আমাদের আরিশ।
সুরভি সেদিন বলল আমার চেহারার মধ্যে একটা ফকিরা ভাব চলে এসেছে। আমি যতটুকু না দরিদ্র তার চেয়ে বেশি একটা দরিদ্র ভাব ফুটে উঠেছে। আমি নিজেকে ভালো করে আয়নায় দেখলাম। আসলেই চোখে মুখে একটা দরিদ্র ভাব স্থায়ী হয়ে গেছে। এই কয়েকদিন আগের একটা ঘটনা বলি, বাসা থেকে বের হয়েছি। গলির মুখে এক ছেলে মোটর বাইকে বসে বিকট হর্ন দিচ্ছে। আমি পেছনে ফিরে স্বাভাবিক গলায় বললাম এত হর্ন দিচ্ছেন কেন অপ্রয়োজনে? ছেলেটি রেগে-মেগে মোটর বাইকের সামনের চাকাটি আমার পায়ে লাগিয়ে দিল, আরও হর্ন দিব বলেই, হর্ন দিয়েই যেতে লাগলো। ছেলেটি কেন এত উত্তেজিত হয়ে পড়লো আমি বুঝতে পারলাম না। ঘটনাটি আমার বাসার সামনেই। রোগা পটকা একটা ছেলে, বয়সও বেশি নয়। আমি যদি ছেলেটাকে একটা থাপ্পড় দেই, সে মনে হয় উঠে দাঁড়তেও পারবে না। আমি চুপ করে সহ্য করে গেলাম। নিজেকে বারবার বললাম, রাজীব শান্ত হও। শান্ত। খুব শান্ত।
আচ্ছা, এই ছেলেটি কি ছাত্রলীগ করে? এমন উগ্র মেজাজ ছাত্রলীগের ছেলেদের'ই হয়।
ছোট ভাইয়ের ছেলে আরিশ হঠাৎ করে খুব অসুস্থ হয়ে পড়লো। হাসপাতালে নিয়ে গেল ডাক্তার দেখাতে। ডাক্তার আরিশকে হাসপাতালে ভর্তি করে নিল। ডাক্তারের সন্দেহ টাইফয়েড। নানান রকম টেস্ট চলছেই। আরিশ খাওয়া দাওয়া একদম ছেড়ে দিল। জোর করে খাওয়াতে গেলে বমি করে দেয়। প্রচন্ড জ্বর। জ্বর বাড়ছে, কমছে, বাড়ছে। মাঝে মাঝে খিচুনি। আরিশের কষ্ট দেখে আমার প্রচন্ড মন খারাপ। বাচ্চা মানুষ কি কষ্টটাই না পাচ্ছে। কিন্তু আমি কিছুই করতে পারছি না। আমি অফিস শেষ করে প্রতিদিন হাসপাতালে যাই। আরিশ আমাকে জড়িয়ে ধরে বলে বাসা। বাসা, বাসা। মানে তার কাছে হাসপাতাল ভালো লাগছে না। সে এখনি বাসায় চলে যেতে চায়। শিশু ওয়ার্ডে ভালো লাগার মতো কিছু নেইও। তবে একটা বিড়াল আছে। সে হুট হাট করে বের হয়। তখন বাচ্চারা অবাক চোখে বিড়ালের দিকে তাকিয়ে থাকে। এই বিড়াল চুরি করে শিশুদের খাবার খায়।
হাসপাতালে কেবিন পাওয়া যায়নি। প্রয়োজনের সময় কখনও কি পাওয়া যায়? আরিশকে শিশু ওয়ার্ডে রাখা হয়েছে। কমপক্ষে সেখানে পঞ্চাশ জন শিশু আছে। নানান রকম তাদের শারীরিক সমস্যা। এই শিশু ওয়ার্ডে একজন সুস্থ মানুষের পক্ষে দশ মিনিট থাকা সম্ভব না। আমি লক্ষ্য করে দেখেছি, হাসপাতালে গেলে কেবিন পাওয়া যায় না। রেলস্টেশনে টিকিট পাওয়া যায় না। বাসের টিকিট পাওয়া যায় না। লঞ্চের কেবিনের টিকিট পাওয়া যায় না। তাহলে কেবিন গুলো কোন ভাগ্যবানেরা পায়? প্রতিটা বেডে একজন রোগীর সাথে চারজন পাঁচ জন করে লোক। পুরো ওয়ার্ডটি যেন মাছের বাজার। কেউ জোরে জোরে মোবাইলে কথা বলছে। কোনো বাচ্চা চিৎকার করে কাঁদছে। রোগীকে দেখতে আসা লোকজন রাজ্যের ফালতু বিষয় নিয়ে সমানে গল্প করে যাচ্ছে। কারো মাথায় নেই এটা হাসপাতাল। তাও আবার শিশুদের ওয়ার্ড। পুরো ওয়ার্ডটির ভয়াবহ অবস্থা। নার্সরাও দল বেঁধে গল্প করছে। হাসছে।
মনটা মানে না। আজ সন্ধায় আবার গেলাম হাসপাতালে। সেই একই রকম চিৎকার চ্যাচামেচি। আরিশের হাতের রগ খুঁজে পাওয়া যায়নি। তাই পায়ে তাকে স্যালাইন দেওয়া হচ্ছে। এর আগের দিন অবশ্য হাতে স্যালাইন দেওয়া হয়েছিল। বেচারা আমাকে দেখেই জড়িয়ে ধরে বলল, বাসা বাসা, চলো। সে হাসপাতালে আজ তিন দিন। মুখটা শুকিয়ে এতটুকু হয়ে গেছে। আমি আরিশকে কোলে নিতেই সে কিছুক্ষনের মধ্যে ঘুমিয়ে পড়লো। আরিশের মা কেঁদে কেঁদে চোখ ফুলিয়ে ফেলেছে। আরিশের বাবা খাওয়া দাওয়া ছেড়েই দিয়েছে ছেলের কষ্টে। আসলে আমাদের বাসার সবারই মন খারাপ আরিশের জন্য। ছোট একটা বাচ্চা অসুস্থ থাকলে বাসার কারো'ই মন ভালো থাকে না। আর এই শিশু ওয়ার্ডে সব গুলোর বাচ্চার বয়স'ই এক থেকে চারের মধ্যে। সব গুলো বাচ্চার'ই নানান রকম অসুখ। কি কষ্ট তাদের! কষ্ট গুলো কেউ নিজের চোখে না দেখলে বিশ্বাস করবে না। আমার নিজের অজান্তেই চোখে পানি চলে আসে!
১০৫ নম্বর বেডে দেখলাম একটা ছোট বাচ্চার নাকের মধ্যে নল ডুকানো হয়েছে।। বাচ্চাটা ঠিক করে নিশ্বাস নিতে পারছে না। বুকটা খুব দ্রুত উঠা নামা করছে। বুঝাই যাচ্ছে বাচ্চাটির সীমাহীন কষ্ট হচ্ছে। এই দৃশ্য কি সহ্য করা যায়? আরেক বেডে দেখলাম এক বাচ্চা একা একা খেলছে। আশে পাশে কাউকে দেখলাম না। বাচ্চার মা মনে হয় ওয়াশরুমে গিয়েছে। যে কোনো সময় বাচ্চাটা বেড থেকে ফ্লোরে পড়ে যেতে পারে। আমি একজন নার্সকে বললাম, বাচ্চাটার মা মনে হয় ওয়াশ রুমে গিয়েছে আপনি বাচ্চাটির বেডের কাছে থাকুন। নার্সটি প্রচন্ড বিরক্ত হয়ে আমার দিকে তাকালো। তারপর মোবাইলে কার সাথে যেন চ্যাটিং করতে লাগলো। অন্য নার্সরা গল্পে ভীষন ব্যস্ত। আমি তাদের কাছে গেলাম। তারা বলল, যান নিজের কাজ করুন। অযথা আলগা দরদ দেখাবেন না। কখন কি করতে হবে আমাদের জানা আছে। আরেক বেডে দেখলাম একজন অল্প বয়সী মা এক আকশ ভালোবাসা নিয়ে তার শিশু সন্তানকে বুকের দুধ খাওয়াচ্ছে। দৃশ্যটা খুব ভালো লাগলো। আমার মনে হলো- এর চেয়ে সুন্দর দৃশ্য হয় না। একজন মা তার সন্তানকে কোলে নিয়ে এক আকাশ ভালোবাসা নিয়ে দুধ খাওয়াচ্ছে। আমার মাও তো এইভাবে এক আকশ ভালোবাসা নিয়ে আমাকে দুধ খাইয়েছেন।
আরিশের অনেক গুলো খেলার মধ্যে আরেকটা প্রিয় খেলা হলো আযান শুনলেই জায়নামাজ নিয়ে নামাজ পড়তে বসা। সে হয়তো গাড়ি নিয়ে খেলছে, মসজিদের আযান শুনে হঠাৎ জায়নামাজ নিয়ে নামাজ পড়তে বসে যায়। নামাজে দাঁড়িয়ে বিড় বিড় করে কি যেন বলে। নামাজ শেষে সে তার খেলায় ফিরে যায়।
সর্বশেষ এডিট : ০২ রা এপ্রিল, ২০১৮ রাত ১১:০৬