শাহেদ ডিগ্রী পাশ করে ঢাকায় এসেছে চাকরী করার উদ্দ্যেশে। এর আগে সে কখনও ঢাকা আসেনি। ঢাকা শহরে এসে তার মাথা পুরাই আউলায়ে গেছে। যা দেখে হা করে তাকিয়ে থাকে। রাস্তার যানজট, মানুষজন, ফুটপাতের দোকান, বড় বড় অট্রালিকা, শপিংমল যাই'ই দেখে সে মুগ্ধ হয়ে যায়। আজ তের দিন সে ঢাকা এসেছে। সে উঠেছে খিলগা এলাকার এক মেসে। এই মেসে তার দূরসম্পর্কের এক চাচা থাকেন। চাচার নাম মোতালেব। সবাই ডাকে হাজী মোতালেব। যদিও মোতালেব কখনও হজ্ব করেননি। সম্ভবত তার মুখ ভরতি হুজুরদের মতো দাড়ি দেখে সবাই তাকে হাজী মোতালেব চাচা বলে ডাকেন। মোতালেব তের বছর ধরে সিএনজি চালায়। শাহেদ তার মেসেই উঠে এসেছে।
সকাল দশটা। শাহেদ প্রায় এক ঘন্টা দাঁড়িয়ে আছে ঢাকা মেডিকেল এর ইমারজেন্সী গেটে। এই ঘন্টা সে দেখলে প্রতি মিনিটে কোনো না কোনো রোগী আসছে। তাদের অবস্থা ভয়াবহ। কারো হাত ভেঙ্গে গেছে, কারো পায়ের উপর দিয়ে গাড়ি চলে গেছে, কেউ তিন তলার ছাদ থেকে পড়ে গেছে, কারো মাথা ফেটে ঘিলু বের হয়ে গেছে, কেউ স্ট্রোক করেছে, কেউ গুলি খেয়েছে, কাউকে আবার এলোপাতাড়ি কোবানো হয়েছে। শাহেদের কাছে খারাপ লাগলো এই সমস্ত রোগীরা সবাই দরিদ্র শ্রেনীর। দরিদ্ররাই কি বেশি অসুস্থ হয়? রোগীর সাথে আসা লোকজন চিৎকার করে কাঁদছে। হাসপাতালের ডাক্তার আর নার্স একেবারে নির্বিকার। যেন রোগ শোক, মানুষের কষ্ট তাদের কাছে কোনো ব্যাপারই না। এই সব দেখে দেখে শাহেদ বেশ ক্লান্ত। তার এখন বমি পাচ্ছে। সে সত্যি সত্যি রাস্তায় বমি করে দিল। সে মনে মনে ভাবলো আর কখনও ঢাকা মেডিকেল আসবে না।
শাহেদ চাকরির অনেক চেষ্টা করেছে। সে চাকরি পায়নি। বরং চাকরিদাতারা তার সাথে খারাপ ব্যবহার করেছে। চাকরির আর কোনো আশা নেই। চাকরির আশা সে বুড়িগঙ্গা নদীতে ভাসিয়ে দিয়েছে। সে সতের শ' টাকা নিয়ে ঢাকা এসেছে, তার কাছে এখন আছে তিন শ' বারো টাকা। মোতালেব চাচা তার জন্য যথেষ্ট করেছেন। তাকে থাকার জায়গা দিয়েছেন। এবং বলেছেন, যতদিন তার চাকরি না হবে ততদিন তার থাকা খাওয়ার জন্য কোনো টাকা পয়সা দিতে হবে না। শাহেদ মনে মনে ঠিক করে রেখেছে, তার যদি চাকরি না হয় তাহলে সে সিএনজি চালাবে। সে গ্রামে থাকতে কিছু দিন অটো চালিয়েছে। মোতালেব চাচা অবশ্যই তাকে একটা সিএনজি নিয়ে দিতে পারবেন। সিএনজি মালিক মোতালেব চাচাকে খুব পছন্দ করেন। সমস্যা হলো সে ঢাকা শহরের রাস্তা ঘাট কিছুই চিনে না। এই জন্য সে সারাদিন ঢাকার রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়ায়। এত গলি, এত রাস্তা। তার মাথা আউলায়ে যায়। তবে সে মোটামোটি অনেক জায়গা চিনে ফেলেছে। সে যখন এত আশা করে ঢাকা এসেছে, জয়ী না হয়ে সে ফিরবে না।
দুপুর দুইটা। শাহেদ দাঁড়িয়ে আছে বিমান বন্দর। এমন অদ্ভুত জায়গা সে তার জীবনে দেখেনি। যারা বিদেশ থেকে আসছে তারা নামছে নিচতালা দিয়ে। তাদের নিতে আসছে পরিবার পরিজন। তারা কি খুশি! এয়ারপোর্টের বাইরে এসেই ছেলে তার বাবাকে বুকে জড়িয়ে ধরেছে। কি কান্না দু'জনের। আনন্দের কান্না। সৌদি থেকে এক শ্রমিক এসেছে। সে তার ছোট বাচ্চাকে আজই প্রথম দেখল। বাচ্চাকে বুকে নিয়ে আনন্দে কাঁদছে। একজনকে নিতে এসেছে সাত আট জন লোক। পুরো জায়গা মানুষে গিজগিজ করছে। নিরাপত্তা কর্মীরা প্রয়োজনে অপ্রয়োজনে বাশি বাজিয়ে যাচ্ছে। তাদের হাতে আবার লাঠি। হাতে লাঠি কেন তা শাহেদের কাছে পরিস্কার না। সবাই পাঁচ ছয়টা করে বড় বড় লাগেজ নিয়ে এসেছে। আত্মীয় স্বজনরা সেসব লাগেজ এক আকশ আগ্রহ নিয়ে মাইক্রোতে তুলছেন। একটা পরিবার এসেছে চাঁদপুর থেকে। তাদের লোক প্লেন থেকে নামবে সন্ধ্যা ছয়টায়। কিন্তু তারা সকাল দশটা থেকে এসে বসে আছে। তাদের একজন একটু পরপর দায়িত্বরত গার্ডকে জিজ্ঞেস করছে, ভাই সাহেব দুবাই থেকে এমিরাটসের বিমানটা কি নেমেছে? তারা দুইটা বড় মাইক্রো ভাড়া করে নিয়ে এসেছে। একটাতে যাবে মালপত্র আরেকটা সবাই মিলে গল্প করতে করতে যাবে।
শাহেদ দোতলায়ও অনেকক্ষন দাঁড়িয়ে থাকলো। যারা দেশ ছাড়ছেন তাদের মিলনমেলা দোতলায়। একজন আরেকজনকে জড়িয়ে ধরে কি কান্না। তাদের কান্না দেখে শাহেদের চোখেও পানি এসে গেল।
ইস্কাটন এসে শাহেদ একটা অদ্ভুত ব্যাপার দেখলো। একটা ছেলে মেয়ে রিকশায় বসে খুব চুমুটুমু খাচ্ছে। ছেলেটার হাত মেয়েটার বুকে। তাদের মধ্যে কোনো লজ্জার বালাই নেই। বরং শাহেদ নিজেই লজ্জা পেল। গতকাল সে পার্কে দেখেছে, ছেলে মেয়েরা জড়াজড়ি করে বসে আছে। ছেলেটা এখানে সেখানে হাত দিচ্ছে। মেয়েটা তা খুব উপভোগ করছে। এক ছেলে বিনা দ্বিধায় মেয়ের কোলে মাথা রেখে শুয়ে আছে। একটু পরপর মেয়ে নিজেই ছেলেটার ঠোঁটে চুমু দিচ্ছে। আশেপাশে কে আছে অথবা কে দেখলো, না দেখলো তা যেন তাদের কাছে কোনো ঘটনাই না! শাহেদ মনে মনে ভাবলো, আচ্ছা, এই ছেলে মেয়ে গুলোর বাবা মা কি জানে না- তাদের আদরের সন্তান পার্কে বসে চুমাচুমি করছে। বাবা মার উচিত ছেলে মেয়েদের উপর খুব নজর রাখা। এটা অবশ্যই তাদের দায়িত্ব। যদি বাবা মা সঠিক দায়িত্ব পালন না করেন তাহলে তারা ছেলে মেয়ে জন্ম দিতে গেলো কেন? শাহেদের মেজাজ চরম খারাপ হলো যখন দেখলে, স্কুলের ইউনিফর্ম পরা ছেলে মেয়েরা পার্কে বসে আছে বিশ্রী ভঙ্গিতে।
শাহেদ ঢাকা শহর মোটামোটি চিনে ফেলেছে। হাজী মোতালেব চাচা তাকে সিএনজির ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। প্রতিদিন জমা আট শ' টাকা। সে সকাল থেকে রাত এগারোটা পর্যন্ত সিএনজি চালায়। সে কখনও বাড়তি টাকা চায় না যাত্রীদের কাছ থেকে। সব সময় মিটারে চালায়। কোনো কোনো যাত্রী খুশি হয়ে তাকে বিশ টাকা, পঞ্চাশ টাকা বেশি দেয়। সারাদিন কঠোর পরিশ্রম করার পর সে রাতে খেয়েই ঘুমিয়ে পড়ে। বিছানায় শোয়া মাত্রই সে গভীর ঘুমে তলিয়ে যায়। ঘুমের মধ্যে সে স্বপ্নে দেখে তার নিজের একটা সিএনজি হয়েছে। সিএনজি'তে করে সে নীলাকে নিয়ে ঢাকা শহরে খুব ঘুরে বেড়ায়। নীলা যা দেখে, প্রচন্ড অবাক হয়ে যায়। লাল বাগের কেল্লার সামনে দাঁড়িয়ে নীলা আর শাহেদ ফুচকা খায়। নিউ মার্কেট এর সামনে থেকে খায় আখের রস। কল্পনায় সব সম্ভব। বাস্তব অবশ্যই অন্য রকম। বাস্তবে নীলা জেলা পরিষদ সদস্যের ছেলের বউ।
ফযরের আযানের পরপর'ই শাহেদের ঘুম ভেঙ্গে যায়।
সর্বশেষ এডিট : ১৬ ই এপ্রিল, ২০১৮ দুপুর ২:০৪