ষাটের দশকে আলমগীর (সত্তর দশকে পাকিস্তান চলে যান এবং ওখানেই গায়ক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হন), জাফর ইকবাল (পরবর্তীতে নায়ক) এবং আরও কিছু মিউজিকপ্রেমীদের হাতে ব্যান্ড সঙ্গীত শুরু হলেও আমজনতার মধ্যে প্রতিষ্ঠিত হয়নি। কারন এই ব্যান্ডগুলি ছিল ক্লাব, হোটেল কেন্দ্রিক। মুলত তারা হোটেল ইন্টার কন্টিনেন্টালের উইন্টার গার্ডেনে, ঢাকা ক্লাবে পারফর্ম করতেন। সাধারন মানুষের মধ্যে ব্যান্ড জনপ্রিয় হয় সাতের দশকের প্রথম ভাগে আজম খান, ফেরদৌস ওয়াহিদদের মাধ্যমে। এদের দেখানো পথে আস্তে আস্তে গড়ে উঠে সোলস, ফিডব্যাক, ফিলিংস, মাইলস এসব ব্যান্ডগুলো।
তবে ব্যান্ড মিউজিকের স্বর্নযুগ আমি বলব আশির দশক। এসময়ে অডিও ইন্ডাস্ট্রি প্রতিষ্ঠার কারনে ব্যান্ড দেশের আনাচে-কানাচে পৌঁছাতে সক্ষম হয়। এছাড়া আজম-ওয়াহিদ পরবর্তী নতুন ব্যান্ডগুলিও তাদের প্রাথমিক প্র্যাকটিস এবং গান কম্পোজিশন শেষে এই সময়ে তাদের অ্যালবাম প্রকাশ করে।
নব্বই দশকের শুরুর দিকে ব্যান্ড মিউজিকের এত রমরমা অবস্থা ছিল যে ক্যাসেট কোম্পানীরা ব্যান্ড ছাড়া সলো আধুনিক শিল্পীদের অ্যালবাম ছাড়তেই চাইত না। অনেক একক শিল্পী এসময়টাতে শুধুমাত্র ব্যান্ডের মার্কেট ধরার জন্য নামকাওয়াস্তে একটা ব্যান্ড গঠন করত এবং সেই ব্যান্ডের লেবেল ব্যবহার করে তাদের সলো অ্যালবাম বাজারে ছাড়ত। একটা উদাহরনও দেই। রবি চৌধুরী যখন একদম নতুন, তিনি এরকম এক সাইনবোর্ড সর্বস্ব ব্যান্ড সানডে (নামটা খেয়াল করুন) তৈরী করে অ্যালবাম ছেড়েছিলেন।
ব্যান্ডের এই জৌলুসপূর্ন সময়ে '৯৩ সালের মাঝামাঝি বিশাল আলোড়ন তুলে বাজারে আসে বাংলাদেশের প্রথম মিক্সড অ্যালবাম স্টারস। সে সময়কার অতি জনপ্রিয় কয়েকটি ব্যান্ডের ভোকালরা আশিকুজ্জামান টুলুর সুর ও সঙ্গীতে একটা করে গান গেয়েছিলেন এই অ্যালবামে। স্মৃতি থেকে কয়েকটা নাম তুলে দিচ্ছি। মাকসুদ, আজম খান, বিপ্লব, টিপু, নিলয় দাস, পঞ্চম, সামিনা চৌধুরী (উনি কখনো কোন ব্যান্ডে ছিলেন না, কিন্তু এই অ্যালবামে চমৎকার একটি গান গেয়েছিলেন)। এই শিল্পীদের একটা বড় অংশই এর আগে কখনো নিজেদের ব্যান্ড ছাড়া অন্য কোথাও পারফর্ম করেননি, এতগুলি শিল্পীও আগে একসাথে পাওয়া যায়নি। ফলে অসম্ভব জনপ্রিয়তা পায় এই অ্যালবামটি, যদিও মানের বিচারে এর গানগুলি খুব আহামরি ছিল না। কোন গানই দীর্ঘ সময় টিকে থাকেনি।
কিন্তু এই আপাত জনপ্রিয়তার সাথে সাথে সবার অলক্ষ্যে মোটামুটি মানের এই অ্যালবামটিই বাংলা ব্যান্ড মিউজিকের গতিপথ পালটে দেয়ার প্রক্রিয়া শুরু করে। এর সাফল্যের ফলে হঠাৎই জনপ্রিয় ব্যান্ডগুলির ভোকালরা বুঝতে পারে যে একটা ব্যান্ডের অ্যালবাম বাজারে আনতে সময় লাগে ৩-৪ বছর যেহেতু সব শ্রেনীর শ্রোতাদের জন্যই কিছু না কিছু রাখতে হয়, সব সদস্য মিলে বসে কম্পোজ করতে হয়, শ' শ' ঘন্টা কাটাতে হয় প্র্যাকটিস প্যাডে। এইসব কিছুর পর যে টাকা পাওয়া যায়, তা ভাগ হয় ব্যান্ডের সবার মধ্যে। সে তুলনায় একটা মিক্সড অ্যালবামে শুধু একটা গান নিজে তৈরী করতে লাগে ৩-৪ দিন, আর যদি অন্য কারও সুরে হয় তাহলে তো কথাই নেই, রেকর্ডিংয়ে হয়ত একদিন, একটা বড় অংকের টাকা সাথে সাথেই হাতে পাওয়া যায়। অডিও কোম্পানীগুলিও লুফে নিল এই মিক্সড অ্যালবাম ব্যবসা।
টুলু শুরু করলেও উনি খুব একটা এই মাধ্যমে কাজ করেননি। স্টারসের পরে উনি আরেকটি মিক্সড অ্যালবাম করেছিলেন যা ছিল মুলত আধুনিক সলো শিল্পীদের নিয়ে এবং প্রতিটা গান ছিল দ্বৈত কন্ঠে। এরপর টুলু ফিরে যান তার ব্যান্ড আর্কের অ্যালবামের কাজে। মিক্সড অ্যালবাম কালচারকে প্রাতিষ্ঠানিক রুপ দেয়ার কৃতিত্ব দিতে হবে প্রিন্স মাহমুদকে। টুলুর একটু পরে নব্বইয়ের মাঝামাঝির দিকে এই ভদ্রলোক শুরু করেন এবং পরবর্তী দশ বছর একের পর এক হিট মিক্সড অ্যালবাম উপহার দেন। একা উনি যত কালজয়ী গান সুর করেছেন, বাংলাদেশের ব্যান্ড জগতে আর কেউ মনে হয় না তার কাছাকাছিও যেতে পারবেন। শুধুমাত্র মা আর বাংলাদেশ (দুটোর গায়কই জেমস) গান দুটোই তাকে অনেক বছর বাঁচিয়ে রাখবে। তাঁর সাফল্যে অনুপ্রানিত হয়ে আরও অনেকেই মিক্সড অ্যালবাম তৈরীকে তাদের পেশা হিসেবে নেন।
প্রতিষ্ঠিত ব্যান্ডের ভোকালরা (যারা বেশিরভাগ সময় ব্যান্ডের মুখ্য কম্পোজার) এভাবে মিক্সড অ্যালবামে ব্যস্ত হয়ে পড়ায় গোটা ব্যান্ড কালচার চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হতে শুরু করে। পুরোনো ব্যান্ডগুলি অ্যালবাম প্রকাশ কমিয়ে দেয়, নতুন শিল্পীরাও বছরের পর বছর কষ্ট করে গান কম্পোজ করার চাইতে কোন মিক্সড অ্যালবামে কোনভাবে একটা গান ঢুকিয়ে রাতারাতি সাফল্য পেতে চায়। সবচেয়ে বাজে প্রভাব যেটা পড়ে, শিল্পীরা তাদের স্বকীয়তা হারায়। যেকোন ব্যান্ডের একটা নিজস্ব স্টাইল থাকে এবং সচরাচর তারা সেই স্টাইলের বাইরে যায় না। মিক্সড অ্যালবামে নানান শ্রেনীর শ্রোতার মনোরঞ্জনের জন্য শিল্পীরা তাদের নিজস্ব ব্যান্ডের স্টাইলের বাইরেও গাইতে শুরু করেন। এছাড়া বেশি প্রডাকশনের ফলে কথা-সুরের কোয়ালিটিও হতে থাকে যাচ্ছে তাই। নতুন শতাব্দীতে শুরু হতে হতে ব্যান্ড মিউজিক প্রায় ধ্বংসের কাছে চলে যায়। সেই খাদের কিনারা থেকে আবার ব্যান্ডকে টেনে তুলে আন্ডারগ্রাউন্ড ব্যান্ড কালচার তৈরী এবং ব্ল্যাক, আর্টসেল ইত্যাদি নতুন প্রজন্মের ব্যান্ডকে প্রতিষ্ঠিত করার কৃতিত্ব বেসবাবা সুমনের। সেই গল্প আরেকদিন।
স্টারস অ্যালবাম বের হবার আগে বেশ পাবলিসিটি করে হাইপ তোলা হয়েছিল। আমি নিজেও বের হবার সাথে সাথেই কিনেছিলাম। সেই ক্যাসেট আজকে কোথায়, কে জানে! ইন্টারনেটে অনেক খুঁজে এর সবচেয়ে হিট গানটা ইউটিউবে পেলাম। শুনে দেখতে পারেন। একটা প্রাসঙ্গিক তথ্য, জেমস তখন একদমই জনপ্রিয় ছিল না। আইয়ুব বাচ্চু এর মাত্র ২-৩ মাস আগে সুখ রিলিজ করে লাইমলাইটে এসেছে। সেসময়টাতে মাকসুদই ছিল সবচেয়ে বড় স্টার।
সর্বশেষ এডিট : ২৬ শে আগস্ট, ২০১১ সকাল ১০:২৩