স্বৈরতন্ত্রেরও কিছু নিয়ম-কানুন থাকে, কিছু নৈতিকতা থাকে। চরম নির্লজ্জ হয়েও মুখরক্ষার জন্য হলেও রাষ্ট্রের কিছু প্রতিষ্ঠানকে স্বৈরাচার রক্ষা করে। কিন্তু যখন বিচারপতি শামসুদ্দিন মানিকের মতো লোকদের দেখি, যখন দেখি যে এই দুর্বৃত্ত কোন রকম লজ্জার বালাই না রেখে টকশোর সঞ্চালককে 'রাজাকারের বাচ্চা' বলে গালি দেয়, তখন মনে হয় আমাদের পাড়ার নাপিত মানিকও তো আওয়ামী দুঃশাসনে নিয়োগপ্রাপ্ত বিচারপতির চেয়ে শিক্ষিত।
এই মানিকের বিচারপতি হয়ে ওঠার জন্য স্বৈরতন্ত্র যথেষ্ট নয়। এদের কে বিচারপতি বানানোর জন্য একটি 'গবুতন্ত্রের' প্রয়োজন হয়। গবুতন্ত্র হলো দুর্বৃত্তদের বানানো একটা ব্যবস্থা যেখানে মূর্খতা, লজ্জাহীনতা এবং অহমিকা প্রজাতন্ত্রের সব ক্ষমতাকে দখল করে ক্ষমতাকে জনগনের বিরুদ্ধে ব্যবহার করে। এই বেহায়াদের মুখরক্ষারও কোন বালাই নেই। গবুতন্ত্রের গবুরাণী সকল জবাবদিহিতার ঊর্ধ্বে ওঠে এক নৈরাজ্যময় মগের মুল্লকের জন্ম দেয়। এর সাথে স্বৈরতন্ত্রের মিশেলে তৈরি হয় 'গবু-স্বৈরতন্ত্র', যার পতনের সন্ধিক্ষণে আমরা এখন দাঁড়িয়ে আছি।
দুঃশাসন, নৈরাজ্য, গণহত্যা চিরস্থায়ী হতে পারে না। আওয়ামী লীগ একটি অচলায়তন যারা দিনের পর দিন রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠান গুলোকে ধ্বংস করেছে। বিচারপতি শামসুদ্দিন মানিকের মতো বিচারপতি নিয়োগের প্রহসন করে বিচার-ব্যবস্থাকে ধ্বংস করেছে। "খেলা হবে" বলে হেলমেট-হাতুড়ি বাহিনী দিয়ে ছাত্রদের রক্তাক্ত করে ধ্বংস করেছে দেশের সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। "টুপ করে পদ্মা ব্রিজ থেকে নদীতে ফেলে দেবার" দম্ভোক্তি এবং মূর্খতা দিয়ে ভয়াবহ এক নৈরাজ্যবাদ সমাজে প্রতিষ্ঠা করেছে এই গবু-স্বৈরতন্ত্রের রানীমা ও এর চাটুকার অমাত্যেরা।
২৫ জুলাই তারিখে লিখেছিলাম, গত ক'দিনে নতুন ইতিহাস রচিত হল। ট্যাক্সের টাকায় পালিত শাসক ও তার আজ্ঞাবাহী বাহিনীর হাতে উদ্দীপিত তরুণের রক্তমাখা লাশের ইতিহাস, জনগণের টাকায় কেনা গোলাবারুদ দিয়ে তাদেরই সন্তানের নির্মম হত্যাকাণ্ড ও তাকে অন্ধকারে মাটি চাপা দেওয়ার ইতিহাস, মানুষের জীবন নিয়ে শাসকের ব্যঙ্গোক্তি ও শয়তানের পরিভাষা তৈরির ইতিহাস। শোক যে শক্তিতে রূপান্তরিত হতে পারে, তা গবু-স্বৈরতন্ত্রের দলের লোকেরা বুঝতে পারেনি। বেতের আঘাত থেকে যখন নিজের পশ্চাৎদেশ রক্ষা করার কথা, সেটা না করে তারা হেলমেট-হাতুড়ি বাহিনী, পুলিশ ও সেনাবাহিনী দিয়ে গণহত্যা চালিয়ে গেছে।
লাশের স্তুপের উপরে দাঁড়িয়ে অনুভব করেছিলাম এই রক্তপাতের ইতিহাসের অধ্যয়ন ও বিশ্লেষণ যুগে যুগে করবে এদেশের মানুষ। যেভাবে ৫২-এর ভাষা আন্দোলন আমাদের আত্মপরিচয়ের সন্ধান দিয়েছিল, যেভাবে ৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান ৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপট রচনা করেছিল এবং যেভাবে ৯০-এর আন্দোলন স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে জনতার বিজয়গাথা রচনা করেছিল, তারই পরম্পরায় ২০২৪ সাল আমাদের আত্মোপলব্ধির নতুন বধ্যভূমি হয়ে আমাদের চেতনাকে তাড়া করে বেড়াবে।
আজ অনুভব করছি ২০২৪-এর ৫ই আগস্টের লংমার্চ একটি বিপুল তরঙ্গের মতো ধেয়ে আসছে। যদিও আজ শয়তান তার সব শক্তি নিয়ে মরার আগে মরণ কামড় দিতে প্রস্তুত হয়েছে। কিন্তু জনতার মিছিলের যে স্রোত, তার শক্তি বিপুল। তার তেজ এত প্রবল যে অনেক বড় শয়তানও এই স্রোতের সামনে খড়কুটোর মতো ভেসে যাবে। তীব্র ঘূর্ণিঝড়, প্রবল জলোচ্ছ্বাস যেমন সব কিছু ভাসিয়ে নিয়ে যায়, এই লংমার্চ এই দুঃশাসন ও নৈরাজ্যকেও ভাসিয়ে নিয়ে যাবে। তবে এর জন্য যে রক্ত, যে প্রাণহানি, যে ক্ষতি, যে মূল্য দিতে হতে পারে, তার কথা ভেবে আমি ভীত ও শঙ্কিত বোধ করছি।
সর্বশেষ এডিট : ০৬ ই আগস্ট, ২০২৪ রাত ৩:২২