাছে জানতে পারলাম ঢাকায় গেছে। আমার আর বুঝতে দেরী হয় না।
তিনদিন পর সে ফিরে আসে। তখন ফাল্গুন মাস। কিন্তু সে জ্যাকেট পরে ক্লাসে যাচ্ছে কেন। আমার সন্দেহ হয়। অনেক পীড়াপিড়িতে জানায়, ঘাড়ে একটা দাগ বসেছে। তাই জ্যাকেটের বড় কলার দিয়ে ঢাকার জন্যই এই আয়োজন। দাগটা কিসের বোধকরি সচেতন পাঠক সহজেই অনুধাবন করতে পারছেন। ও অবশ্য আমাকে বিস্তারিতই বলেছিল। কিন্তু এখানে তার অবতারনা করতে আমার রুচিবোধে কিঞ্চিত নাড়া দিল। তাই করলাম না।
আশ্চর্যের বিষয় এই যে, ওই ঘটনার পর কিন্তু বন্ধুটি শিবির ছেড়ে দেয়নি। বরং তার জিহাদী চেতনা ঢেড় বৃদ্ধি পেয়েছিল। ওই ঘটনার পূর্বে সে শিবিরের কর্মী থাকলেও পরবর্তীতে একধাপ প্রমোশন পেয়ে সাথী পদ লাভ করেছিল।
আমার কাছের অনেকগুলি পর্যবেক্ষনের মধ্যে মাত্র দু’টির অবতারনা এখানে করলাম। সবগুলো বর্ণনা করলে পাঠকমনে বিরক্তির উদ্রেক ঘটতে পারে। তাই করলাম না।
ক্যাম্পাসে সাংবাদিকতা করার সুবাদে সব ছাত্র সংগঠনগুলির সাথেই আমাকে ওঠাবসা করতে হতো। সু-সম্পর্ক বজায় রাখাটাও ছিল পেশাগত উত্কর্ষতার একটা। শিবির সভাপতির কাছে ওপরের ঘটনাগুলো সম্পর্কে কৌতুহলের ছলে জানতে চাইলে তিনি প্রায়শই বলেতেন, ওগুলো বিচ্ছিন্ন ঘটনা। আমি আরও উদাহরণ দিলে কিংবা এদের বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি সুকৌশলে কথাটা ঘুরিয়ে নিতেন। অবশ্য তারও এ বিষয়ে যথেষ্ট সুনামের কথা প্রচলিত ছিল। লোকমুখে শুনতাম, তিনিও নাকি ভালো প্রেমপত্র লিখতে পারতেন। একবার এক জুনিয়র মেয়েকে ফুলের তোড়া সমেত প্রেমপত্র পাঠিয়ে হল প্রভোস্টের কাছে ধরাও খেয়েছিলেন। শুধুমাত্র শিবিরের নেতা বলে ব্যাপারটা আন্ডারওয়ার্ল্ডেই সীমাবদ্ধ রয়ে গিয়েছিল।
এতো গেল শিবিরের চারিত্রিক কথাবার্তা। ক্যাম্পাসে আচমকা আরেকটি মৌলবাদী সংগঠনের আবির্ভাব ঘটলো। হিজবুত তাহরীর। তাদের অবস্থাটা দুইদিনের বৈরাগী ভাতেরে কয় অন্ন টাইপের। কর্মী সবেমাত্র ৫-৬ জন। কিন্তু রাক-ঢাক দেখে তা বোঝার কোনো উপায় নেই। এ সংগঠনটির আমদানীকারক আমাদের ব্যাচেরই এক মেধাবী ছাত্র। ইদানিং সে জাকির নায়েকের মত যাকে তাকে যেখানে সেখানে লেকচার দিয়ে বেড়ায়। যে তার লেকচার শুনছে না তাকেই সে শত্রু ভাবে। ইসলামের শত্রু। তার চার-পাচ কর্মীকে বলে দেয় শত্রুদের সাথে ওঠা-বসা না করতে। এমনকি কথা পর্যন্ত বন্ধ রাখার জন্য ফতোয়া নাজিল করে।
তাদের এ ফতোয়ার বিষয়টি আমার জানা ছিল না। আমি তাদের সেকেন্ড ইন কমান্ডকে একদিন এড়িয়ে চলার কারণটা জিজ্ঞেস করি। সে জানায়, যারা ইসলামের পথে আন্দোলন করেনা তাদের সাথে বন্ধুত্ব রাখা হারাম।
কথাটা শুনে আমি আকাশ থেকে পড়ি। মৌলবাদীতার জন্য মানুষের এতটা অধ:পতন হয়!
এই কখোপকথনের মাস দুয়েক পরের ঘটনা। শুনি, অন্য তিন বন্ধুর সাথে ওই সেকেন্ড ইন কমান্ড কক্সবাজার বেড়াতে গিয়েছে। যশোহর থেকে আরও এক বন্ধুসহ তাদের দুই কলেজ বান্ধবী কক্সবাজার বেড়াতে আসবে। এ ঘটনা আমাকে তেমন একটা অবাক করেনি।
কিন্তু অবাক হয়েছিলাম ওরা কক্সবাজার থেকে ফিরে আসার পর। অন্য এক বন্ধুর কল্যাণে কক্সবাজারের ছবিগুলো দেখতে পেয়েছিলাম। সেখানে ওই সেকেন্ড ইন কমান্ডের বেশ কিছু ছবি ছিল। প্রায় প্রতিটি ছবিই বান্ধবীদের সাথে। ভেজা বসনে সমুদ্র সৈকতে অথবা হিমছড়ির ঝড়নায়। অনেকটা আপত্তিকরই বলা চলে।
এ বিষয়ে সেকেন্ড ইন কমান্ডকে আমি নি:সংকোচে প্রশ্ন করেছিলাম। সে কি উত্তর দিয়েছিল এত বছর পর স্মৃতি আওড়াতে পারছি না। তবে সে ক্যাম্পাস জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত যে খেলাফত প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে মত্ত ছিল তা আমার স্মৃতিতে স্পষ্ট ধরা দিচ্ছে।
(চলবে)