বাপস্! যে গরম পড়িয়াছে তাহাতে সম্ভবত হিমালয়ের বরফ গলিয়া এতক্ষণে উহা ন্যাড়া হইয়া গিয়াছে। এমন কি পৃথিবীর তাবত সমুদ্রপৃষ্ঠ বাষ্পীভূত হইয়া যাওয়াটাও বিচিত্র নহে। এই সুতীব্র গরমে চরম ভবঘুরেও নিজ গৃহকোণ হইতে বাহির হয় না। এমন কি যে সকল ভিক্ষুককুল আজীবন চেষ্টা করিয়াও আমার নিকট হইতে কিছু বাগাইতে পারে নাই তবুও চেষ্টার ত্রুটি রাখে নাই তাহারাও আজিকে ক্ষান্ত দিয়াছে। অথচ চৈত্রের এই দাবদাহে আমি হাতপাখা হস্তে নিয়া ঘুরিতেছি। এক্ষণে অনেকেই হয়ত পুলক বোধ করিতেছেন। কল্পনায় আমাকে কোন এক বালিকা বিদ্যালয়ের সামনে দাঁড় করাইয়া দেওয়াটাও বিচিত্র নহে। সত্যকথা বলিতে সেখানে দাঁড়াইয়া থাকিতে পারিলে আমিও দুদন্ড শান্তি পাইতাম, তা সে পাখির বাসার মত চোখ তুলিয়া কেহ আসিয়া বলুক আর নাই বলুক, "এতদিন কোথায় ছিলেন?"। কিন্তু আমার ক্ষেত্রে বিধি সর্বদা কম্যুনিষ্ট অর্থাত বাম। এই মুহুর্তে আমার অবস্থান গাবতলি বাস স্টপে। বিশেষ প্রয়োজনে কুষ্টিয়া দৌড়াইতে হইতেছে। ভাবিয়াছিলাম এই দুর্দান্ত গরমে দুর্গম পথ পাড়ি দিতে চাওয়া হতভাগার দলে বোধ করি আমি একলাই রহিয়াছি। কিন্তি ইকি! বাস স্টপে আসিয়া দেখি লোকে লোকারণ্য। বুঝিলাম বিধি আসলেই বাম দল সাপোর্ট করেন। কেউ সিদ্ধ হবে কেউ হবে না, তা হবে না তা হবে না।
ভিড় ঠেলিয়া বাসে উঠিয়া দেখি বেস কয়েকটা সিট খালি পড়িয়া রহিয়াছে। আসন খালি থাকা সত্বেও কিছু লোক জনের দাঁড়াইয়া থাকিবার হেতু অনুসন্ধান করিতে গিয়া জানিলাম উহারা মফিজ গোত্রীয়। আসনে বসিতে হইলে যে অতিরিক্ত পয়সা গুনিতে হয় তাহা উহারা গুনিবে না। দুঃখে মনে মনে কিছুক্ষণ নিজ ললাট চাপড়াইলাম। আগে জানিলে আমিও দাঁড়াইয়া যাইতাম। সে যাই হোক পয়সা যখন গুনিয়াছি বাছিয়া বাছিয়া ভাল আসনখানা দখল করাটা আমার নৈতিক দায়িত্ব। ঠেলিয়া ঠুলিয়া জানালার পাশে একখানা আসন প্রায় ম্যানেজ করিয়া ফেলিয়াছিলাম, হেন কালে আমার চোখ পড়িল তাহার চোখে, চার চক্ষুর মিলন হইল। তাহার বাঁশরীসম নাক, মেঘ কালো কেশ, সুমিষ্ট কমলার ন্যায় অধর কোন কিছুই অবলোকন করিতে পারিলাম না কারণ তাহার সর্বাঙ্গ বোরকা দিয়া আবৃত। এক্ষণে বুঝিলাম কবি কেন বলিয়াছেন, "একটা বুরকা পরা মেয়ে পাগল করেচে!"। বিশ্বের তাবত মুসলিমের উপর আমার ভারী রাগ হইল। ইহাদের কারণে চৈত্রের এই দাবদাহে বেচারি নিজেকে হিজাবের আবরণে আবৃত করিয়াছে। কি পশ্চাদপদতা! জাগো গো ভগিণী! থুড়ি! এইখানে ভগিনী বলিলে আবার প্রবলেম। দেখিলাম তাহার পাশের আসনখানা খালি রহিয়াছে। মুহুর্তেই সিদ্ধান্ত বদলাইতে বিলম্ব হইল না আমার। হুড়মুড়াইয়া তাহার পাশে গিয়া বসিলাম। এইক্ষণে অনেকেই আমাকে লুল ভাবিতে পারেন। তাহাদের জোর গলায় বলিতে চাই, অসহায় এক নারীর পাশে দাঁড়ানো, নিদেন পক্ষে বসাটা আমাদের নৈতিক দায়িত্ব। তাহার পাশে কোন এক লুল বসিয়া তাহাকে উত্যক্ত করিবে দেশের একজন সচেতন নাগরীক হিসাবে আমি ইহা কিছুতেই সহ্য করিব না। আহা বেচারী গরমে কী কষ্ট পাইতেছে। হাতপাখা খানা হাতে লইয়া তীব্রভাবে বাতাস করা শুরু করিলাম। ভাবখানা নিজেকে বাতাস করিতেছি ছিটেফোঁটা তাহার পানে ছুটিতেছে। কিন্তু এ পথে হইবে না। তাহার সাথে ভাব জমাইতে হইলে আমাকেই পদক্ষেপ নিতে হইবে এবং এসব ক্ষেত্রে পিছপা হওয়াটা আমার স্বভাব নহে। সূতরাং তাহাকে বলিলাম যে প্রয়োজনে তিনি আমার হাতপাখাখানি ধার করিতে পারেন। ছোট একটা ধন্যবাদ দিয়া সে আমার হাত হইতে হাতপাখাখানি প্রায় ছিনিয়া লইল। কিন্তু তাহার ছোট্ট ধন্যবাদখানি আমার কানে চিনিসম সুমিষ্ট ঠেকিল, বুকে শেলসম বিঁধিল। হাতপাখার শোকে কাতর হইলাম না কারণ আমার হৃদয় তখন স্বপনের রঙীন পাখা মেলিয়াছে।
আরিচা ঘাট আসিতে আসিতে তাহার সহিত আমার সখ্যতা তীব্রতর হইল। নিজের পারফর্মেন্সে নিজেই নিজের পিঠ চাপড়াইলাম মনে মনে। ফেরিতে উঠিবার পর সে জানাইল সে তৃষ্ণা বোধ করিতেছে এইক্ষণে কিছু কেক কুকের শ্রাদ্ধ করা যাইতে পারে। শুনিয়া আমি খানিক দমিয়া গেলাম। কবি সাধে বলেন নাই, "ভালবাসা মোরে ভিখারী করছে ...."। আমার মনোভাব বুঝিয়াই কিনা জানি না সে বলিল কেক কুকের ব্যবস্থা তাহার সাথেই রহহিয়ছে। শুনিয়া আমার হৃদয় পুনরায় পুলকিত হইল। কেক অথবা কুক কোন একটার শ্রাদ্ধ করিতে গেলেই তাহার আব্রু খুলিয়া যাইবে, শ্রীমুখ খানি দেখিতে পাইবো এই ভাবিয়া পুলক দ্বিগুন হইল। তাহার হস্ত হইতে আমার হস্তে কোকের বোতলখানি সমাগত হইবার সময় তাহার আলতো স্পর্শ পাইলাম আবারও পুলকিত হইলাম। পুলকিত আমি অগ্র পশ্চাৎ বিবেচনায় না নিয়া কোকের বোতলখানি এক নিঃশ্বাসে নিঃশেষ করিলাম।
ইহার পর গতানুগতিক রাস্তায় চলিতে পারিতো কাহিনী। বালিকার সাথে কথা বলিয়া আমার সেল নাম্বার খানি তাহাকে হস্তগত করিতে পারিতাম। তাহার পর হাতপাখা খানা সমেত তাহাকে বিদায় দিতে পারিতাম। তাহার পর ম্যাসেঞ্জারে তাহার সহিত কথা হইতে পারিতো। ভালবাসা নামক কট্টিন জিনিসটাকে অনুভব করিতে পারিতাম। অতঃপর শুভ বিবাহের কর্ম সারিবার পর ব্লগে আমাদের প্রেম কাহিনী লইয়া পোস্টও আসিতো, কিন্তু হতভাগার কপালে পোড়া আলু ছাড়া আর কিইবা আছে। আমার ঘুম ভাঙিল সাত দিন পর কুষ্টিয়া সরকারী হাসপাতালে।সে পাষাণী আমার হৃদয় ছাড়া আর সমস্ত কিছু লইয়া পলায়ন করিয়াছে।
সর্বশেষ এডিট : ২৮ শে নভেম্বর, ২০১১ রাত ৮:২৬