[Khona] খনা, জনভাষ্যে মিশে থাকা আমাদের লোকভাষ্যকার…(শেষ পর্ব)|-(রিপোস্ট সংরক্ষণ)
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
Tweet
[আগের পর্ব এখানে]
০৫.
কিছু কিছু বচনকে সাধারণ জনেরা খুব সহজে এক ডাকেই খনার বচন হিসেবে চিহ্ণিত করে ফেলেন। কেননা বচনগুলোর গঠনরীতির মধ্যেই খনা নামটি উৎকীর্ণ থাকে। যেমন-
(ক)
‘খনা বলে শুন কৃষকগণ/ হাল লয়ে মাঠে বেরুবে যখন/ শুভ দেখে করবে যাত্রা/ না শুনে কানে অশুভ বার্তা।/ ক্ষেতে গিয়ে কর দিক নিরূপণ/ পূর্ব দিক হতে হাল চালন/ নাহিক সংশয় হবে ফলন।’
(খ)
‘খনা বলে শুনে যাও,/ নারিকেল মূলে চিটা দাও।/ গাছ হয় তাজা মোটা,/ তাড়াতাড়ি ধরে গোটা।’
(গ)
‘পূর্ণিমা অমাবস্যায় যে ধরে হাল,/ তার দুঃখ হয় চিরকাল।/ তার বলদের হয় বাত,/ তার ঘরে না থাকে ভাত।/ খনা বলে আমার বাণী,/ যে চষে তার হবে জানি।’
(ঘ)
‘খনা বলে চাষার পো,/ শরতের শেষে সরিষা রো।’
(ঙ)
‘বৎসরের প্রথম ঈষাণে বয়,/ সে বৎসর বর্ষা হবে খনা কয়।’
(চ)
‘উঠান ভরা লাউ শসা,/ খনা বলে লক্ষ্মীর দশা।’
(ছ)
‘খনা ডাকিয়া কন,/ রোদে ধান ছায়ায় পান।’
(জ)
‘ডাক দিয়ে বলে মিহিরের স্ত্রী, শোন পতির পিতা,/ ভাদ্র মাসে জলের মধ্যে নড়েন বসুমাতা।/ রাজ্য নাশে, গো নাশে, হয় অগাধ বান,/ হাটে কাটা গৃহী ফেরে কিনতে না পান ধান।’
(ঝ)
‘ষোল চাষে মূলা, তার অর্ধেক তুলা,/ তার অর্ধেক ধান, বিনা চাষে পান।/ খনার বচন, মিথ্যা হয় না কদাচন।’
(ঞ)
‘মাঘ মাসে বর্ষে দেবা,/ রাজায় ছাড়ে প্রজার সেবা।/ খনার বাণী,/ মিথ্যা না হয় জানি।’
(ট)
‘ধানের গাছে শামুক পা,/ বন বিড়ালী করে রা।/ গাছে গাছে আগুন জ্বলে,/ বৃষ্টি হবে খনায় বলে।’
(ঠ)
‘কচু বনে ছড়ালে ছাই,/ খনা বলে তার সংখ্যা নাই।’
(ড)
‘যে গুটিকাপাত হয় সাগরের তীরেতে,/ সর্বদা মঙ্গল হয় কহে জ্যোতিষেতে।/ নানা শস্যে পরিপূর্ণ বসুন্ধরা হয়,/ খনা কহে মিহিরকে, নাহিক সংশয়।’
[খনার বচন/ নারীগ্রন্থ প্রবর্তনা/ ঢাকা/ পঞ্চম সংস্করণ ২০০৭]
বাক্যের গাথুনিতেই যেহেতু খনা শব্দটি জুড়ে দেয়া হয়েছে, ফলে এগুলোকে যে কেউ খনার বচন বলতেই পারেন। তাই বলে এটা প্রমাণসিদ্ধ হয়ে যায় না যে বিক্রমাদিত্যের রাজসভায় দশম রত্ন হিসেবে একমাত্র খনা নাম্নী কোন বিদূষী জ্যোতিষশাস্ত্রী রমণীর মুখনিঃসৃত বাণী এগুলো। এক্ষেত্রে নির্ভরযোগ্য ইতিহাসবেত্তাদের এদিকে মনোযোগ আকর্ষিত হওয়াটাও জরুরি বৈকি।
সুবল চন্দ্র মিত্রের ‘সরল বাঙ্গালা অভিধান’ (১৯২৯)-এর তথ্য অনুসরণে, মহাকবি কালিদাসের সংস্কৃত গ্রন্থ ‘জ্যোতির্বিদ্যাভরণ’-এ মৌর্য বংশের গুপ্তসম্রাট মহারাজা দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তের (যিনি বিক্রমাদিত্য নামে খ্যাত) নবরত্ন সভার নবরত্নদের নাম পাওয়া যায় এভাবে-
“ধন্বন্তরি-ক্ষপণকামরসিংহ-শঙ্কু-বেতালভট্ট-ঘটকর্পর-কালিদাসাঃ খ্যাতোবরাহমিহিরোনৃপতেঃ সভায়ং রত্নানি বৈ বররুচির্ণব বিক্রমস্য।”
অর্থাৎ, নৃপতি বিক্রমের সভায় যে নয়জন রত্ন-
(১) ধন্বন্তরি (২) ক্ষপণক (৩) অমরসিংহ (৪) শঙ্কু (৫) বেতালভট্ট (৬) ঘটকর্পর (৭) কালিদাস (৮) বরাহমিহির (৯) বররুচি।
কিংবদন্তীয় লোককাহিনী অনুযায়ী অসম্ভব বিদূষী জ্যোতিষ রমণী হিসেবে খনা যেভাবে রূপায়িত, প্রকৃতই যদি এর কোন ইতিহাসনিষ্ঠতা থাকতো, তাহলে সমকালীন উল্লেখযোগ্য ঘটনা হিসেবে কালিদাসের লেখনিতে খনা নামের উপস্থিতি কি অত্যন্ত স্বাভাবিক ছিলো না ? কিন্তু কালিদাসের কোথাও খনার অবস্থিতি রয়েছে এরকম তথ্য জানা নেই।
মহাকবি বেদব্যাস রচিত এযাবৎ প্রাচীনতম মহাকাব্য মহাভারতের পৌরাণিক চরিত্র শ্রীকৃষ্ণের মুখনিঃসৃত উপদেশবাণী হিসেবে শ্রীমদ্ভাগবত গীতা ব্যবহারিক মূল্য বিবেচনায় নির্দিষ্ট একটি ধর্মগোষ্ঠির কাছে ধর্মগ্রন্থের মর্যাদায় অধিষ্ঠিত। এখানে ইতিহাসনিষ্ঠতার বদলে ধর্মভীরু একটি জনগোষ্ঠির কিংবদন্তীতুল্য অলৌকিকতায় বিশ্বাসেরই প্রাধান্য দেখতে পাই আমরা। তবে লিপিবদ্ধ ও বহুলচর্চিত সাহিত্য হিসেবে গীতায় যেমন শ্রীকৃষ্ণের মুখনিঃসৃত বাণীরূপের এদিক ওদিক বা সংযোজন-বিয়োজনের কোন সুযোগ সাধারণভাবে নেই, লোকায়ত কিংবদন্তীয় চরিত্র খনা’র বিষয়টা মনে হয় ঠিক তার উল্টো হওয়াটাই দারুণভাবে সম্ভব। আর তাই কৃষিসম্পৃক্ত প্রাচীন সমাজে আমাদের বহু অখ্যাত লোক-কবিদের সৃজনশীল মেধায় উপরোক্ত ধরনের এরকম খনার বচন তৈরি হওয়াটা অসম্ভব বা বিচিত্র কিছু নয়। ফলে আমাদেরকে আবারো সেই একই জায়গায় ঘুরপাক খেতে হচ্ছে- খনার বচন আসলে কী ?
লোক-সংস্কৃতির চিরায়ত ধারায় এমন কিছু গীত-রীতির কথা আমরা জানি যা বিভিন্ন অঞ্চলের নিজস্ব ঐতিহ্য হিসেবে চিহ্ণিত হয়ে থাকে। যেমন জারি, সারি, ধামাল, গম্ভিরা, ভাওয়াইয়া ইত্যাদি। উদাহরণ হিসেবে রাজশাহী অঞ্চলের গম্ভিরার কথাই ধরি। নাম না জানা বিভিন্ন গীতিকারের নির্দিষ্ট রীতি ও সুরে লেখা গীতের লোকায়ত সমাহার এই গম্ভিরার ধরনে আজকাল অনেক আধুনিক কবি ও গীতিকারের লেখা গানও গম্ভিরার সুরে অনেক শিল্পীরা গেয়ে থাকেন। এগুলোকে আমরা গম্ভিরাই বলে থাকি। রংপুর অঞ্চলের ভাওয়াইয়া বা সিলেট অঞ্চলের ধামাল গানের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। রচয়িতার নাম জানা থাকলে গীতিকার হিসেবে তাঁর নাম চলে আসে, নইলে বলা হয় সংগৃহিত; অর্থাৎ লোকায়ত উৎস। সেই লোকায়ত উৎসটা যে কোন অচেনা একক রচয়িতাই হবেন তা কিন্তু নয়। খনার বচনের ক্ষেত্রেও এমনটা হওয়া কি অসম্ভব খুব ? খনার বচনকে এরকম সুনির্দিষ্ট একটা প্রবচন রীতি হিসেবে কল্পনা করাটা কি খুব কষ্টকর ?
০৬.
খনার বচন হিসেবে পরিচিত বা পরিবেশিত প্রবচনগুলোর উৎস প্রমাণীত বা অপ্রমাণীত যা-ই হোক, এগুলোর একটা ভাব-রীতি বা ধরণ ইতোমধ্যে চিহ্ণিত হয়ে আছে যে, “খনার বচনে আছে কৃষিকাজের বিবিধ রীতি-পদ্ধতি ও নিয়ম-নির্দেশ। হাল, চাষ, বলদ, ভূমি, বীজ, ফলন, বৃষ্টি, বন্যা, শিলা, ঝঞ্ঝা, মাস, ঋতু প্রভৃতি সম্মন্ধে জ্যোতিষী ব্যাখ্যা এগুলোর মধ্যে পাওয়া যায়। বৃষ্টি ও আবহাওয়া সম্পর্কে রচিত বচনে সাধারণত বৃষ্টি, বন্যা, খরা, সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বাণী থাকে।… এই বর্ষা বৃষ্টি হলে কৃষক চাষ করবে, বীজ বুনবে, চারা রোপণ করবে, ফসল ফলাবে। বচনগুলো বাংলার ‘কৃষিদর্শন’।” …[পৃ.১৭৫, ওয়াকিল আহমদ/ লোককলা প্রবন্ধাবলি/ গতিধারা, ফেব্রুয়ারি ২০০১]
এ পর্যায়ে এসে তাহলে এ প্রশ্ন আসাটা কি খুব অস্বাভাবিক যে, এই বচনগুলোর নাম আবহাওয়া বা কৃষি বচন না হয়ে খনার বচন হলো কেন ? খনার বচন তো আসলে আবহাওয়া বা কৃষি বচনই। তবু তাকে কেন খনার বচন বলা হয় এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে আমরা কি আপাতভাবে কয়েকটি সম্ভাবনা বিবেচনায় নিতে পারি ?
দার্শনিক মিল বলতেন- নাথিং হ্যাপেনস উইদাউট অ্যা কজ। প্রতিটা ঘটনার পেছনেই একটি কারণ রয়েছে। সংঘটিত কোন ঘটনার কার্য-কারণ খোঁজা মানুষের আদিমতম কৌতুহলেরই অংশ। অজানাকে জানা বা জ্ঞানন্বেষণের এই আদিম প্রবণতার ধারাবাহিকতাই মূলত মানুষের চিরায়ত সমকালীনতা। হাজার বছর আগের বা আজকের অবস্থানে মৌলিক কোন তফাৎ নেই, মাত্রাগত ভিন্নতাটুকু ছাড়া। আর এই মাত্রাগত অবস্থাটা হলো মানব প্রজাতি কর্তৃক জাগতিক রহস্য উন্মোচন বা জ্ঞান বিকাশের তুলনামূলক অবস্থান। মানুষের জ্ঞানের জগতে সূর্য পৃথিবীর চারদিকে ঘোরার কালের সমকালীনতায় পৌঁছা এবং সেখান থেকে পৃথিবী সূর্যের চারদিকে ঘোরার কালের সমকালীনতা পর্যন্ত হেঁটে আসতে মানব সভ্যতার মাত্রাগত অবস্থানের যে তুলনামূলক পরিবর্তন সাধিত হয়ে এসেছে, এরই ধারাবাহিকতায় কত ভাঙাগড়া কত পট পরিবর্তন ঘটে গেছে মানব সভ্যতায়। এগুলোই হয়তো ইতিহাসের নুড়ি-পাথর। এই কার্য-কারণ সম্পর্ক খুঁজতে খুঁজতেই মানুষের বা সভ্যতার এগিয়ে যাওয়া। এক বিশ্বাস থেকে আরেক বিশ্বাসে পদার্পণ, আবার পুরনো অকার্যকর হয়ে ওঠা সে বিশ্বাসকেও ছুঁড়ে ফেলে অন্য কোন আধুনিক বিশ্বাস বা মতবাদ আঁকড়ে নেয়া। তাই জাগতিক ঘটনাবলির কার্য-কারণ খোঁজার ইতিহাসই মূলত মানব সভ্যতার অগ্রগতির ইতিহাস। এসব করতে গিয়ে মানুষ কোন কার্য-কারণ সম্পর্কের যে আপাত ব্যাখ্যা তৈরি করে, সেটা করে তার সমকালীন জ্ঞানের স্তর বা বিন্যাস দিয়ে। সভ্যতা ক্রমশই এগিয়ে যায় বলে একশ’ বছর আগের ব্যাখ্যা আর আজকের ব্যাখ্যা তাই এক থাকে না, থাকতে পারে না।
জগতের যে ঘটনাগুলো মানুষ এড়িয়ে যেতে পারে না, তার কার্য-কারণ সম্পর্ক খুঁজতে গিয়ে সমকালীন আহরিত জ্ঞান দিয়েও যখন পরিপূর্ণভাবে তার রহস্য উন্মোচন করতে ব্যর্থ হয়, তখনই সে আশ্রয় নেয় কল্পনার বা কাল্পনিক ধারণা সৃষ্টির। আর এগুলোকে অদ্ভুতভাবে বিশ্বাসযোগ্য করে তোলার জন্যে যে সন্তোষজনক যুক্তির প্রয়োজন হয়ে পড়ে, তাকে পরিতৃপ্ত করতেই জন্ম নেয় কতকগুলো লোককথা, উপকথা, পুরাণ বা রূপকথার। আমাদের প্রচলিত ধর্মীয় কাহিনীগুলো এই পর্যায়ের বলে জাগতিক ঘটনাবলির কার্য-কারণ সম্পর্কের তৎকালীন ধর্মীয় ব্যাখ্যার সাথে মানব সভ্যতার হেঁটে হেঁটে অনেকদূর এগিয়ে আসা আধুনিক ব্যাখ্যার বিশাল ব্যবধান তৈরি হয়ে গেছে আজ। এরকমই আরেকটি বিষয় হলো তথাকথিত জ্যোতিষশাস্ত্র।
অজানার প্রতি মানুষের নিরাপত্তাহীনতার ভয় বা সন্দেহ চিরকালের। বিশাল প্রকৃতির মহাজাগতিক ক্ষমতার কাছে নিতান্তই অসহায় মানুষের এক ধরনের নিরাপত্তাহীনতার বোধ থেকেই মনোজগতে জন্ম নেয়া শুভ-অশুভ জাতীয় সংস্কারগুলো জাগতিক সকল ক্রিয়াকর্মে বিপুল প্রভাব বিস্তার করে মানুষকে করে তুলেছে অদৃষ্টবাদী। এই অদৃষ্টবাদিতাই হলো তথাকথিত জ্যোতিষশাস্ত্রের আসল পুঁজি। দৃশ্যমান গ্রহ-নক্ষত্রের আপেক্ষিক অবস্থান এবং প্রাকৃতিক শক্তি তথা আবহাওয়া ও জলবায়ুর মধ্যের আন্ত-সম্পর্কের যে নিয়মতান্ত্রিকতা, দীর্ঘকালীন পর্যবেক্ষণের মধ্য দিয়ে মানুষের আহরিত জ্ঞানে এ সত্য ধরা পড়েছে খুব স্বাভাবিকভাবেই। আর তাই এই সত্যের সাথে কাল্পনিক শুভ-অশুভের অলৌকিক সংস্কার যুক্ত হয়ে গড়ে ওঠা জ্যোতিষশাস্ত্রই নিয়ন্ত্রণ করেছে এতদঞ্চলের তৎকালীন মানুষের মনোভূমি। এছাড়া কৃষিভিত্তিক সমাজ ব্যবস্থায় প্রকৃতি ও জলবায়ুর সাথে মানুষের সম্পর্ক এমনিতেই গভীর। এই প্রকৃতিনির্ভরতা মানুষকে বরাবরই আকৃষ্ট করেছে জলবায়ু পরিবর্তনে সৃষ্ট শুভ অশুভ পরিণতিগুলোর প্রতি। ফলে ‘যদি হয় চৈতে বৃষ্টি, তবে হবে ধানের সৃষ্টি।’ বা ‘আখ, আদা, পুঁই, এই তিনে চৈতি রুই’ জাতীয় কৃষিদর্শনভিত্তিক প্রবচনের সৃষ্টি হওয়াটাই স্বাভাবিক। এবং সাথে ‘সোম ও বুধে না দিও হাত, ধার করিয়া খাইও ভাত’ বা ‘মঙ্গলে ঊষা বুধে পা, যথা ইচ্ছা তথা যা’ জাতীয় শুভ-অশুভ শঙ্কা মিশ্রিত অলৌকিক সংস্কার জাতীয় প্রবচনগুলোও প্রভাব বিস্তার করেছে ধর্মীয় রূপকথার আদলে। কিন্তু একটি নিরক্ষর কৃষিভিত্তিক সমাজে এসব লৌকিক জ্ঞানের ব্যবহারিক শৃঙ্খলা আনয়নে সুনির্দিষ্ট কিছু রীতি মেনে চলায় বাধ্য করার সাবলীল প্রক্রিয়া হলো ধর্মগাথার আদলে কাল্পনিক কোন মনোশাসক সৃষ্টি, যা একাধারে হতে হবে বিশ্বাসযোগ্য ও আকর্ষণীয়। এরই বহিঃপ্রকাশ হয়তো উপকথার আদলে একজন লীলাবতী বা বিদুষী খনা নামের কিংবদন্তীয় কোন জ্যোতিষশাস্ত্রীর লোককাহিনীর সৃষ্টি ও এর ব্যাপ্তি। যথাযথ সময়ে যে কিনা কৃষিসম্পৃক্ত কোন প্রাজ্ঞ চাষার মুখ দিয়ে বলতে পারে- ‘বাঁশের ধারে হলুদ দিলে,/ খনা বলে দ্বিগুণ বাড়ে।’ কিংবা ‘শুনরে বাপু চাষার বেটা,/ মাটির মধ্যে বেলে যেটা,/ তাতে যদি বুনিস পটল,/ তাতে তোর আশার সফল’ ইত্যাদি। কিন্তু ঐতিহাসিক সত্যরহিত কোন কাল্পনিক রূপকথা বা কিংবদন্তী নির্ভর ধারণা থেকে চূড়ান্ত কোন অনুসিদ্ধান্ত টানা হয়তো পরিমিত বিবেচনার প্রমাণ রাখে না।
আরেকটি সম্ভাবনা ও যুক্তিকে এক্ষেত্রে বেশ জোরালো মনে হতে পারে। তা হচ্ছে, খনা কোন ব্যক্তিবিশেষের নাম নয়, প্রবচনের একটি বিশেষ রীতি বা ধারার নাম হলো খনার বচন। আর এই রীতি বা ধারাটি কী, তা আগেই উল্লেখ করা হয়েছে। তবু খনা শব্দটির বুৎপত্তিগত অর্থ বিশ্লেষণ করে আমরা এর একটি অনুমান খুঁজে নেয়ার চেষ্ট করতে পারি।
‘বাংলা একাডেমী ব্যবহারিক বাংলা অভিধান’ গ্রন্থে ‘খনা’ শব্দের দুটো অর্থ চিহ্ণিত করা হয়েছে। একটি হচ্ছে বিশেষণবাচক- নাকি সুরে কথা বলে এমন। অন্যটি বিশেষ্যবাচক এবং সেই রূপকথা আশ্রিত- বিখ্যাত বাঙালি মহিলা জ্যোতিষী; মিহিরের স্ত্রী। উক্ত অভিধানে খনার বচনের বিশেষ্যবাচক অর্থটি করা হয়েছে এভাবে- জ্যোতিষ শাস্ত্র অনুযায়ী চাষাবাদ, বৃক্ষরোপণ, গৃহনির্মাণ প্রভৃতি শুভাশুভ বিষয়ক সুপ্রচলিত প্রবচন যা খনার রচিত বলে প্রসিদ্ধ।
অর্থাৎ খনার বচনের একটি সুনির্দিষ্ট রীতি বা ধরন ইতোমধ্যেই সুপ্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে যে, জ্যোতিষ শাস্ত্র অনুযায়ী চাষাবাদ, বৃক্ষরোপণ, গৃহনির্মাণ, আবহাওয়া, জলবায়ু প্রভৃতি বিষয়সংশ্লিষ্ট শুভাশুভ বিষয়ক সুপ্রচলিত প্রবচনই খনার বচন। এক্ষেত্রে সংশয়ের কোন কারণ দেখি না। সংশয়ের কারণ থেকে যায় শুধু খনা শব্দ বা নামের যৌক্তিক উৎস নিয়েই। সম্ভবত এরও একটি চমৎকার সম্ভাব্যতা যাচাই করে নিতে পারি আমরা।
খনা (খন্ + আ) শব্দের মৌল শব্দ হচ্ছে খন। উল্লেখিত বাংলা অভিধানে এই ‘খন’ শব্দেরও দুটো ভিন্ন কিন্তু পরস্পর সম্পর্কযুক্ত অর্থ চিহ্ণিত রয়েছে। একটি হলো- ক্ষণ শব্দের কোমল রূপ। আর ‘ক্ষণ’ অর্থ দেয়া আছে ‘মুহূর্ত’। অভিধানে খন শব্দের অন্য অর্থটি মুদ্রিত আছে এভাবে- ভবিষ্যৎ অর্থবোধক (হবে’খন, দেখব’খন)। {‘এখন’ শব্দের ‘এ’ লোপে; স. ক্ষণ>}।
উপরোক্ত বিবেচনায় এখন ‘খনা’ শব্দটির ক্রিয়া-বিশেষণবাচক একটি লোকায়তিক অর্থ যদি এভাবে করা হয়, ভবিষ্যতের কোন বিশেষ (শুভাশভ) মুহূর্ত, কোথাও কি ভুল হবে ? যদি ভুল না হয়ে থাকে, তাহলে ‘খনার বচন’ শব্দযুগলের একটি বাচ্যার্থ দাঁড়ায় এরকম, যে বচনের মধ্য দিয়ে কোন বিষয়ের ভবিষ্যৎ শুভাশুভ মুহূর্ত নির্দেশিত হয় বা হয়েছে, তা-ই খনার বচন। ফলে আরো কিছু প্রশ্নেরও ধারণাগত যৌক্তিক ব্যাখ্যা পেয়ে যেতে পারি আমরা। খনার বচন যে কেবল খনা নামধারী সুনির্দিষ্ট ব্যক্তিবিশেষেরই রচিত হতে হবে তা নয়। হতে পারে বিজ্ঞ কিছু নিরক্ষর লোক-চাষার। অথবা প্রাচীন কৃষিদর্শন-অভিজ্ঞ কিছু লোক-কবির। বা কৃষিনির্ভর কিছু চতুর ও প্রাজ্ঞ জ্যোতিষীর। তবে এ বচনগুলো যে বিভিন্ন কালের বিভিন্ন অঞ্চলের কৃষিসংশ্লিষ্ট বিভিন্ন জনের মুখে মুখে ছড়া কাটার মতোই একগুচ্ছ লোকায়ত ভবিষ্যৎ বাণী, তাতে বোধকরি দ্বিমত করার খুব জোরালো অবকাশ থাকবে না। খনার বচনের সবগুলো প্রবচন হয়তো এখনো সংগ্রহ করা সম্ভব হয় নি বা খনার বচনের প্রকৃত সংখ্যাও সুনির্দিষ্টভাবে নির্ণীত করা সম্ভব নয়। তবু খনার বচনের সেই সব বচন রচয়িতাকে যদি আমরা ‘খনা’ নামেই চিহ্ণিত করি, তাহলে বলতেই হয়, খনা হচ্ছে জনভাষ্যে মিশে থাকা আমাদের একগুচ্ছ লোক-ভাষ্যকার।
(Image: from internet)
…
৯টি মন্তব্য ০টি উত্তর
আলোচিত ব্লগ
স্বাধীনতাকামীদের বাচ্চারা মাদ্রাসায় গিয়ে কিসে পরিণত হয়?
স্বাধীনতাকামীদের বাচ্চারা মাদ্রাসায় গিয়ে শিবির কিংবা হেফাজতে পরিণত হয়, যারা ১৯৭১ সালের স্বাধীনতায় বিশ্বাস করে না।
মুসলিম বিশ্বে, গরীবদের ছেলেমেয়েরা মাদ্রাসায় গিয়ে, আধুনিক জীবনভাবনা থেকে বিদায় নেয়,... ...বাকিটুকু পড়ুন
সামু ব্লগ কি আবারও ধর্মবিদ্বেষ ছড়ানোর হাতিয়ারে পরিণত হইতেছে!
সামু ব্লগ কি আবারও ধর্মবিদ্বেষ ছড়ানোর হাতিয়ারে পরিণত হইতেছে!
ইহা, উহা, ইহার, উহার, ইহাকে, উহাকে - ইত্যাকার সাধু ভাষার শ্রুতিমধুর কিছু শব্দসম্ভারের প্রয়োগ কদাচিত আমাদের প্রিয়... ...বাকিটুকু পড়ুন
হাফ-লেডিস বলছি.......
(ছবি নেট হতে)
আজ ব্লগ না থাকলে কবেই আত্মহত্যা করতে হতো। জ্বী আমার কথাই বলছি। আমার মতো উপযোগহীণ গর্দভ টক্সিক ব্যক্তি বেঁচে আছি শুধু ব্লগের জন্যে। কিভাবে? তবে বলছি শুনুন।
ছোটবেলা হতেই... ...বাকিটুকু পড়ুন
=ভুলে যাচ্ছি কত কিছু=
ভুলে যাচ্ছি মমতার ঋণ, বাবার আদর
ক্রন্দনরত দিন, বৃষ্টির ঝুম আওয়াজ
ভুলে যাচ্ছি কত কিছু দিন দিন
বিছানো ছিল কোথায় যেন স্নেহের চাদর।
ভুলে যাচ্ছি দেহের শক্তি, সরল মন
কঠিনের মাঝে ডুবে ধীরে
ভুলে... ...বাকিটুকু পড়ুন
রেমিট্যান্স যোদ্ধা!
সদ্যই আমেরিকার নতুন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প সপরিবারে হোয়াইট হাউসে উঠেছেন। নির্বাচনে যারা অক্লান্ত পরিশ্রম করেছেন তাদেরসহ অন্যান্য সবাইকে এক প্রীতিভোজের আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। নিরাপত্তা রক্ষীরা যাচাই-বাছাই করে সেসব অতিথিদের ভেতরে ঢুকতে... ...বাকিটুকু পড়ুন