পোস্ট উৎসর্গঃ ব্লগার নুরুজ্জামান মানিক এবং ব্লগার গানচিল
আশির দশকের শুরুর দিকে আমি যখন সদ্য কৈশোরে, বাংলাদেশে মূলত ৩টা বাংলা সংবাদপত্র (ইত্তেফাক, দৈনিক বাংলা, সংবাদ), ২টা ইংরেজী সংবাদপত্র (টাইমস, অবজারভার) এবং ১টা সাপ্তাহিক পত্রিকা (বিচিত্রা) ছিল। এছাড়া আওয়ামী লীগের দলীয় মুখপত্র বাংলার বানী, বিনোদন ম্যাগাজিন আনন্দবিচিত্রা এবং আরো কিছু অনুল্লেখযোগ্য পত্রপত্রিকা ছিল। এগুলির মধ্যে বেশ কয়েকটাই পুরোপুরি বিলুপ্ত হয়ে গেছে, কিছু এখনো দুয়েক কপি বের হয় কিন্তু কেউ পড়ে না। এরকমই কিছু বিলুপ্ত বা বর্তমানে অপ্রচলিত কিন্তু এককালের বড় পত্রপত্রিকার স্মৃতিচারন করব আজ।
সবার আগে বলতে হবে বিচিত্রার কথা। বাংলাদেশের সাংবাদিকতাকে এক নতুন মাত্রা দিয়েছিল মুক্তিযোদ্ধা শাহাদত চৌধুরীর এই সাপ্তাহিকটা। এটা প্রথম কবে প্রকাশিত হয় আমার জানা নাই, তবে আমি সম্ভবত প্রথম দেখি ৭৫-৭৬ সালের দিকে। ৬৪ পৃষ্ঠার এই সাপ্তাহিকের কভার স্টোরিগুলি ছিল ক্লাসিক সমতুল্য। এছাড়ার শেষের আগের পৃষ্ঠার কুরুক্ষেত্র কলাম এবং দ্বিতীয় পৃষ্ঠার রনবীর টোকাই কার্টুনের কোন তুলনা হতে পারে না। টোকাই চরিত্রটা সৃষ্টিই না শুধু, বাংলা ভাষায় "টোকাই" শব্দ আবিষ্কার কৃতিত্বও বিচিত্রা এবং রফিকুন নবীকে দিতে হবে। ৮৫-৮৬ পর্যন্ত বিচিত্রা ছিল তার জনপ্রিয়তার তুঙ্গে। ৮৪ সালে শফিক রেহমান তার ৩২ পৃষ্ঠার যায়যায়দিন নিয়ে বাজারে আসলে অপেক্ষাকৃত বেশি দামী ৬৪ পৃষ্ঠার বিচিত্রা তার প্রভাব হারাতে শুরু করে। এর পরও ধুঁকে ধুঁকে পত্রিকাটা বেঁচে ছিল অনেকদিন। বছর দশেক আগে বিলুপ্ত হয়। শাহাদত চৌধুরী পরে প্রায় একই টিম নিয়ে প্রতিষ্ঠা করেন সাপ্তাহিক ২০০০।
যায়যায়দিনের কিছুদিন পর প্রায় একই ফর্মেটে বাজারে আসে বিচিন্তা। বিচিত্রা আর যায়যায়দিন যেখানে ছিল বহু পোড় খাওয়া অভিজ্ঞ দুই সম্পাদকের, বিচিন্তা পরিচালিত হত তরুন মিনার মাহমুদের হাতে। এর লেখক, প্রদায়ক গোষ্ঠীও ছিল একঝাঁক তরুন। ৮৭ এর তীব্র এরশাদ বিরোধী আন্দোলনের সময় এই সাপ্তাহিকটা অত্যন্ত জনপ্রিয় হয়। তাদের প্রতিবাদের ভাষা এতই তীব্র ছিল যে তারা এরশাদকে কুকুর সাজিয়ে প্রচ্ছদ করেছিল (বিশ্বাস করতে পারেন?)। এরশাদ কোনরকমে আন্দোলন সামাল দেয় এবং বিচিন্তা নিষিদ্ধ ঘোষনা করে। ৯১ এর মার্চে পত্রিকাটা আবার বের হলেও কোন কারনে তার জনপ্রিয়তা পুনরুদ্ধার করতে ব্যর্থ হয়। একই সময় যায়যায়দিনও পুনঃপ্রকাশিত হয়। ঝানু সাংবাদিক শফিক রেহমানের সামনে এটা দাঁড়াতে পারেনি। ৯৩ এর দিকে মিনার মাহমুদ পত্রিকা বিক্রি করে দিয়ে যুক্তরাস্ট্রে চলে যান। এর কিছুদিন পর এটা পুরোপুরিই বিলুপ্ত হয়।
৮৬-৮৭ সালের দিকে বের হয় ৬৪ পৃষ্ঠার সম্পূর্ন ক্রীড়া সাপ্তাহিক বর্তমান দিনকাল। তখন ছিল ঢাকা লীগ ফুটবলের স্বর্নযুগ। এছাড়া আজকের মত ইন্টারনেট, বিদেশি টিভির প্রাপ্যতা না থাকায় ক্রীড়াপিপাসুদের মধ্যে এটা ভালরকম জনপ্রিয় হয়। একই সময় ইত্তেফাক গোষ্ঠীর ৩২ পৃষ্ঠার আরেকটা ক্রীড়া সাপ্তাহিক ক্রীড়াজগতও প্রকাশিত হত। কোন কারনে বর্তমান দিনকাল মালিক গোষ্ঠী এর ফর্মেট বদলে একে বারমিশালী সাপ্তাহিক হিসেবে প্রকাশ করতে শুরু করে। ধীরে ধীরে এটা প্রায় সেমি-পর্নোগ্রাফিক ম্যাগাজিনে পরিনত হয়। কোন হোটেলে অবাধ দেহ-ব্যবসা চলে, কোন মহিলার কার সাথে লটরপটর, কোন দ্বিতীয় সারির নায়িকার বাড়ি মক্ষীকুঞ্জ ইত্যাদি খবর প্রকাশিত হত বর্তমান দিনকালে। এরকমই দেখেছি আমি ৯৪ সাল পর্যন্ত। তারপরের কথা আর জানি না। ক্রীড়াজগতও আস্তে আস্তে অনিয়মিত হয়ে যায়।
সামহোয়ারে আপনি বেশ কয়েকজন ব্লগারের নাম দেখবেন গেদুচাচা শব্দ ব্যবহার করে। টোকাইয়ের মত এটাও বাংলাভাষার একটা নতুন শব্দ যার প্রবর্তক সাপ্তাহিক সুগন্ধার সম্পাদক খন্দকার মোজাম্মেল হক (নামটা নিয়ে একটু কনফিউশনে ছিলাম। ব্লগার নস্টালজিক এবং ব্লগার আলিম আল রাজি ঠিক করে দিয়েছেন, তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা)। গেদুচাচা, সত্যি বলতে, তার জনক মোজাম্মেল হক এবং জন্মভুমি সুগন্ধা পত্রিকার চেয়ে অনেক বেশি জনপ্রিয় হয়ে গেছেন। আপনাদের অনেকেই হয়ত আসল গেদুচাচার খোলা চিঠি কলামটা কখনোই পড়েন নাই, কিন্তু এই নামের সাথে পরিচিত। এটা শুরু হয় ৮৮ এর দিকে। মোজাম্মেল সাহেব এই ছদ্মনামে এরশাদকে চিঠি লিখতেন বিভিন্ন পরামর্শ ও সমস্যা জানিয়ে। সুগন্ধা পত্রিকাটা এমন বিশেষ কিছু ছিল না, কিন্তু এই একটামাত্র কলামের জন্যই এটা জনপ্রিয় হয়। খন্দকার মোজাম্মেল হকের সম্পাদনা জীবন স্থির ছিল না। সুগন্ধার মালিকপক্ষের সাথে মিল না হওয়ায় উনি সুর্যোদয় নামে একটা পত্রিকায় যোগ দেন, পরে আবার আজকের সুর্যোদয় বের করেন। আজকের সুর্যোদয় ছাড়া তার বাকি সব পত্রিকাই মৃত্যুবরন করেছে, শুধু বেঁচে আছেন গেদুচাচা। মনে হচ্ছে অনেক বছর এই চরিত্রটা টিকে থাকবে।
গিমিক তৈরী উদ্দেশ্যেই হোক আর যে কোন কারনেই হোক, প্রেসিডেন্ট জিয়া শিশু-কিশোরদের নিয়ে বেশ কিছু কাজ করেছেন। টেলিভিশনে নতুন কুঁড়ি প্রতিযোগীতা এবং শিশু একাডেমী প্রতিষ্ঠা তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য। শিশু একাডেমী পরিচালনার ভার জিয়া দেন তার পুরোনো বন্ধু সাদেকা শফিউল্লাহকে। মিসেস সাদেকার সম্পাদনাতেই বের হয় শিশু-কিশোরদের সাহিত্য পত্রিকা শিশু। জানি না বিশ্বাস করবেন কিনা, আমি নিজে তারেক রহমানের লেখা গল্প পড়েছি শিশুতে। জিয়া মারা যাওয়ার পর তারেক তার বাবাকে নিয়ে স্মৃতিচারনও লিখেছিল। এটা বেশ জনপ্রিয় একটা ম্যাগাজিন ছিল। ঠিক কবে বন্ধ হয় আমার জানা নাই কারন তখন আমি নিজে আর শিশু বা কিশোর নাই। তবে আশির দশকের পরে আর দেখি নাই।
উম্মাদের জনপ্রিয়তায় অনুপ্রানিত হয়ে কিছু তরুন কার্টুনিস্ট ৮৯-৯০ সালের দিকে বের করে কার্টুন ফান ম্যাগাজিন কার্টুন। পত্রিকার চেয়ে এদের ফান স্টিকারগুলিই বেশি জনপ্রিয় ছিল। রামছাগলের লম্বা কান তুমি আমার জানের জান, বাগানে দাড়ায়ে খাসি আমি তোমায় ভালবাসি, দেখায় মুরগী খাওয়ায় ডাইল, এগুলি ছিল তাদের স্টিকারের ভাষা। ফান কার্টুন ম্যাগাজিনের বাজার এত বড় না যে দুইটা পত্রিকা ভালভাবে চলতে পারবে। উম্মাদ টিকে গেল, কার্টুন কয়েক বছর পর নাই হয়ে গেল।
খুব স্বল্পকালীন জনপ্রিয় একটা দৈনিকের কথা বলে আজকে শেষ করি। ৯৩ সালে বড়সড় বাজেট নিয়ে একটা পত্রিকা প্রকাশিত হয় মতিউর রহমান চৌধুরীর সম্পাদনায় দৈনিক বাংলাবাজার(সম্পাদকের নাম অনেক চেষ্টা করেও মনে করতে পারছিলাম না। ব্লগার অ্যানালগ সাহায্য করলেন, তার প্রতি কৃতজ্ঞতা।)। প্রথম বছর খানেক বেশ কাটতি ছিল। পরে জনকন্ঠ, ভোরের কাগজ ইত্যাদি মাঠে নামলে এটা বিলুপ্ত হয়ে যায়। মতিউর সাহেব পরে ট্যাবলয়েড পত্রিকা মানবজমিন বের করেন।
ক্ষমা করবেন, আর দুইটা সাপ্তাহিকের কথা বলব। যায়যায়দিনের জনপ্রিয়তায় অতি আত্মবিশ্বাসী হয়ে শফিক রেহমান আরও দুইটা সাপ্তাহিক বের করেন। সিরিয়াস পাঠকদের জন্য সীমানা পেরিয়ে এবং ফান ম্যাগাজিন মৌচাকে ঢিল। এরা একই সাথে বের হয় এবং একই সাথে ছয় মাসের মধ্যে বন্ধও হয়ে যায়। সীমানা পেরিয়ের টার্গেট মার্কেট ছিল খুব ছোট। আর লোকে রসআলো বা আলপিন পত্রিকার সাথে ফ্রি পেলে পড়ে, কিন্তু ৯৪ সালে পাঁচ টাকা খরচ করে প্রতি সপ্তাহে কিনার মত লোক খুব বেশি ছিল না।
আজকে শেষ।
সর্বশেষ এডিট : ২২ শে এপ্রিল, ২০১১ সকাল ১০:৩৩