নকশাল আন্দোলনের প্রানপুরুষ চারু মজুমদার ছিলেন চিরকালীন বিপ্লবী। গনতান্ত্রিক আন্দোলনের চেয়ে গেরিলা পদ্ধতির প্রতিই তার ঝোঁক বেশি ছিল। কমিউনিস্ট পার্টি অফ ইন্ডিয়া (সিপিআই) এর সদস্য চারু ১৯৪৬ সালের উত্তরবঙ্গে (প্রধানত এপার বাংলায়) সংঘটিত তেভাগা আন্দোলনেও তিনি অংশ নেন। ১৯৬৪ সালে সিপিআই থেকে আদর্শিক মতপার্থক্যের কারনে বের হয়ে সিপিআই (মার্ক্সিস্ট) এ যোগ দেন। এসময় শারীরিক অসুস্থতার কারনে তাকে দীর্ঘদিন বিশ্রামে থাকতে হয়। বিশ্রামকালে তিনি মাও সেতুং এর চীন বিপ্লবকে খুব ভালভাবে স্টাডি করেন এবং একই পদ্ধতিতে ভারতে সমাজ সংস্কারের পরিকল্পনা করেন। ১৯৬৭ সালে সিপিআই (মার্ক্সিস্ট) নির্বাচনে অংশ নিয়ে কোয়ালিশন সরকার গঠনের সিদ্ধান্ত নিলে চারু মজুমদার ও অন্যান্য বিপ্লবী নেতাদের সাথে নির্বাচনভিত্তিক নেতৃবৃন্দের চরম তিক্ততার সৃষ্টি হয়।
'৬৭ সালের মে মাসে দার্জিলিং এর নকশালবাড়ি নামের এক গ্রামের জনৈক বিমল কিষান আদালত থেকে তার নিজের জমি চাষ করার অনুমতি পান। কিন্তু স্থানীয় জোতদারদের গুন্ডারা সেই জমি ছিনিয়ে নেয়। চারু মজুমদার এবং কানু স্যান্যালের নেতৃত্বে গ্রামের নিম্নবর্গ মানুষ জোতদারদের আক্রমন করে জমি ফিরিয়ে দেবার দাবি জানায়। এই ঘটনার জের ধরে ২৪শে মে কুখ্যাত পুলিশ ইন্সপেক্টর সোনম ওয়াংগরি বিপ্লবীদের হাতে খুন হয়। আন্দোলন দমানোর জন্য স্বরাস্ট্রমন্ত্রী জ্যোতি বসুর পুলিশ বাহিনী নির্মমভাবে গুলি করে এগার জনকে হত্যা করে যার মধ্যে আট জন মহিলা ও দুই জন শিশু। দুই মাসের মধ্যেই পুলিশ এই আন্দোলনকে চাপা দিয়ে ফেললেও এর আদর্শ খুব শিঘ্রিই পুরো বাংলায় ছড়িয়ে পড়ে নকশালবাড়ি আন্দোলনের সূচনা করে যা পরবর্তী পাঁচ বছর স্থায়ী হয়।
রাতারাতি চারু মজুমদার পশ্চিমবঙ্গই না শুধু, গোটা ভারতের বিশেষ করে তরুন সমাজের নায়কে পরিনত হন। গ্রামবাংলার খেটে খাওয়া মানুষ এই আন্দোলনকে তাদের দুর্দশাগ্রস্থ জীবন থেকে উদ্ধার পাওয়ার একমাত্র পথ হিসেবে দেখতে শুরু করে। ভোটের রাজনীতি যেহেতু স্বাধীনতার বিশ বছর পরও তাদের তেমন কোন কাজে আসেনি, তাই এই সশস্ত্র আন্দোলনের মাধ্যমে ক্ষমতা দখলের স্বপ্নে বিভোর হয় ভারতের প্রায় অর্ধেকের বেশি জনসাধারন।
বিপ্লবীদের নীতি ছিল জমির মালিকানা তথাকথিত মালিকপক্ষ থেকে কেড়ে নিয়ে সেখানে চাষীদের পূনর্বাসন করা এবং পুলিশ বা প্রশাসন মালিকের পক্ষ নিলে তাদেরকেও সশস্ত্র হামলা করা। বাংলার বেশ কিছু জায়গা নকশালদের পুরোপুরি দখলে চলে যায়। সবচেয়ে বেশি অংশগ্রহন করে উপজাতি সম্প্রদায় বিশেষ করে সাঁওতালরা যারা বছরের পর বছর যাবৎ শুধু নিগৃহিতই হয়েছে।
অবিশ্বাস্যভাবে কলকাতার শীর্ষস্থানীয় কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম সারির ছাত্রছাত্রীরাও সমাজ বদলের রোমান্টিসিজমে উদ্বুদ্ধ হয়ে বই-খাতা ফেলে অস্ত্র হাতে তুলে নেয়। ষাটের দশকে সারা পৃথিবী জুড়েই তরুন সমাজের মধ্যে একটা অস্থিরতা চলছিল। নিয়ম রীতিকে ভেঙ্গে চুড়ে নিজের মত করে তৈরী করার একটা প্রবনতা সেসময় ইউরোপ, আমেরিকায় প্রবল জনপ্রিয় হয়েছিল। বাংলার যুবসমাজও এই নিয়মভাঙ্গার উচ্চাশায় নকশালবাদী দলে যোগ দেয়। ছাত্র এবং কৃষকদের সমন্বয়ে গঠিত এই নব্যবিপ্লবীর দল ধনিক শ্রেনীর মূর্তিমান আতঙ্কে পরিনত হয়।
পরিস্থিতি ভয়াবহ আকার ধারন করলে কেন্দ্রের সরকার যেকোন উপায়ে নকশালদের দমননীতি গ্রহন করে। হাজার হাজার বিপ্লবীকে কোনরকম বিচার ছাড়াই পুলিশ সরাসরি গুলি করে বা থানায় এনে নির্মম অত্যাচার করে হত্যা করা হয়। ১৯৭০ সালে শীর্ষনেতা কানু স্যানাল পুলিশের হাতে ধরা পড়েন। গোটা একাত্তর জুড়ে চলতে থাকে এই দমন এবং সরকার চারু মজুমদার ছাড়া প্রায় সব নেতাকে গ্রেফতার বা হত্যা করতে সক্ষম হয়। নেতা-কর্মী দুই দিকেই এত বেশি ক্ষতিসাধন হয় যে চারু মজুমদারের একার পক্ষে আর এই আন্দোলন চালানো সম্ভব হচ্ছিল না। যেসব নব্যবিপ্লবী তখনও ধরা পড়েনি, তারাও পুলিশের ভয়ে গা ঢাকা দেয়া শুরু করে।
প্রশাসনের এই অত্যাচার ছাড়াও পার্টির অন্তর্কোন্দল মাথাচাড়া দিয়ে উঠে। চারু মজুমদারের অনেক কমরেডও তার শ্রেনীশত্রু খতম নীতির বিরোধীতা করেন। শুধুমাত্র ধনী হবার কারনেই হত্যা করার যে পরিকল্পনা কমরেড চারু নিয়েছিলেন, সেটা সমালোচিত হয়। ফলে পার্টি বহুধাবিভক্ত হয়ে যায়। এই বিভক্তি সরকারকে নকশাল দমনে সাহায্য করে এবং মোটামুটি ১৯৭২ সালের মধ্যে আন্দোলন স্তিমিত হয়ে যায়।
অবশেষে চারু মজুমদার ১৯৭২ সালের ১৬ই জুলাই তার সহকর্মী দীপক বিশ্বাসের বিশ্বাসঘাতকতার কারনে ধরা পড়েন। ১২ দিনের প্রচন্ড পুলিশ নির্যাতনের পর জুলাইয়ের ২৮ তারিখে তার মৃত্যু হয়। তার মৃত্যুর সাথে সাথে আন্দোলনের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের পতন ঘটে। এরপরও বিভিন্ন জায়গায় ছোটখাট কিছু গ্রুপ তাদের আন্দোলন চালানোর চেষ্টা করলেও সফলতা পায়নি। সাতের দশকের শেষভাগে নকশাল আন্দোলনের পুরোপুরি মৃত্যু ঘটে।
অপর শীর্ষনেতা কানু স্যান্যাল জ্যোতি বসুর সরাসরি হস্তক্ষেপে ১৯৭৭ সালে জেল থেকে মুক্তি পান এবং নির্বাচনভিত্তিক গনতান্ত্রিক রাজনীতি শুরু করেন। বিষ্ময়করভাবে ২০১০ সালে ৭৮ বছর বয়সী কানু গলায় ফাঁসি দিয়ে আত্মহত্যা করেন। আত্মহত্যার তেমন কোন কারন জানা যায় নি। তবে সেসময় শারীরিকভাবে উনি খুব একটা সুস্থ ছিলেন না।
নকশাল কেন ব্যর্থ হল? এর পেছনে বেশ অনেকগুলি কারন একসাথে কাজ করেছে। এখানে আমি কয়েকটা মৌলিক সমস্যাকে চিহ্নিত করার চেষ্টা করেছি।
১) নকশাল ছিল একটা জাতীয় আন্দোলন। শুধু একটা অঞ্চলে সফলতা পেয়ে লাভ হবে না, গোটা ভারতে পাওয়া দরকার ছিল। ভারতে এত ভিন্ন জাতের, ভাষার, সংস্কৃতির লোক বাস করে যে সবাইকে একসাথে কোন ইস্যুতে উদ্বুদ্ধ করা প্রায় অসম্ভব ব্যাপার। তাছাড়া সেসময় টেলিফোন ইত্যাদি যোগাযোগ ব্যবস্থাও ছিল অপ্রতুল। মূলত এই ভূমি এবং জনসংখ্যার এই বিশাল আকারের কারনে ভারতের ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন কখনো সফল হয়নি। নকশাল আন্দোলন বাংলা ছাড়া অন্ধ্রপ্রদেশে জনপ্রিয়তা পেয়েছিল। এছাড়া আরও বেশ কিছু অঞ্চলে এটি শুরু হলেও সর্বভারতীয় গ্রহনযোগ্যতা এটি পায়নি।
২) নকশাল নেতাদের শ্লোগান "চীনের চেয়ারম্যান মাও আমাদের চেয়ারম্যান" ছিল ভুল। কলকাতায় বৃষ্টি হলে পিকিংয়ে মাও এর উপর ছাতা ধরার আগ্রহী খুব বেশি লোক হয় না। অন্য দেশের এক নেতা যার সাথে ভারতের জনগনের কোন সম্পর্ক নাই, তাকে চেয়ারম্যান মানতে লোকে এমনিতেও রাজি হত না, তার উপর ১৯৬২ সালের চায়না-ভারত যুদ্ধের কারনে ভারতের সাধারন জনতা চায়নার উপর বিশেষ করে মাওয়ের উপর প্রচন্ড ক্ষিপ্ত ছিল। তাই মাওকে নিয়ে নকশালদের অতিরিক্ত বাড়াবাড়ি তারা ভাল চোখে দেখেনি।
৩) হাজার হাজার প্রতিভাবান ছাত্রছাত্রী হুজুগে পড়ে নকশালে যোগ দিয়েছিল এই আন্দোলন সম্পর্কে ভালভাবে না জেনেই। আন্দোলনের মূল আদর্শের সাথে তার তেমন পরিচয় ছিল না।
৪) গুজব ছিল, চারু মজুমদারের দেশি মদে আসক্তির কারনে তার চিন্তাভাবনা করার ক্ষমতা আস্তে আস্তে কমে আসছে। এছাড়া আগেই বলা হয়েছে, তার শ্রেনীশত্রু খতমের ধারনার সাথে তার সহকর্মীরাই একমত ছিলেন না।
৫) নকশাল আন্দোলনের ভিত্তি ছিল চায়নায় মাও সেতুং এর সাফল্য। মাও সে তুং সেখানে কেন সফল, সেটা ভিন্ন প্রসঙ্গ। কিন্তু এভাবে জমি অস্ত্র দেখিয়ে কেড়ে নিয়ে অল্প কিছুদিনের জন্য হয়ত চমক দেখানো যায়, দীর্ঘমেয়াদের আন্দোলন সফল করা যায় না। সে হিসেবে তাদের মূল ভিত্তিটিই ছিল অবাস্তব। ষাটের দশকে বিশ্বজুড়ে মাও এর যত ভক্ত ছিল, খোদ চায়নাতেও বোধ হয় অত ভক্ত ছিল না। মাও এর নীতি তাত্ত্বিকভাবে শুনতে ভাল লাগে, কার্যক্ষেত্রে অচল।
এছাড়া এই বিষয়ে গবেষনাকালে বিভিন্ন ভারতীয় ওয়েবসাইটে আরও কিছু কারন দেখতে পেয়েছি যেমন কেন্দ্রে ক্ষমতাসীন কংগ্রেস নাকি নকশালদের মধ্যে নিজেদের লোক ঢুকিয়ে দিয়েছিল এবং সেই কংগ্রেসীরা নকশালের নাম ডোবানোর জন্য বিভিন্ন ধ্বংসাত্মক কাজে লিপ্ত হয়। এগুলির সত্যতা এত বছর পর যাচাই করা খুব কঠিন।
নকশালের মূল নীতি ছিল অর্থনৈতিক বৈষম্যহীন সমাজব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা এবং সাম্যবাদ। তাদের কর্মকান্ডে যত ভুলই থাকুক না কেন, মূল নীতিটি মূল্যহীন হচ্ছে না কোনভাবেই। পঞ্চাশোর্ধ চারু মজুমদার যে যাদুতে দেশের বিরাট সংখ্যক তরুন সম্প্রদায়কে আন্দোলিত করেছিলেন, জীবনে স্বপ্ন দেখতেও ভয় পাওয়া দরিদ্রতম জনগোষ্ঠিকে একবার হলেও কিছু পাওয়ার আশা দেখিয়েছিলেন, সেটাকেও ছোট করা যাবে না। দুঃখের বিষয় এখানে যে এই ভুল নীতিকে বরণ করতে গিয়ে বাংলার বহু প্রতিভাবান ছেলেমেয়ে অকালে তাদের জীবন নষ্ট করেছিল।
বিঃদ্রঃ এই পোস্টের তথ্যের খুঁটিনাটি বিভিন্ন ওয়েবসাইট থেকে প্রাপ্ত। কিন্তু মূল কাঠামো, ব্যাখ্যা, ব্যর্থতার কারন অনুসন্ধান ইত্যাদি আমার নিজস্ব। নকশাল আন্দোলন কাছ থেকে আমি দেখিনি। পরবর্তীকালে বিভিন্ন বইপত্র, প্রবন্ধ পড়ে যা জেনেছি, তার ভিত্তিতে এই বিশ্লেষন।
===========================================
* ব্লগার পারভেজ আলমকে আমি খুব ভাল চিনি না। ব্লগিং একেকজনের কাছে একেকরকম। আমার ব্লগিং স্টাইল আর তার ব্লগিং স্টাইল মোটেই এক না। আমাদের আগ্রহ ভিন্ন বিষয়ে। উনি আমার পোস্টে খুব একটা আসেনও না। আমিও তার পোস্টে যাই না। কিন্তু এই স্বল্পপরিচয়ের মধ্যেও আমি তার জ্ঞান, বিচার-বিবেচনা, যুক্তি-তর্কের উপস্থাপন, সহব্লগারদের প্রতি শ্রদ্ধা ইত্যাদি কারনে তাকে খুব পছন্দ করি। ব্লগে যখন আমি একদম নতুন, জেনারেল স্ট্যাটাসও পাই নি, তখন উনি আমার এক পোস্টে এসে প্রশংসা করে গিয়েছিলেন - "ব্লগে গত কয়েক মাসে নতুন কিছু নিক দেখতে পাচ্ছি, যাদের দেখে আশাবাদী হওয়ার সুযোগ পাচ্ছি।" আমি এই প্রশংসাবাক্য পড়ে এত নার্ভাস হয়েছিলাম যে আজকে এই ৮ মাস পরেও এই মন্তব্যের জবাব দেইনি। জবাবের বদলে আজকে এই উপহার দিলাম।
সর্বশেষ এডিট : ১৩ ই আগস্ট, ২০১১ সকাল ৯:৫৮