কোন এক গাঁয়ের বধুর কথা তোমায় শোনাই শোনো
রুপকথা নয় সে নয়
জীবনের মধুমাসের কুসুম ছিঁড়ে গাঁথা মালা
শিশিরভেজা কাহিনী শোনাই শোনো। (লিঙ্ক )
কিংবদন্তী শিল্পী হেমন্ত মুখোপাধ্যায়কে (হিন্দি ছবির রাজ্যে হেমন্ত কুমার নামে পরিচিত) পরিচয় করিয়ে দেবার কিছু নেই। শুধু এটুকুই তার সম্পর্কে বলা যায়, গায়ক এবং সুরকার হিসেবে বাংলা গানে ছয় দশকেরও বেশি সময় ধরে যে জনপ্রিয়তা তিনি উপভোগ করছেন, তার আগে বা পরে কেউ সেটা স্বপ্নে দেখতেও ভয় পাবেন। আমাদের মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে তিনি বিভিন্ন অনুষ্ঠানে গান গেয়ে উদ্বাস্তু শিবিরের জন্য প্রচুর অর্থসংগ্রহ করেন। যুদ্ধ শেষ হবার পর ৭২ সালেই স্বাধীন বাংলাদেশ সফর করেন।
১৯৮৯ সালের সেপ্টেম্বরের ঘটনা। আজাদ যশোরী নামের জনৈক কবি তার এক ভুইফোঁড় সংগঠন (নাম ভুলে গেছি, কেউ সাহায্য করতে পারবেন?) থেকে কবি মাইকেল মধুসুদন পুরষ্কার প্রদান করে। আজাদ যশোরী, তার সেই সংগঠন বা এই পুরষ্কারের নাম আমি এর আগে বা পরে কোনদিনই শুনি নাই। অবশ্য কবিতা পড়ি না বলে অনেক মাঝারি বিখ্যাত কবির নাম নাও শুনতে পারি। এই ঘটনার সময় পর্যন্ত তার তিনটি কবিতা বই প্রকাশিত হয়েছিল - সংঘাত, অপঘাত, প্রতিঘাত।
সে বছর হেমন্ত মুখোপাধ্যায়কে তারা পুরষ্কারের জন্য নির্বাচিত করে। তাঁর সাথে অন্য কারা পুরষ্কার পেয়েছিলেন, সেটা এত বছর আর মনে করতে পারছি না। অন্য দেশের এই অখ্যাত সংগঠনের এই অখ্যাত পুরষ্কার খ্যাতির শীর্ষে থাকাবস্থায় হেমন্তবাবু কেন গ্রহন করেছিলেন, সেটা আজও আমাকে বিষ্মিত করে!
পুরষ্কার নিতে হেমন্ত ঢাকায় এলেন। পুরষ্কার প্রদান অনুষ্ঠানের পাশাপাশি আজাদ যশোরীর আয়োজনেই ইঞ্জিনিয়ার্স ইন্সটিটিউটে তাঁর একক সঙ্গীতানুষ্ঠান করা হল। টিকিটের দাম ছিল ৫০০, ৩০০ এবং ২০০ টাকা। এই অনুষ্ঠানের টিকেট বিক্রি করে ব্যবসা করাই বোধহয় হেমন্তকে পুরষ্কার দেয়ার কারন। এছাড়াও বাংলাদেশ টেলিভিশনে বিশিষ্ট গীতিকার আবু হেনা মুস্তফা কামালের উপস্থাপনায় তাঁর একক অনুষ্ঠান প্রচারিত হয়। একঘন্টার এই অনুষ্ঠানে মাত্র চারটি গান পরিবেশন করলেও আবু হেনা এবং তাঁর দীর্ঘ আলাপচারিতা ছিল খুবই উপভোগ্য। আবু হেনা তাঁকে চতুর্থ গানের অনুরোধ জানালে তিনি উত্তর দেন - "আমি ক্ষমা চাইছি, এটাই কিন্তু শেষ অনুরোধ। আর অনুরোধ করবেন না। আমার বয়স হয়েছে, শরীর খুব একটা ভাল না"। এরপর তিনি গেয়ে শোনান -
আমার গানের স্বরলিপি লেখা রবে
পান্থ পাখীর কুজন কাকলী ঘিরে
আগামী পৃথিবী কান পেতে তুমি শোনো
আমি যদি আর নাই বা আসি হেথা ফিরে। (লিঙ্ক )
এসব পুরষ্কার এবং অন্যান্য অনুষ্ঠান চলাকালেই হঠাৎ পত্রিকায় খবর এল, হেমন্ত নাকি আয়োজকদের আচরনে প্রচন্ড ক্ষুদ্ধ হয়েছেন। আয়োজকগোষ্ঠী বাংলাদেশে তার যে ধরনের থাকা-খাওয়ার বন্দোবস্তের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, তার কিছুই ঠিকমত পালন করা তো দূরের কথা, এত বড় শিল্পীকে যথাযোগ্য মর্যাদাও দেয়নি। এমনকি কবি যশোরী হেমন্তের পাসপোর্ট পর্যন্ত তার নিজের জিম্মায় রেখে দিয়েছে এবং হেমন্ত বারবার চাওয়ার সত্ত্বেও ফেরত দিচ্ছিল না। এসময় তাঁর বয়স ছিল ৬৯ বছর এবং ঢাকায় আসার কিছুদিন আগে তাঁর হার্টের অপারেশন হয়েছিল। এরকম অবস্থায় আয়োজকদের অসহযোগিতা এবং অব্যবস্থাপনায় তিনি আরও অসুস্থ হয়ে পড়েন। পরিস্থিতি মোকাবেলায় এবং বিদেশি ভিআইপি মেহমানের সম্মান রক্ষার্থে এরশাদ সরকার হস্তক্ষেপ করে। পুলিশ যশোরীকে গ্রেফতারও করে তার কাছ থেকে পাসপোর্ট উদ্ধার করে এবং হেমন্তের থাকা-খাওয়া ও দ্রুত দেশে ফিরে যাওয়ার ব্যবস্থা করে দেয়। এমনকি সংসদেও বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হয়।
ফিরে যাবার দুই সপ্তাহের মধ্যেই সেপ্টেম্বরের ২৬ তারিখে তাঁর আরেকটি মেজর হার্ট অ্যাটাক হয় এবং সেদিনই রাত সোয়া এগারটায় এই মহান শিল্পী শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
পুনশ্চঃ হেমন্ত মুখোপাধ্যায় মারা যাবার এক মাসেরও কম সময়ের মধ্যে ২৩শে অক্টোবর, '৮৯ গীতিকার আবু হেনা মুস্তফা কামালও মারা যান! বিটিভির সেই অনুষ্ঠানটি ছিল দু'জনেরই শেষ টিভি অ্যাপিয়ারেন্স।
আমার গানের স্বরলিপি লেখা রবে
পান্থ পাখীর কুজন কাকলী ঘিরে
আগামী পৃথিবী কান পেতে তুমি শোনো
আমি যদি আর নাই বা আসি হেথা ফিরে। (লিঙ্ক )
সর্বশেষ এডিট : ২৪ শে আগস্ট, ২০১১ সকাল ৯:৫৯