বাংলাদেশের টেলিভিশন ইতিহাসকে মোটামুটি তিন ভাগে ভাগ করা যায় -
১) ১৯৬৪ সালে প্রতিষ্ঠার পর থেকে ১৯৮০ সাল পর্যন্ত। পুরোপুরি সাদাকালো যুগ।
২) ১৯৮০ সাল থেকে ১৯৯২ সাল পর্যন্ত । রঙিন টেলিভিশনের আবির্ভাব হয় '৮০ সালে। প্রেসিডেন্ট জিয়ার মধ্যে হঠাৎ হঠাৎ গিমিক দেবার প্রবনতা ছিল। রঙিন টিভিও সেধরনের একটি গিমিক। লোকে সমালোচনা করেছিল যে জিয়া সাহেব ঋন করে ঘি খাচ্ছেন। ৮০ সালে বাংলাদেশের খুব অল্পসংখ্যক মানুষের এমনকি সাদাকালো টিভি কেনার সামর্থ্য ছিল। রঙিন টিভি তো হাতে গোনা লোকের জন্য। কিন্তু জিয়া এসব সমালোচনাকে গুরুত্ব দেননি।
৩) ১৯৯২ সাল থেকে বর্তমান। এইসময় টেলিভশন ইন্ডাস্ট্রিতে ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে। শত শত বিদেশি চ্যানেল, গোটা পনের দেশি চ্যানেল, হাজার প্রাইভেট প্রডাকশন হাউস গড়ে উঠেছে এইসময়। আজকের ফিরে দেখা এই পর্বের শুরুর দিনগুলি নিয়ে। লক্ষনীয় যে রঙিন টিভির মত এই যুগেরও উদ্বোধন হয়েছে বিএনপি সরকারের হাতে।
৯২ সালের মাঝামাঝি কোন একসময় বিটিভিতে ঘোষনা এল, তারা অনুষ্ঠানের সময়সীমা বাড়ানোর পদক্ষেপ নিচ্ছেন এবং পরীক্ষামূলকভাবে তিনদিন অনুষ্ঠান বিকাল পাঁচটার পরিবর্তে তিনটা থেকে শুরু হবে। ঘটনাচক্রে এই তিনদিনব্যাপী বিশেষ অনুষ্ঠানমালার কোন একদিন বিরোধী দলের বেশ আগেই নির্ধারিত একটি বড় মহাসমাবেশের পরিকল্পনা ছিল। গুজব ছিল সেই মহাসমাবেশের লোক সমাগম কমানোর উদ্দেশ্যেই এই তিনদিন আকর্ষনীয় বিশেষ অনুষ্ঠান প্রচার করা হচ্ছে। এটা গুজব বলেই ধরে নেয়া যায় কারন এর কিছুদিন পর স্থায়ীভাবেই অনুষ্ঠান বিকাল তিনটায় এগিয়ে আনা হয়।
সেপ্টেম্বর-অক্টোবরের দিকে বিটিভি সকালবেলা তিনঘন্টা (সাড়ে আটটা থেকে সাড়ে এগারটা) মার্কিন নিউজ চ্যানেল সিএনএন এর অনুষ্ঠান প্রচার শুরু করে। এটাই বাংলাদেশের মানুষের প্রথম কোন বিদেশি চ্যানেল দর্শন। সিএনএন বহির্বিশ্বে তখন ব্যাপক জনপ্রিয় হয়েছিল উপসাগরীয় যুদ্ধে তাদের অসাধারন সব রিপোর্টিং এর কারনে। এটি মূলত একটা মার্কিন প্রপাগান্ডা নিউজ চ্যানেল ছিল, এখনও তাই আছে। সেসময় আমাদের ধারনা ছিল না যে শুধু খবরের জন্য কোন আলাদা চ্যানেল হতে পারে, সিএনএন যে কোন বিনোদনমূলক অনুষ্ঠান প্রচার করে না সেটাও জানতাম না। গভীর রাতে খালেদা জিয়া বিটিভি ভবনে সিএনএন সম্প্রচার উদ্বোধন করেন। আমরা অধীর আগ্রহে রাতভর বসে আছি কখন একটা ভাল সিরিজ বা মুভি শুরু হবে। রাত ২-৩টা পর্যন্ত বসেও তেমন কিছুই পেলাম না, খবর চলছে তো চলছেই। একসময় বিরক্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়লাম।
সিএনএন সামগ্রিকভাবে তেমন জনপ্রিয়তা না পেলেও সকাল এগারটায় শোবিজ বা এই জাতীয় নামে তারকাদের খবর নিয়ে আধঘন্টার একটা অনুষ্ঠান হত। এটি কিছুটা জনপ্রিয়তা পায় এবং একই সাথে সমালোচিত হয় মার্কিন অভিনেত্রী, মডেলদের খোলামেলা ছবি ও ভিডিওর কারনে। এছাড়া বাংলাদেশের সাধারন মানুষ এই চ্যানেল নিয়ে আগ্রহ দু'দিনেই হারিয়ে ফেলে।
সে বছরের ডিসেম্বরের ৬ তারিখে ভারতের কট্টরপন্থী হিন্দুরা বাবরী মসজিদ ভেঙ্গে ফেলে সকালের দিকে। সিএনএন এই পুরো ব্যাপারটা লাইভ টেলিকাস্ট করছিল। ৯০ সালের দাঙ্গার অভিজ্ঞতায় ভীত হয়ে সরকার সেদিন সকালে বিটিভিতে সিএনএন এর সম্প্রচার কিছুক্ষনের জন্য বন্ধ করে দেয়।
৯২ এর শেষের দিকে বা ৯৩ এর শুরুতে সরকার ব্যক্তিগত পর্যায়ে বিদেশি চ্যানেল নিয়ে আসার তথা ডিশ অ্যান্টেনা কেনার অনুমতি দেয়। প্রথম বিদেশি চ্যানেল হিসেবে এসেছিল জিটিভি, এমটিভি (পুরোপুরি ইংরেজি চ্যানেল তখন) এবং স্টার (এটিও পুরোপুরি ইংরেজি তখনও)। এই চ্যানেলগুলি তখন খুব সম্ভবত ফ্রি ছিল অর্থাৎ লাইসেন্স কিনতে হত না। শুধু ডিশ অ্যান্টেনা কিনলেই দেখা যেত। প্রথমদিকে অনেকেই তাই ব্যক্তিগতভাবে ডিশ কিনে দেখা শুরু করে। ক্যাবল অপারেটররা আসে একটু পরে।
৯৪ এর কোন এক ঈদের আনন্দমেলা অনুষ্ঠান করার দায়িত্ব পান হানিফ সংকেত। তিনি এই অনুষ্ঠানে প্রচারের জন্য দর্শকদের কাছে প্রাইভেট ভিডিও পাঠানোর আহবান জানান। আনন্দমেলার মাস দেড়েক আগেই এই বিষয়ে ঘোষনা দেয়া হয় এবং কর্তৃপক্ষের রায়ে নির্বাচিত তিনটি ভিডিও আনন্দমেলায় প্রচারিত হয়। নাট্যপরিচালক সোহেল আরমান এই তিনজনের মধ্যে একজন ছিলেন। মিডিয়াতে এটাই তার প্রথম কাজ। ভিডিওগুলি খুব আহামরি কিছু না হলেও উল্লেখযোগ্য এজন্য যে প্রথমবারের মত বিটিভির নিজস্ব প্রযোজকদের বাইরে সাধারন মানুষের পক্ষে সম্ভব হয় তাদের কাজ সারা বাংলাদেশকে দেখানোর। হতে পারে বিটিভি কর্তৃপক্ষ প্রাইভেট প্রডাকশনের অনুমতি দেবার আগ মুহুর্তে এই প্রতিযোগিতার মাধ্যমে দর্শক এবং সম্ভাব্য নির্মাতাদের আগ্রহ মাপতে চেয়েছিল। হতে পারে, দুটো একেবারেই সম্পর্কহীন ঘটনা।
এর কিছুদিন পরই প্রাইভেট প্রডাকশনের ঘোষনা আসে এবং হানিফ সংকেতই প্রথম এই সুযোগ গ্রহন করে তার জনপ্রিয় অনুষ্ঠান ইত্যাদিকে বিটিভি থেকে বের করে তিনি নিজেই নির্মান করেন। কয়েকদিন পর বিটিভির সদ্য অবসরপ্রাপ্ত প্রযোজক আতিকুল হক চৌধুরী মাসুদ রানা সিরিজের পিশাচ দ্বীপ বইটির কাহিনী নিয়ে প্রথম প্যাকেজ নাটক হিসেবে নির্মান করেন প্রাচীর পেরিয়ে।
লক্ষনীয় যে হানিফ সংকেত বা আতিকুল হক চৌধুরী কেউই নতুন পরিচালক ছিলেন না। তারা তখনই বিটিভিতে প্রতিষ্ঠিত। এরপর আরও বেশ কিছুদিন প্যাকেজ অনুষ্ঠানগুলি এরকম বিটিভির পুরোনো নির্মাতাগোষ্ঠির মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। আস্তে আস্তে এটি ছড়াতে থাকে বিটিভির স্বল্পপ্রতিষ্ঠিত শিল্পী যেমন ফারিয়া হোসেন, মোহন খান এদের মাঝে এবং তারও অনেক পরে সম্পূর্ন নতুন পরিচালকেরা আসেন।
বাংলা চ্যানেল প্রথমবারের মত স্যাটেলাইটে যায় এটিএন এর মাধ্যমে। ৯৭-৯৮ সালের কোন একসময় তারা ভারতীয় চ্যানেল এটিএন মিউজিকের সন্ধ্যার একঘন্টার স্লট কিনে নেয় এবং তাদের নিজস্ব সিনেমার গান ইত্যাদি প্রচার শুরু করে। এর কিছুদিন পর তারা নিজেরাই এটিএন নাম দিয়ে পুর্নাঙ্গ চ্যানেল স্থাপন করে।
তারপর আস্তে আস্তে স্যাটেলাইট চ্যানেল হিসেবে যুক্ত হয় চ্যানেল আই, একুশে টিভি, এনটিভি ইত্যাদি।
আজ এখানেই শেষ।
সর্বশেষ এডিট : ২৬ শে আগস্ট, ২০১১ সকাল ১০:৪২