ব্যলকনিতে দাঁড়ালেই পাগলটিকে দেখা যায়।
একটা কৃষ্ণচূড়া গাছের নিচে বসে আছে। গায়ে বহু দিনের ময়লা জামা। একটা ছেঁড়া প্যান্ট পরা। হাত পায়ের নখে ময়লার স্তর জমে গেছে। যত্নহীন চুলে জট বাধতে শুরু করেছে। মুখে অনেকদিন না কামানো দাঁড়ি। সারাদিন রাত সে এই কৃষ্ণচূড়া গাছের নিচেই বসে থাকে। সামনের দিকে তার দুচোখ। রাস্তা দিয়ে সারাদিন বহু মানুষ যাওয়া আসা করে কিন্তু কেউ পাগলের দিকে ফিরেও তাকায় না। শহরের মানুষের ব্যস্ততার শেষ নেই। তাতে পাগলের কিছু যায় আসে না। সে কারো ক্ষতি করে না। কাউকে ভয় দেখায় না, ইট ছুড়ে মারে না। কারো খাবার কেড়ে নিয়ে খায় না। সে শুধু সামনের দিকে চেয়ে বসে থাকে। কৃষ্ণচূড়া গাছের লাল ফুল গুলো মাটিতে পড়ে। সে ফুল গুলো কুড়িয়ে তার পাশে জড়ো করে।
শাহেদ সকালে নাস্তা শেষ করে এসে ব্যলকনিতে সিগারেট খায়।
পাগলের দিকে তাকিয়ে থাকে। পাগলটির অবস্থানে নিজেকে বসায়। তারপর সামান্য হেসে উড়িয়ে দেয়। পাগলের জন্য তার বড় মায়া হয়। সে নীলাকে বলেছে এই পাগলটিকে তিনবেলা খাবার দিতে। সকালে বের হবার সময় শাহেদ পাগলটিকে খাবার দিয়ে যায়। জিজ্ঞেস করে- কি খবর? কেমন আছো? বলতো এটা বাংলা কোন মাস? পাগল কিছু বলে না। শাহেদের দেওয়া নাস্তা খায়। দুপুরে খাবার দিয়ে যায় রহিমা বুয়া। রাতে শাহেদ বাসায় ফিরে নিজে খেয়ে পাগলের জন্য খাবার নিয়ে আসে। শাহেদ জিজ্ঞেস করে- কি খবর? কেমন আছো? বলতো এটা বাংলা কোন মাস? পাগল কিছু বলে না। শুধু খেয়ে যায়। খেয়ে নিজের ময়লা জামাতেই হাত মুছে নেয়। রাতে এই কৃষ্ণচূড়া গাছের নিচেই কুন্ডলি পাকিয়ে ঘুমিয়ে যায় পাগল।
নীলা ব্যলকনিতে আসতে ভয় পায়।
তবু তাকে বেশ কয়েকবার ব্যলকনিতে আসতে হয় ভেজা কাপড় মেলতে, আর শুকনো কাপড় নিয়ে যেতে। ব্যলকনিতে এলেই রাস্তার ঐ পারে চোখ যায়। সেখানে পাগলটি বসে থাকে। তার দিকে তাকায়। কিছু যেন বলতে চায়। নীলা সব সময় পাগল, মাতাল আর কুকুর ভয় পায়। ছোটবেলায় সে দেখেছে এক মাতাল রোজ মদ খেয়ে এসে কুৎসিত গালি দিতো। অথচ শাহেদ ঐ পাগলকে তিনবেলা খাবার দেওয়ার হুকুম করেছে। শীতের সময় কম্বল দিয়ে আসে। নীলার ধারনা তাঁরা যদি এই এলাকা ছেড়ে অন্য কোনো এলাকায় চলে যায়, পাগল তাদের ঠিকই খুঁজে বের করবে। এবং সেখানে অবস্থান নেবে কোনো গাছের তলায়। তিনবেলা সময় মতো খাবার তাকে আর কে দিবে? শীতের কম্বল আর বৃষ্টিতে ছাঁতা? নীলার ধারনা এই পাগলের জন্য তাদের অনেক ভোগান্তি হবে।
আজকাল শাহেদের কিছুই ভালো লাগে না।
সারাদিন অফিসে পার করে দেওয়া তার কাছে ভালো লাগে না। প্রতিদিন একই কাজ, একই রুটিন। একই রকম মুখ। বিরক্তি ধরে গেছে। কি হবে এত টাকা পয়সা দিয়ে? মানুষের বেঁচে থাকতে তো অনেক টাকার দরকার নাই। শাহেদ কাউকে কিছু না বলে অফিস থেকে বের হয়ে গেলো। মাত্র বিকেল পাঁচটা। সে এখন কোথায় যাবে? কার কাছে যাবে? তার কিছুই ভালো লাগছে না। রাস্তায় অসংখ্য মানুষ। সবার মধ্যে কেমন ব্যস্ততা। কি হবে এত ব্যস্ততা দিয়ে? একদিন তো মরেই যেতে হবে! চারিদিকে মানুষের নানান রকম ব্যস্ততা। গাড়ি বাস আর বাইকের বিকট হর্ন। ধুলো ময়লা। একদম মাথা ধরিয়ে দেয়। ট্রাফিক পুলিশগুলো এত লম্বা সময় এই রকম বিকট আওয়াজের মধ্যে থাকে কি করে! শাহেদ হাঁটতে হাঁটতে এক দোতলা বাড়ির সামনে গিয়ে দাঁড়ালো।
যদিও সন্ধ্যা ঘনায়মান। আজ মনে হচ্ছে বৃষ্টি হবে।
দরজা খুলে মিলি বলল, আমি জানতাম আজ তুমি আসবে। কারন সকালে ঘুম থেকে উঠেই জানালার কাছে দুটা শালিক দেখেছি। শাহেদ বলল, তুমি এত সেজেছো কেন? মিলি বলল, বললাম না আজ তুমি আসবে তাই সেজেছি। শাহেদ মুগ্ধ হয়ে মিলিকে দেখছে। মেয়েটা ভীষন সুন্দর। দীর্ঘক্ষন তাকিয়ে থাকলেও বিরক্ত লাগে না। মিলির সব কিছু সুন্দর। চোখ, ঠোঁট, ভরাট বুক, মরুভূমির মতো মসৃন কোমর। মাসে কমপক্ষে দুবার মিলির কাছে না এসে শাহেদ থাকতে পারে না। অথচ ঘরে তার মমতাময়ী স্ত্রী আছে। একটা তিন বছরের মেয়ে আছে। শাহেদ দুনিয়ার সবার কথা ভুলে গিয়ে মিলির ভুবনে ডুব দিলো। আনন্দময় সময় কাটুক। মিলি শাহেদ তাঁরা দুজন দুজনকে চিনে বহু বছর ধরে। তাঁরা একই ক্যাম্পাসে লেখাপড়া করেছে। ঘটনা চক্রে তাদের বিয়ে হয়নি।
নীলা শাহেদের জন্য অপেক্ষা করছে।
এখন রাত ৯ টা। অথচ অফিস ছুটি হয়ে গেছে সেই বিকেল পাঁচটায়। শাহেদ কখনও এত দেরী করে না। কোথায় গেলো শাহেদ! নীলা এর মধ্যে দুবার ব্যলকনিতে গিয়ে দেখেছে শাহেদকে ফিরতে দেখা যায় কিনা। না শাহেদ নেই। সেই পাগলটা বসে আছে। যেন ধ্যান করছে। শাহেদ ফিরলো রাত দশটায়। নীলা দরজা খুলে অবাক! শাহেদ মদ খেয়েছে। সোজা হয়ে ঠিক করে দাঁড়াতে পারছে না। নীলা বলল, তুমি কোথায় গিয়েছিলো? তোমার শার্টে লিপস্টিকের দাগ কেন? বলেই সে কাঁদতে শুরু করলো। মেয়েলি কান্না। প্রায় আধা ঘণ্টা সময় লাগলো নীলাকে বুঝাতে। এরপর নীলা স্বাবাবিক হলো। শাহেদ বলল, ভাত দাও। সজলকে দিয়ে আসি। বেচারা হয়তো আমার অপেক্ষায় আছে। নীলা পাগলের জন্য ভাত বেড়ে দিলো। আর কতদিন তাকে ভাত দিতে হবে!
শাহেদ বলল, এই নাও সজল তোমার খাবার।
পাগল থাবা দিয়ে ভাত নিয়ে খেতে শুরু করলো। শাহেদ বলল, একদিন তোমাকে আমি আমার বাসায় নিয়ে যাবো। দেখে যাও আমার ঘর সংসার। আমি আমার স্ত্রী কন্যাকে নিয়ে কত সুখে আছি। আর তুমি কত কষ্ট পাও- রোদ বৃষ্টি ঝাড়ে। পাগল কোনো কথা বলে, সে সমানে খেয়ে যাচ্ছে। আচ্ছা, সজল তোমার হিংসা হয় না? তোমার ইচ্ছা করে না, আমার মতো একটা স্ত্রী তোমার থাকুক? আমার মতো একটা কন্যা হোক তোমার? পাগল কোনো কথা বলে না। চুপচাপ খেয়ে যায়। সজল, তুমি কি আমার স্ত্রী নীলাকে ভালোবাসো? তাকে না পেয়েই কি তুমি পাগল হয়ে গেলে? নাকি তুমি পাগল নও। পাগল সেজে তোমার ভালোবাসার মানুষটির কাছাকাছি থাকতে চাও? পাগল কোনো কথা বলে না। সে ভাত খায়। ভাত খাওয়া শেষ হলে নিজের ময়লা জামাতেই হাত মুছে নেবে।