somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

সমুদ্র জয়ের নেপথ্যের বীরগাঁথা

৩০ শে মার্চ, ২০১২ রাত ১:০০
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

সমুদ্র জয়েূর নেপথ্যে বাংলার যে লড়াকু সৈনিক দিন-রাত এক করে শুধু দেশের জন্য মাতৃভূমির জন্য লড়াই করেছেন তার নাম হলো মো. খুরশেদ আলম।এই সমুদ্র জয়ের পিছনে তাঁর কিছু কথা উল্লেখ করা হলো:
“আমি রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে বলছি না। সত্যিকার অর্থে প্রধানমন্ত্রী, পররাষ্ট্রমন্ত্রী একটি সাহসী সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। তাঁরা যদি সঠিক সময়ে এ সিদ্ধান্ত না নিতেন, তাহলে আজকের এই অর্জন কোনো দিন সম্ভব হতো না। সরকারে আসার মাত্র চার মাসের মধ্যে তাঁরা এই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। আমি পাঁচ মাসের মধ্যে সব কাগজপত্র তৈরি করেছি। ভারত ও মিয়ানমার কাউকে জানতে দিইনি। তারা যদি জানত তাহলে এই আদালত থেকে নিজেদের আগেই সরিয়ে নিত। চীন, অস্ট্রেলিয়াসহ অনেক দেশই এভাবে নিজেদের সরিয়ে নিয়েছে। একবার সরিয়ে নিলে তৃতীয় পক্ষ হিসেবে আমাদের আর কোনো দিন আদালতে যাওয়ার সুযোগ থাকত না। আমরা গোপনীয়তা, বিশেষজ্ঞ আইনজীবীদের সঙ্গে যোগাযোগ, দিনের পর দিন অনেক তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করে এ কাজটি করেছি। কোথাও একটু ভুল হলে সব শেষ হয়ে যেত।“
আইনজীবীগণ:
1. বাংলাদেশের পক্ষে: বাংলাদেশের পক্ষে মামলা পরিচালনা করেন আন্তর্জাতিক সমুদ্র আইন বিশেষজ্ঞ থমাস মেনসাহ । এছাড়াও ছিলেন ইডেনবার্গ ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক এলেন বয়লি ও লন্ডন ইউনিভার্সিটি কলেজের অধ্যাপক ফিলিপস সেন্ডস।
2. মায়ানমারের পক্ষে: মিয়ানমারের পক্ষে মামলা পরিচালনা করেন অধ্যাপক বার্নার্ড এইচ অক্সম্যান।

আদালতে মামলা দায়ের:
1. বাংলাদেশ (ভারতের বিপক্ষে): সালিস ট্রাইব্যুনালে বাংলাদেশ-ভারত সমুদ্রসীমা নির্ধারণী মামলায় বাংলাদেশ তার দাবি-দাওয়াসহ 'মেমোরিয়াল' গত বছরের ৩১ মে ট্রাইব্যুনালের কাছে জমা দেয়।এ বিষয়ে সব লিখিত ও মৌখিক শুনানি শেষে ২০১৪ সালের মাঝামাঝি নাগাদ ওই মামলার রায় পাওয়া যাবে বলে আমরা (বাংলাদেশ) আশা করছি।
2. ভারত (বাংলাদেশের বিপক্ষে): ২০১২ সালের ৩১ জুলাইয়ের মধ্যে ভারত পাল্টা মেমোরিয়াল জমা দেবে।
3. বাংলাদেশ (মায়ানমারের বিপক্ষে): ২০০৯ সালের ৮ অক্টোবর যাবার সিদ্ধান্ত নেয় । ২০০৯ সালের ১৪ ডিসেম্বর ইটলসে মামলা দাখিল করে বাংলাদেশ । ২০১০ সালের ১ জুলাই বাংলাদেশ নিজের পক্ষে সব দালিলিক প্রমাণ আদালতে উপস্থাপন করে । মিয়ানমারের দাবির বিপক্ষে বাংলাদেশ বক্তব্য উপস্থাপন করে ২০১১ সালের ১৫ মার্চ।
4. মায়ানমার (বাংলাদেশের বিপক্ষে): ২০১০ সালের ১ ডিসেম্বর মিয়ানমার তাদের প্রমাণ জমা দেয় । বাংলাদেশের যুক্তির বিপক্ষে মিয়ানমার তাদের বক্তব্য তুলে ধরে ২০১১ সালের ১ জুলাই।



বাংলাদেশের দাবী (ন্যায্যতার ভিত্তিতে) ও প্রাপ্তি: আমাদের তিনটি দাবি ছিল। এগুলো হলো ১২ নটিক্যাল মাইল রাষ্ট্রীয় স্বতন্ত্র সাগর এলাকা (টেরিটোরিয়াল সি), ২০০ নটিক্যাল মাইল নিবিড় অর্থনৈতিক এলাকা (ইইএজড) এবং বর্ধিত মহীসোপান (আউটার কনটিনেন্টাল শেলফ)। বাংলাদেশ তার দাবি অনুযায়ী ১২ নটিক্যাল মাইল রাষ্ট্রীয় স্বতন্ত্র সাগর এলাকা পেয়েছে। সেন্টমার্টিন দ্বীপের ক্ষেত্রেও এটি প্রযোজ্য হবে। বাংলাদেশের ন্যায্যতার ভিত্তিতে দাবী করেছিল ২০০ নটিক্যাল মাইল বা ১ লাখ ৭ হাজার বর্গমাইল সমুদ্র এলাকা। কিন্তু আদালতের রায়ে বাংলাদেশ পেল ১ লাখ ১১ হাজার বর্গমাইল সমুদ্র এলাকা। পাশাপাশি ২০০ নটিক্যাল মাইলের বাইরে আমাদের বর্ধিত মহীসোপানের কথাও বলা হয়েছে। সেখানে একই এলাকায় মিয়ানমারের ইইজেড ও আমাদের বর্ধিত মহীসোপান পড়েছে। ওই এলাকায় মিয়ানমার 'ওয়াটার কলাম'-এর (মাটি থেকে পানি পর্যন্ত) অধিকার পেয়েছে। অন্যদিকে বাংলাদেশ পেয়েছে ওই এলাকার মাটি ও এর তলদেশের সম্পদের অধিকার।"
মহীসোপান নিয়ে বাংলাদেশের দাবী : মহীসোপানে বাংলাদেশের সীমানার দাবি নিয়ে জাতিসংঘে শুনানি গত বছরের আগস্টে অনুষ্ঠিত হয়। এতে সাগরের সীমানা নির্ধারণের সূচনা বিন্দু থেকে ৪৬০ নটিক্যাল মাইল পর্যন্ত এলাকায় বাংলাদেশ তার মালিকানা দাবি করে। বাংলাদেশ আরো দাবি করেছে, 'মহীসোপানে বাংলাদেশের মালিকানা সাগরের ২১ লাখ ৭২ হাজার বর্গকিলোমিটার এলাকার সমান।'
মায়ানমারের দাবী (সমদূরত্ব): সমদূরত্ব পদ্ধতিতে বঙ্গোপসাগরের ১৩০ নটিক্যাল মাইলের মধ্যে বাংলাদেশের অধিকার সীমাবদ্ধ হতো। এবং বাংলাদেশ মহীসোপান এলাকায় প্রবেশ বা এই এলাকায় কোন অধিকার পেত না।
যুক্তিতর্ক:
বাংলাদেশের পক্ষ থেকে: বাংলাদেশ সমতানীতিতে সমুদ্রসীমা নির্ধারণের দাবি জানায়। কারণ, কিন' ভৌগোলিক অবস্থানগত কারণে সমদূরত্ব পদ্ধতিতে সমুদ্রসীমার নির্ধারণ করা হলে বঙ্গোপসাগরের ওপর বাংলাদেশের ন্যায্য অধিকার প্রতিষ্ঠিত হবে না। কেননা দেশের উপকূলীয় রেখা বেশখানিকটা ভেতরের দিকে বেঁকে গেছে, যার জন্য সমদূরত্ব পদ্ধতি অনুসরণ করা হলে বাংলাদেশ মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হবে। ভৌগোলিক অবস্থানের জন্য বাংলাদেশ এ ক্ষেত্রে সমতানীতিতে বিশেষ বিবেচনার দাবি রাখে। এ ছাড়া বঙ্গোপসাগরের তলদেশে যে পলি জমা হয়েছে, তা বাংলাদেশের নদীবাহিত। তাই বঙ্গোপসাগর বাংলাদেশের প্রাকৃতিকভাবে সম্প্রসারিত অঞ্চল। নদীবাহিত পলি ছাড়াও বাংলাদেশ তার দাবির সপক্ষে ভারত ও মিয়ানমারের টেকটনিক প্লেটের অবস্থান, বেঙ্গল ডেল্ট, বেঙ্গল ফেন প্রভৃতি জিওগ্রাফিক্যাল ও জিওমর্ফোলজিক্যাল অবস্থা তুলে ধরে। সমুদ্রসীমার দাবি উত্থাপনের জন্য প্রয়োজনীয় তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহে বাংলাদেশ ২০১০ সালের মার্চে বঙ্গোপসাগরে সাইসমিক সার্ভে চালায়। এ ছাড়া বিভিন্ন সময়ে বঙ্গোপসাগরে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানকারী জাহাজ থেকে পাওয়া তথ্য ও অনেক দেশ থেকে কারিগরি সহায়তা নেয়া হয়। ভৌগোলিক অবস্থানগত কারণে সমদূরত্ব পদ্ধতিতে সমুদ্রসীমা নির্ধারণের বিষয়ে বাংলাদেশ বিশেষ করে ১৯৬৯ সালের আন্তর্জাতিক আদালতে (আইসিজে) নর্থ সি মামলা তুলে ধরে। এতে বাংলাদেশের মতো ভৌগোলিক অবস্থানের জন্য সমদূরত্ব পদ্ধতিতে ডেনমার্ক ও নেদারল্যান্ডসের মাঝে পড়ে জার্মানির সমুদ্রসীমার মারাত্মকভাবে সীমিত হয়ে যায়। এর পরিপ্রেক্ষিতে জার্মানি তার ভৌগোলিক অবস্থানের সাথে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের তুলনা দেয় এবং সমতানীতিতে সমুদ্রসীমা নির্ধারণের দাবি জানায়। আইসিজে জার্মানির দাবির যৌক্তিকতার স্বীকৃতি দিয়ে সমতানীতির ভিত্তিতে প্রতিবেশী দুই দেশের সাথে জার্মানির সমুদ্রসীমা নির্ধারণ করে দিয়েছিল। কেননা সমদূরত্ব পদ্ধতি জার্মানিকে তার ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত করছিল। এ ক্ষেত্রে আমরা বলি, ১৯৬৭ সালে জার্মান আমাদের যুক্তির পক্ষে রায় পেয়ে থাকলে ২০১২ সালে এসে আমরা কেন পাব না? শুধু জার্মানি, নেদারল্যান্ড ও ডেনমার্ক নয়, আমরা গিনি, গিনি বিসাও, শারজাহ, মোনাকো, ব্রুনাইসহ বিভিন্ন দেশের উদাহরণ দিই। এ দেশগুলো আমাদের যুক্তির পক্ষে রায় পেয়েছে। কারণ, তাদের অবস্থান আমাদের মতো ছিল। তাহলে আমরা কেন পাব না?
মায়ানমারের পক্ষ থেকে: মিয়ানমার তার দাবিতে মূলত আনক্লজের ইকুইডিস্টেন্স বা সমদূরত্ব পদ্ধতিতে বাংলাদেশের সাথে সমুদ্রসীমা নিষ্পত্তির যুক্তিতর্ক, তথ্য-উপাত্ত তুলে ধরে। মিয়ানমারের আইনজীবীগণ সমুদ্র আইনবিষয়ক জাতিসঙ্ঘ সনদ (আনক্লজ) ১৯৮২ অনুযায়ী সমদূরত্ব পদ্ধতিতে বাংলাদেশের অধিকার বঙ্গোপসাগরের ১৩০ নটিক্যাল মাইলের মধ্যে সীমাবদ্ধ করে ফেলতে চেয়েছিল।
শুনানি চলে: ২০১১ সালের সেপ্টেম্বর মাসে দুই দফায় শুনানি অনুষ্ঠিত হয়। প্রথম দফায় বাংলাদেশের মৌখিক শুনানি ৮ সেপ্টেম্বর শুরু হয়ে ১৩ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত চলে। আর ১৫ থেকে ২০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত মিয়ানমারের বক্তব্য শোনেন ট্রাইব্যুনাল। ২১ থেকে ২২ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত দ্বিতীয় দফায় আবারও বাংলাদেশ তার যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করে। মিয়ানমার ২৪ ও ২৫ সেপ্টেম্বর দ্বিতীয় দফায় তার বক্তব্য তুলে ধরে। যুক্তিতর্ক ও শুনানির ভিত্তিতে গতকাল বুধবার ইটলস রায় ঘোষণা করে।
রায় প্রদান: জার্মানির হামবুর্গে অবস্থিত ইটলস বাংলাদেশ বনাম মিয়ানমার মামলায় হোসে লুইস জেসাসের সভাপতিত্বে বিচারক ছিলেন ২৩ জন। ২০১২ সালের ১৫ মার্চ ( বুধবার) বাংলাদেশের পক্ষে রায় দিয়েছেন। এই মামলায় ভোটা ভোটিতে ২১-১ ভোটে বাংলাদেশ জয় লাভ করে।স্বীকৃত ১৫১ পৃষ্ঠার রায়টি ইটলসের সভাপতি জোসে লুই জেসাস পড়ে শোনান।

যেভাবে আন্তর্জাতিক আদালতে যাওয়া :
২০০৯ সালের ৮ সেপ্টেম্বর ভারত ও মিয়ানমারের সঙ্গে যে বিরোধ রয়েছে তা নিষ্পত্তির জন্য জাতিসংঘের সালিশ আদালতে নালিশ জানানোর সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে বাংলাদেশ। ঐ দিন দুপুরে ঢাকায় তৎকালীন ভারতের হাইকমিশনার পিনাক রঞ্জন চক্রবর্তী ও মিয়ানমারের রাষ্ট্রদূত ফায়ে থান উ'কে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে ডেকে এনে তাদের কাছে আরবিটারি ট্রাইব্যুনালে (সালিশ আদালত) যাওয়ার নোটিফিকেশন হস্তান্তর করেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডা. দীপু মনি।
বাংলাদেশ জাতিসংঘ সালিশ আদালতে যাওয়ার ঘোষণা দেওয়ার পর মিয়ানমার দ্বিপক্ষীয় আলোচনায় আগ্রহ দেখায়। আলোচনার এক পর্যায়ে মিয়ানমারকে বেশ ইতিবাচক মনে হওয়ায় উভয় দেশ সমুদ্রসীমা নির্ধারণের বিষয়টি জাতিসংঘ সালিশ আদালত থেকে সরিয়ে এনে জাতিসংঘের সমুদ্র আইন বিষয়ক আন্তর্জাতিক আদালত ইটলসের কাছে হস্তান্তর করে। ইটলসের বিচার প্রক্রিয়ায় বিরোধের সঙ্গে জড়িত কোনো পক্ষের অর্থ ব্যয় করতে হয় না। মিয়ানমার ইন্টারন্যাশনাল ট্রাইব্যুনাল ফর ল' অব দ্য সিতে যেতে চায়। বাংলাদেশও এতে সম্মত হয়। ভারতকেও আসতে বলা হয়। জার্মানি, ডেনমার্ক ও নেদারল্যান্ডস যেভাবে সমস্যার সমাধান করেছিল, সেভাবে তিনটি দেশ একযোগে সমুদ্রসীমা নিষ্পত্তি করার চিন্তাভাবনা করে। ভারত তাতে রাজি হয়নি। এ জন্য আদালত হয়ে যায় দুটো। মিয়ানমারের সঙ্গে হলো ট্রাইব্যুনাল আর ভারতের সঙ্গে থেকে গেল হেগের পারমান্যান্ট কোর্ট অব আরবিট্রেশন।

পেছনের কথা :
১৯৭৪ সালে বঙ্গবন্ধুর সরকার এ বিষয়ে সর্ব প্রথম সংসদে টেরিটরিয়াল ওয়াটার ও মেরিটাইম জোনস অ্যাক্ট পাস করে। তখন ভারত ও মিয়ানমার বিশেষ করে বাংলাদেশের ঘোষিত বেইজ লাইনের বিষয়ে প্রতিবাদ করে। ১৯৭৪ সালেই মিয়ানমারের সঙ্গে আলোচনা হয়। এতে কিছু অগ্রগতি ঘটে। ৭৫-এর পর ১৯৮২ সালের ১০ ডিসেম্বর তৎকালীন সরকার বর্তমান আইন স্বাক্ষরিত হয়। স্বাক্ষরের পর আর অনুস্বাক্ষর করা হয়নি। ২০০১ সালে বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার তাদের শেষ মন্ত্রিসভা বৈঠকে ১২ জুলাই অনুস্বাক্ষরের সিদ্ধান্ত নেয়। অনুস্বাক্ষর এই জন্য জরুরি যে, ২০০ মাইলের বাইরে আমরা মহীসোপান দাবি করতে চাই। ২০০ মাইলের বেশি দাবি করতে চাইলে, অনুস্বাক্ষরের ১০ বছরের মধ্যে তথ্য-উপাত্ত দিয়ে জাতিসংঘের কাছে দাবি উপস্থাপন করতে হয়। দাবি উপস্থাপনের শেষ সময় ছিল ২০১১ সালের ২৬ আগস্ট। বিশেষ দুটি জরিপ ছাড়া এই দাবি উপস্থাপন করা সম্ভব ছিল না। এরপর নতুন করে আলোচনা শুরু হয় ২০০৮ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় এসে সে আলোচনার ধারাবাহিকতা বজায় রাখে। মো. খুরশেদ আলম ২০০৯ সালের এপ্রিল মাসে নিয়োগ পাওয়ার পর সর্ব প্রথম জরিপ করার জন্য চেষ্টা করে। তাঁর ভাষ্যমতে, সরকারের উচ্চপর্যায় পর্যন্ত আমরা বলি, জরিপ ছাড়া দাবি উপস্থাপন করলে এ থেকে কোনো ফল পাওয়া যাবে না। তিন হাজার কিলোমিটার জরিপ করার জন্য সরকার আমাদের ৮০ কোটি টাকা দিয়েছিল। কিন্তু আমরা ২৫ কোটি টাকা দিয়ে জরিপটি শেষ করেছি। আইনে আছে বেজ লাইন থেকে ৩৫০ কিলেমিটার পর্যন্ত দাবি করা যায়। কিন্তু আমাদের বেজ লাইনে সমস্যা থাকায় অন্য একটি পদ্ধতিতে আরও বেশি দাবি করি। সেটি হলো, সমুদ্রের দুই হাজার ৫০০ মিটার গভীরতা থেকে ১০০ কিলোমিটার পর্যন্ত দাবি করা যায়। কিন্তু এটি করার জন্য আমাদের জরিপ করার জাহাজ ছিল না। ১৯৮০ সাল থেকে সব রকম চেষ্টা করার পরও নৌবাহিনীর সঙ্গে একটি জরিপ-জাহাজ যুক্ত করা যায়নি। অবশেষে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশ নৌবাহিনীকে একটি জরিপ-জাহাজ কেনার অনুমতি দেন। ২০১০ সালের সেপ্টেম্বর মাসে জাহাজটি বাংলাদেশে আসে। অনেক সমস্যা থাকা সত্ত্বেও দ্রুততম সময়ের মধ্যে দুই হাজার ৫০০ মিটার জরিপ করা হয়। এ জন্য আমাদের আরও ১০০ কিলোমিটার বেশি দাবি করার সুযোগ তৈরি হয়।
তথ্য-উপাত্ত দিয়ে ২০১১ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি ৩৮০ থেকে ৪৬০ নটিক্যাল মাইল পর্যন্ত অর্থাৎ ২৫০ মাইলের বেশি আমরা মহীসোপানের দাবি উপস্থাপন করি। অথচ মিয়ানমার পুরো অঞ্চল দাবি করে নথিপত্র জমা দিয়েছে ২০০৮ সালের ১৬ ডিসেম্বর এবং ভারত জমা দেয় ২০০৯ সালের ১১ মে। ২০১০ সালে যদি আমরা এ কাজটি না করতে পারতাম, তাহলে আমাদের আজকের এই অর্জন কোনোভাবেই সম্ভব হতো না। ২০০৯ সালে ভারত মিয়ানমারের জন্য মহীসোপানের কিছু অংশ রাখে, বাংলাদেশের জন্য কোনো অংশ না রেখে পুরো মহীসোপানের দাবি উপস্থাপন করে।

আমাদের অর্জন:
1. উপকূল থেকে বিশেষ অর্থনৈতিক জোন এবং মহীসোপানসহ মোট ৪৬০ মাইল পর্যন্ত আমাদের অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। ২০০ মাইল পর্যন্ত আমাদের বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল। এ জায়গাটি আমরা আমাদের ইচ্ছামতো ব্যবহার করতে পারব। অবশিষ্ট ২৬০ মাইল ব্যবহারের জন্য আন্তর্জাতিক বিধিবিধান রয়েছে। এই ২৬০ মাইল মহীসোপান আমরা একচেটিয়াভাবে ব্যবহার করতে পারব না। ধারা ৮২-তে বলা আছে, মহীসোপান ব্যবহার করতে হলে একটি অংশ দিতে হবে। এখান থেকে যে সম্পদ আহরিত হবে, আন্তর্জাতিক কর্তৃপক্ষকে পাঁচ বছর করে ১২ বছর যাবৎ কিছু কিছু দিতে হবে। ১২ বছর পর ৭ শতাংশ হারে নিয়মিতভাবে দিতে হবে। আমি মনে করি, এই রায়ের ফলে একটি নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হয়েছে। এই রায়ের পর বাংলাদেশ, ভারত, মিয়ানমার কোনো দেশই একচেটিয়াভাবে বঙ্গোপসাগরের কোনো অংশ দাবি করতে পারবে না। নেদারল্যান্ডসের দি হেগে আন্তর্জাতিক সালিসি আদালতে এ বিষয়টি উঠবে।
2. ওশানোগ্রাফি ও ম্যানেজমেন্ট অব দ্য সি নামে সমুদ্র-বিষয়ক দুটো বিশেষ বিষয় আছে। খুব দুঃখের সঙ্গে বলতে হয়, বাংলাদেশের কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে এটি পড়ানো হয় না। কিন্তু আশার বাণী হলো, ওশানোগ্রাফি বিষয় নিয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও শিক্ষামন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনা হয়েছে। আমরা ইতিমধ্যে এ বিষয়টি পড়ানোর জন্য বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে চিঠি দিয়েছি। ঢাকা ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় পড়াতে রাজি হয়েছে। সিনেটের অনুমোদন পেলে আগামী শিক্ষাবর্ষ থেকে এ দুটি বিশ্ববিদ্যালয়ে ওশানোগ্রাফি বিষয়টি পড়ানো হবে। ওশানোগ্রাফি পড়াটা অত্যন্ত জরুরি। কারণ, সাগরে শুধু তেল-গ্যাস ও মাছ ছাড়া অনেক সম্পদ আছে, যা আমাদের দেশের মানুষ জানে না। যেমন—সালফাইট, কপার, ম্যাঙ্গানিজ, অ্যালুমিনিয়াম, নিকেল, কোবাল্ট ইত্যাদি মূল্যবান সম্পদ সাগরে পাওয়া যেতে পারে।
3. এই রায়ের ফলে ৩৮ বছরের ঝুলে থাকা সমস্যার সমাধান হলো। ফলে আমাদের সম্ভাবনা ও করণীয় জায়গাটি আরও অনেক বেশি বিস্তৃত হলো। আমাদের বিশাল সমুদ্রসৈকত রয়েছে। এর আয়তন আরও বৃদ্ধি পাবে। তেল-গ্যাসসহ সমুদ্রের বিভিন্ন সম্পদ আহরণ, সমুদ্রসৈকতসহ সমুদ্রের নানা ধরনের জরিপকাজের জন্য প্রযুক্তিনির্ভর মানবসম্পদ গড়ে তুলতে হবে।

উপসংহার:
আমরা ১৩০ মাইলের বাইরে আরও ২০০ মাইল গভীর সমুদ্রে যাওয়ার সুযোগ পেলাম। আমাদের ২০০ মাইল গভীর সমুদ্রে যেতে হলে মিয়ানমারের ইইজেড পার হয়ে যেতে হয়। এক দেশের ইইজেড অতিক্রম করে অন্য দেশের গভীর সমুদ্রে যাওয়ার নজির বিশ্বে একটিও নেই। ২০০ মাইল মহীসোপানের আমাদের দাবি আদালত এখানেই বন্ধ করে দিতে পারতেন। কিন্তু আদালত সেটা করেননি। কেন যেন সবকিছু আমাদের পক্ষে ছিল। মিয়ানমারের আইনজীবীরা আরও একটি শক্ত যুক্তি উপস্থাপন করলেন। তাঁরা বললেন, বাংলাদেশ জাতিসংঘে সমুদ্রসীমার দাবি তুলেছে। সে দাবিতে তারা মহীসোপানের কথা বলেনি। তাহলে কেন এখন তাদের মহীসোপানের দাবি গ্রহণ করা হবে। আমাদের ১৩০ মাইল নৌসীমা নির্ধারণ হয়ে গেছে। ধারা ৭৬-৭৮-এ বলা আছে, একবার নৌসীমা নির্ধারণের পর আর কোনো দাবি গ্রহণযোগ্য নয়। আরও একটি উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো, আজ পর্যন্ত কোনো আদালত মহীসোপানের বিভাজন করেননি। কানাডা ও ফ্রান্সের একটি মামলায় মহীসোপানের দাবি আদালত গ্রহণ করেননি।
এত কিছুর পরও আমরা আমাদের দাবির পক্ষে অনড় থাকি। এ ক্ষেত্রে আদালতকে আমরা রবীন্দ্রনাথের একটি কবিতার প্রসঙ্গ টেনে বলি, মহামান্য আদালত, বিধাতার সময়ের কোনো শেষ নেই। তার হাতে সময় অনন্ত। তার কাছে রাত-দিন বলে কিছু নেই। কিন্তু মানুষের সময় সংক্ষিপ্ত। তার রাত-দিন হয়, তার মৃত্যু হয়। মহামান্য আদালত, আপনারা যদি আমাদের সমাধান না দেন, তাহলে আমরা কার কাছে যাব? কে আমাদের কথা শুনবে? কে আমাদের সমাধান দেবে? আপনারা সমাধান না দিলে তিন দেশের মধ্যে জীবনভর বিরোধ থেকে যাবে। তখন আদালত আমাদের যুক্তিকে যুক্তিযুক্ত মনে করে বিষয়টি সমাধানের উদ্যোগ নেন। সবশেষে আমি দেশের মানুষকে বলব, সমুদ্রসীমা জয় নিয়ে কোনো অপব্যাখ্যা দেওয়ার চেষ্টা করবেন না। সুযোগ ও সম্ভাবনাকে কাজে লাগানোর জন্য সবাই ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাজ করে যাব।
৫টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ফখরুল সাহেব দেশটাকে বাঁচান।

লিখেছেন আহা রুবন, ০১ লা নভেম্বর, ২০২৪ রাত ৯:৫০





ফখরুল সাহেব দেশটাকে বাঁচান। আমরা দিন দিন কোথায় যাচ্ছি কিছু বুঝে উঠতে পারছি না। আপনার দলের লোকজন চাঁদাবাজি-দখলবাজি নিয়ে তো মহাব্যস্ত! সে পুরাতন কথা। কিন্তু নিজেদের মধ্যে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ হচ্ছে।... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। প্রধান উপদেষ্টাকে সাবেক মন্ত্রীর স্ত্রীর খোলা চিঠি!

লিখেছেন শাহ আজিজ, ০১ লা নভেম্বর, ২০২৪ রাত ১০:০৩




সাবেক গৃহায়ণ ও গণপূর্তমন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেনকে মুক্তি দিতে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে খোলা চিঠি দিয়েছেন মোশাররফ হোসেনের স্ত্রী আয়েশা সুলতানা। মঙ্গলবার (২৯... ...বাকিটুকু পড়ুন

কেমন হবে জাতীয় পার্টির মহাসমাবেশ ?

লিখেছেন শিশির খান ১৪, ০১ লা নভেম্বর, ২০২৪ রাত ১০:৫৬


জাতীয় পার্টির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে বিক্ষুব্দ ছাত্র জনতা আগুন দিয়েছে তাতে বুড়ো গরু গুলোর মন খারাপ।বুড়ো গরু হচ্ছে তারা যারা এখনো গণমাধ্যমে ইনিয়ে বিনিয়ে স্বৈরাচারের পক্ষে কথা বলে ,ছাত্রলীগ নিষিদ্ধ হওয়াতে... ...বাকিটুকু পড়ুন

দ্বীনদার জীবন সঙ্গিনী

লিখেছেন সামিউল ইসলাম বাবু, ০২ রা নভেম্বর, ২০২৪ রাত ১২:১৩

ফিতনার এই জামানায়,
দ্বীনদার জীবন সঙ্গিনী খুব প্রয়োজন ..! (পর্ব- ৭৭)

সময়টা যাচ্ছে বেশ কঠিন, নানান রকম ফেতনার জালে ছেয়ে আছে পুরো পৃথিবী। এমন পরিস্থিতিতে নিজেকে গুনাহ মুক্ত রাখা অনেকটাই হাত... ...বাকিটুকু পড়ুন

জাতির জনক কে? একক পরিচয় বনাম বহুত্বের বাস্তবতা

লিখেছেন মুনতাসির, ০২ রা নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ৮:২৪

বাঙালি জাতির জনক কে, এই প্রশ্নটি শুনতে সোজা হলেও এর উত্তর ভীষণ জটিল। বাংলাদেশে জাতির জনক ধারণাটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ, যেখানে একজন ব্যক্তিত্বকে জাতির প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে মর্যাদা দেওয়া হয়। তবে পশ্চিমবঙ্গের... ...বাকিটুকু পড়ুন

×